মা যদি সেদিন পাশে না দাঁড়াত তাহলে হয়তো এত দিনে আমিও সুশান্ত সিং রাজপুত হয়ে যেতাম: সৌরভ দাস

একটা ভাইরাল ভিডিয়ো আর তাতেই পাল্টে গেল অভিনেতার দুনিয়া। ছাড় পাননি মা'ও। সোশ্যাল মিডিয়া ভেসে গেল সৌরভের মা'কে নিয়েও অশালীন মন্তব্যে। কলম ধরলেন সৌরভ...

মা যদি সেদিন পাশে না দাঁড়াত তাহলে হয়তো এত দিনে আমিও সুশান্ত সিং রাজপুত হয়ে যেতাম: সৌরভ দাস
মায়ের সঙ্গে সৌরভ।
Follow Us:
| Updated on: May 09, 2021 | 5:50 PM

২২ জানুয়ারি ২০২১। একটা ভাইরাল ভিডিয়ো। আর ওই এক ভিডিয়োতেই যেন ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল অভিনেতা সৌরভ দাসের গোটা পৃথিবী। ‘ধর্ষক’ থেকে শুরু করে বোন-প্রেমিকার শরীর নিয়ে কুৎসিত মন্তব্য…জুটেছিল সব কিছুই। বাদ যাননি সৌরভের মা’ও। যিনি ঘটনার সময় উপস্থিতও ছিলেন না সেখানে…সৌরভ ঠিক না ভুল তা বিতর্কের বিষয় তবে সে দিন তাঁর মা’কে টেনে এনে যা যা বলা হয়েছিল আজ মায়েদের দিনে তা নিয়েই টিভিনাইন বাংলার জন্য প্রথম বার কলম ধরলেন অভিনেতা সৌরভ দাস।

সোশ্যাল মিডিয়ায় মা’কে নিয়ে একটা পোস্ট করেছি। দেখেছেন নিশ্চয়ই। অনেক চেষ্টা করেছিলাম মা’য়ের কান্না ওদের দেখাব না। হ্যাঁ ওদের, যারা একদিন আমার মায়ের মেসেঞ্জারে ঢুকে তাঁর শরীর থেকে শুরু করে পেশা, এমনকি আমার বাবার পরিচয় নিয়েও মন্তব্য করে গিয়েছিল একের পর এক। ভিডিয়োটা করতে গিয়ে অনেক ক’টা শট বাদ দিতে হল। মা’কে সামলাতে পারিনি যে। কেঁদে ফেলেছে…

মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্মেছি আমি। বাবা থিয়েটার করতেন চুটিয়ে। অভিনয় করতে এলাম। অভিনেতা হলাম। ভালবাসা পেলাম অনেকের। আমার নামে ফ্যান ক্লাবও গড়ল ওঁরা ভালবেসে। রাস্তা-ঘাটে মা-বাবাকে দেখলে লোকে সামনে এসে বলত, “আপনারা রত্নগর্ভা”… দেখতাম আর মনে মনে ভাবতাম, “আমি এমন কী করে ফেললাম যে বাবা-মা এত খুশি…”। ভাল লাগত। আনন্দ হতো।

২১ জানুয়ারি আমার জন্মদিন ছিল। ফ্যানক্লাব থেকে কুড়ি জন এসেছিল সেলিব্রেট করতে। আধ ঘণ্টার জন্য। সেলিব্রেশন হল। বাবা-বোন সবাই আনন্দে মশগুল। আমিও সবার সঙ্গে সময় কাটিয়ে ফিরে গেলাম বাড়ি। এর ঠিক দু’দিন পর হঠাৎ করেই ভাইরাল এক ভিডিয়ো। যে মানুষ গুলো তার আগের দিনও আমার সম্পর্কে ভাল ভাল কথা বলেছে আমায় কিছু জিজ্ঞাসা না করে, কিছু না বিচার করেই ‘নষ্ট’ দাগিয়ে দিল। আমার বোন, আমার সাত বছরের ছোট বোন, আমার অফিস যাওয়া বাবা-মা’র পরিবর্তে যার দায়িত্ব আমার উপর পড়েছে ছোট থেকে, যাকে মানুষ করেছি ওর কথা কেউ ভাবলেন না?

আরও পড়ুন- মায়েদের দিন: ভয়-অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করেই কাজে যাচ্ছেন ওঁরা, সামলাচ্ছেন ঘরে-বাইরে

View this post on Instagram

A post shared by Saurav Das (@i_sauravdas)

মায়ের মেসেঞ্জারে এল, “কী রে সৌরভ তোর বরেরই তো”। বোনকে লেখা হল, “মজা পাচ্ছিলি?” নারীদের নিয়ে কথা বলা এই আপনারাই কই একবার ভাবলেন না তো নিজেদের দাদা সম্পর্কে এমন রটনায় আমার বোনটার কী অবস্থা। দিনের পর দিন আমার মায়ের ফেসবুকে একের পর এক নোংরা কমেন্টের প্রতিবাদ করতে তো দেখা গেল না আপনাদের। ইন্ডাস্ট্রি তো যৌথ পরিবার, হাতে গোনা কয়েক জন ছাড়া কাউকে পাশে পাইনি সেদিন। যাঁদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে লাঞ্চ করি, খাবার খাই, তাঁদের অনেককেই দেখেছিলাম মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে। অথচ ওঁরা তো আমায় চিনত ব্যক্তিগত ভাবে। জানত বোনের সঙ্গে ঠিক কী রকম সম্পর্ক আমার। কিন্তু না, চারিদিকে তখন পাশবিক উল্লাস, “ইয়ে আমরা ধরতে পেরেছি…”।

