Tarun Majumdar Death: ‘আমায় ক্ষমা করবেন তরুণবাবু, আপনার গুরুত্ব আমি বুঝতে পারিনি সেদিন’

Tarun Majumdar: ঘটনাবহুল সকালে একজন সাংবাদিকের কাছে এই ব্যস্ততা স্বাভাবিক হলেও আজ আমার এত কষ্ট কেন হচ্ছে? উত্তর হাতড়াতে গিয়ে মনে পড়ল আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে যখন জীবন ছিল সাদামাঠা, ফ্রক আর পুতুল ছিল সঙ্গী, তখন এই মানুষটার সঙ্গেই তো টানা এক মাস কাটিয়েছি আমি।

Tarun Majumdar Death: 'আমায় ক্ষমা করবেন তরুণবাবু, আপনার গুরুত্ব আমি বুঝতে পারিনি সেদিন'
তরুণ মজুমদার
Follow Us:
| Updated on: Jul 09, 2022 | 7:11 PM

বিহঙ্গী বিশ্বাস 

ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ১১.১৭… অফিস থেকে নির্দেশ এল: ‘কপি ধরতে হবে’। তরুণবাবু নেই,  খবর এসে পৌঁছেছে সবেমাত্র। পেশাদারের মতো খুলে গেল ল্যাপটপ। ব্রেকিংয়ের তাগিদে প্রতিযোগী ওয়েবসাইটে চোখ বুলিয়ে নিয়েই তুলে ফেললাম ‘কপি’। ও দিকে তখন একের পর এক ফোন, রিঅ্যাকশন পর্ব… সবাই স্মৃতি ভাগ করছেন। কেউ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। আমি লিখে যাচ্ছি…। ব্রেকিং বড় দায়!

আমি বিহঙ্গী, TV9 বাংলার সাংবাদিক। ঘটনাবহুল সকালে একজন সাংবাদিকের কাছে এই ব্যস্ততা স্বাভাবিক হলেও আজ আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন? উত্তর হাতড়াতে গিয়ে মনে পড়ল আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে যখন জীবন ছিল সাদামাঠা, ফ্রক আর পুতুল ছিল সঙ্গী, তখন এই মানুষটার সঙ্গেই তো টানা এক মাস কাটিয়েছি আমি। কলকাতা থেকে বহুদূরে পলাশী গ্রামে। এই মানুষটিই তো হাতে করে ঠিক করে দিয়েছিলেন মেকআপ। পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, ‘দারুণ।’

আমি তখন ছয় বা মেরেকেটে সাত। সুপান্থকাকু (তরুণ মজুমদারের সহ-পরিচালক) এলেন বাড়িতে। দীর্ঘদিন থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত আমার বাবার সঙ্গে তাঁর আলাপ ছিল আগে থেকেই। বললেন, “মেয়েটাকে দিতে হবে। তরুণবাবু ছবি বানাচ্ছেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কিন্নর দল’ নিয়ে। ছবির নাম হবে ‘আলো’। দিবি?”বাবা রাজি হলেন। রাজি বললে ভুল বলা হবে, বেশ খুশিই হলেন। কে তরুণবাবু, তাঁর আবার কী ছবি… এ সব ওই ছয় বছরের মেয়েটির মাথায় ঢোকেনি সেদিন। সে শুধু বুঝেছিল পড়াশোনা থেকে কয়েকদিনের ছুটি পাওয়া যাবে। শিক্ষিকা-মা স্কুল থেকে ছুটি পায়নি। তাই বাবার সঙ্গেই বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে সে চলল বোলপুরের পলাশী গ্রামে।

শটের ফাঁকে

পৌঁছেই আলাপ হল এক  টুপি পরা  কৃষ্ণকায় মানুষের সঙ্গে। সাদামাঠা…অথচ লুকিয়ে রয়েছে এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য। বাবা বলল, ইনিই নাকি পরিচালক। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে বলায় মেয়েটি অক্ষরে-অক্ষরে মেনেছিল বাবার সেই নির্দেশ। দেখেই ‘সেই লোক’ বললেন, “এই যে… তুই-ই আমার পুঁটি”। ছবিতে গ্রামের এক মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। শাড়ি পরা ছোট্ট মেয়ে, পুষ্পিতা মুখোপাধ্যায় ছিলেন আমায় মায়ের চরিত্রে।

প্রথম দিন ক্যামেরার মুখোমুখি। নেপথ্যে দাঁড়িয়ে সবটা তদারকি করছেন মানুষটা। আমার মেক-আপের পর তাঁর কাছে নিয়ে যেতেই, মৃদু ধমক দিলেন মেক-আপ আর্টিস্টকে। বললেন, “এ কী করেছিস, দু’বেলা খেতে পায় না… সেই গ্রামের ধুলো মাখা মেয়ের চুল এত চকচকে?” বলেই মাটি থেকে এক খাবলা ধুলোমাটি তুলে আমার চুলে ভাল করে ঘষে দিলেন। আমি বেজায় রেগে গিয়েছিলাম। এত সাহস! আমার চুলে ধুলো দিয়ে দেয়। ঠোঁট ফুলিয়েই শেষ করেছিলাম প্রথম শট। চেয়ার থেকে উঠে এসে বাবার হাত ধরে ওই ধুলোমাখানো মানুষটা বলেছিলেন, “হবে ওর।” ওই দু’টো কথার গুরুত্ব সেদিন বুঝিনি।

এভাবেই চলল বেশ কিছুদিনের শুটিং শিডিউল। বকা খাইনি, বরং দাপিয়ে বেরিয়েছিলাম গোটা সেট জুড়েই। শহুরে আদব-কায়দায় অভ্যস্ত আমার কাছে পলাশীর ওই মেঠো পথ তখন যেন ‘স্বর্গের সিঁড়ি’। কিন্তু বিপদ ছিল ওঁত পেতেই। মুরগির বাচ্চা দেখে বেজায় আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম একদিন। কোলে নেব… এমন সময়েই মা মুরগি এসে আমায় দিল আঁচড়ে। খবর পেয়ে ছুটে আসে মিষ্টু আন্টিরা (মানসী সিনহা, যিনি নিজেও ‘আলো’তে অভিনয় করেন)। ছুটে আসেন ওই মানুষটিও। আমি যদিও লজ্জায়-ভয়ে একাকার হয়ে তখন হেসে ম্যানেজ দেওয়ার চেষ্টা করছি। তাকিয়ে বললেন, “লেগেছে?” আমি না-সূচক মাথা নাড়তেই বকা! “গালে দাগ নিয়ে বসে আছিস, এবার কন্টিনিউটি কী করে হবে সিনের”… সেদিন আমার শুট হয়নি মা মুরগির দাক্ষিণ্যে।

কাজের ফাঁকে 

কাটা দাগ মেলাতেই দু’দিন পর শুট হয়েছিল। ভাল ভাবেই উতরে গিয়েছিল শুটিং। আমার কাছে যদিও ওই কয়দিন ছিল ‘এসকেপ রুট’। বাড়ি ফিরেই বার্ষিক পরীক্ষা। ব্যস্ত হয়ে যাই নিজের জীবনে। আবার দেখা হয় ডাবিংয়ের সময়। কী পরিমাণ নিখুঁত একজন মানুষ হতে পারেন, তা সেদিন বুঝিনি… আজ বুঝি। ‘আলো’ মুক্তি পায়। সুপারহিট হয়। বন্ধুদের তখন আমায় নিয়ে কী উত্তেজনা। আর আমি দেখেছিলাম মিডিয়ার তাঁকে নিয়ে কী উন্মাদনা।

এর পর আর যোগাযোগ হয়নি। শুনেছিলাম ‘চাঁদের বাড়ি’র জন্য উনি আমার খোঁজ করেছেন সুপান্থকাকুর কাছে। বাবার কাছেও এসেছিল ফোন।   তখন আমি বেশ কিছুটা বড়। পড়ার চাপ বেড়েছে। যে স্কুলে পড়তাম সেই স্কুলেও মুচেলেকা দিতে হয়েছিল ওই স্কুলে পড়াকালীন আর কোনও ছবিতে কাজ করতে পারব না। কারণ তাতে আমায় নিয়ে বাকি ছাত্রীদের মধ্যে ‘কিউরিওসিটি’ হবে, হচ্ছেও…  জানিয়েছিল স্কুল।  আর সেদিকে এগোনো হয়নি।

কাট টু… আবার কথা হয় বছর খানেক আগে। আমি তখন নেমে পড়েছি জীবনের জটিল দৌড়ে। পেশাদার সাংবাদিক, ব্রেকিংয়ের তাগিদ ঘিরে রাখা মেয়েটির জীবনে তখন পলাশি, ‘আলো’, এ সবই নেহাত কোন এক ‘মহাভারত যুগে’র প্রায় ভুলে যাওয়া অধ্যায়। তবু ফোন করতেই পেশাগত কাজ মিটিয়ে আমার ওই ছয় বছর বয়সী পরিচয়টা দেওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি। খানিক থেমে উনি বলেছিলেন, “ওহ্, সেই মুরগির আঁচড় খাওয়া মেয়েটি তুমি?” আমার গা কাঁপছিল। শরীরে শিহরণ হচ্ছিল। উনি আমায় মনে রেখেছেন। কোন এক বিজ্ঞাপনে দেখেছিলাম ‘দাগ অচ্ছে হ্যায়’। এই কি তবে তার বাস্তব রূপায়ণ?

ওই ব্যস। আর কথা হয়নি। আর দেখাও হয়নি কোনওদিন। ভেবেছিলাম সুস্থ হলে ফোন করব। বলব, “আমিই সে আঁচড় খাওয়া পুঁটি।” কিন্তু সে আর হল কই? উনি চলে গেলেন। আমার মেয়েবেলার এক স্মৃতিও যেন দপ করে নিভে গেল আজই। তরুণবাবু, ওই বয়সে আমি বুঝতে পারিনি আপনার ব্যাপ্তি। বুঝতে পারিনি আপনি কে? কত বড় মাপের পরিচালক!  আমায় ক্ষমা করবেন তরুণবাবু। আমি যে আপনাকে চিনতেই পারিনি।