আমি অভিনেতা ক্যামেরা কখন চলে আর কখন চলে না তা আমি জানি। এতদিন চুপ ছিলাম, আজ বলছি, সত্যি যদি আমার বোনের সঙ্গে আপনাদের ভাষায় নোংরামি করার বাসনা হত ক্যামেরা চালিয়ে রাখতে বলতাম আমি! আর অপেক্ষা করতাম কখন সেটা ভাইরাল হবে…আর লোকে নোংরা কথা বলবে? ভাবুন। একটু ভেবে দেখবেন।

View this post on Instagram

A post shared by Saurav Das (@i_sauravdas)

ঘটনাটা ঘটে আমি ফোন বন্ধ রেখেছিলাম। হ্যাঁ, ভেঙে পড়েছিলাম আমি। কেউ ছিল না পাশে এক ওই পরিবার ছাড়া। মা ছাড়া। বাবা-বোন ছাড়া। ফ্যান ক্লাবের যে ছেলেগুলো আমার হয়ে কথা বলেছিল ওদেরকেও ডেকে ডেকে মারা হচ্ছিল। ঘটনার কয়েক দিন পর বাবা একটা মেসেজ করেছিল আমায়, “বুবান তুই একদম এ সবে কান দিস না, তুই শুধু তোর চরিত্রগুলোতেই মনটা দে। তোর এক একটা চরিত্র কিন্তু আমার এক এক বছর করে আয়ু বাড়ায়।” আর মা? আরও আগলে রেখেছিল সে সময়।

মা যদি সেদিন না আগলাত তাহলে হয়তো এত দিনে আমি সুশান্ত সিং রাজপুত হয়ে যেতাম। লোকে বলে না, ভীতুরা আত্মহত্যা করে, আমি ভীতু বলে আত্মহত্যা করতে পারিনি। এখনও মনে আছে, ওই সময় আমার ‘বার্নিং বাটারফ্লাই’য়ের শুট চলছিল। ছবিটা বের হলে দেখবেন ওখানে একটা শট আছে নয় মিনিটের । ওই শটটা দিতে গিয়ে সৌরভ দাসকে কোনও অভিনয় করতে হয়নি। বুকের ভিতর চলতে থাকা কান্না, রাগ, অভিমানের বের হয়ে এসেছিল। অনিন্দিতাকে মাঝেমধ্যে প্রশ্ন করতাম, “কী রে ঠিক আছিস”? ও এবং আমার মা– এই দু’জনের মনের জোরকে কুর্নিশ। ও বুঝতে দিত না কিচ্ছু। স্বাভাবিক গলায় আমাকে বলত, “কেন কী হবে আমার”? আর বোন, ঘটনার পর বেশ কিছু দিন সমানে ফোন করত দাদার গলাটা শোনার জন্য। ওর বোধহয় মনে হত নিজেকে শেষ করে দিতে পারি আমি। এমনও হয়েছে, আমি কাঁদছি, বোনু ফোন করেছে। ওকে তো বুঝতে দেওয়া যাবে না যে কাঁদছি। স্বাভাবিক গলায় বলতাম, “হ্যাঁ বল”। বোন নিশ্চিন্ত হত। দাদাটা ওর ঠিক আছে। বেঁচে আছে।

View this post on Instagram

A post shared by Saurav Das (@i_sauravdas)

একটা হাসিখুশি পরিবার, হঠাৎ করে শেষ হতে দেখেছেন? আমি দেখেছিলাম সে সময়। কিন্তু শেষ হয়ে ফুরিয়ে যায়নি যার জন্য সে আমার মা।মা না থাকলে ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম না আমি। খারাপ লেগেছে আমায় প্রশ্ন করুন। আমার দিকে আঙুল তুলুন। কিন্তু কথায় কথায় মায়েদের টেনে আনার প্রবণতা বন্ধ করুন। সে যার মা-ই হোন না কেন…আমার আপনার সবার…।

ও আর একটা কথা, অভিনেতারা অনেক সময়েই গ্লিসারিন ব্যবহার করেন কাঁদার জন্য। তবে এর পর থেকে কান্নার শট দিতে গিয়ে আমায় কোনওদিন গ্লিসারিন দিয়ে চোখে জল আনতে হবে না। ওই সব মানুষদের ধন্যবাদ আমায় আরও ভাল অভিনেতা বানিয়ে দেওয়ার জন্য। হাতে একটা ট্যাটু আছে আমার, “it’s better to burn out than fade away”… মুছে যায়নি সৌরভ দাস, যাবে না। পুড়ে যাব, ধ্বস্ত হব, কাঁদব… মুছে যাব না কখনই।