করোনা চেন ভাঙতে পারবে লকডাউন, কী হতে চলেছে বাংলার?

সুমন মহাপাত্র |

May 18, 2021 | 8:43 PM

মৃত্যু মিছিল কি রোখা যাবে? প্রশ্ন সেটাই। কারণ দেশের সার্বিক করোনা পরিস্থিতিও একই। দৈনিক সংক্রমণ নিম্নমুখী তবে মৃত্যু রেকর্ডের পথে।

করোনা চেন ভাঙতে পারবে লকডাউন, কী হতে চলেছে বাংলার?
গ্রাফিক্স- অভীক দেবনাথ

Follow Us

কলকাতা: করোনার (COVID 19) প্রথম ঢেউ যখন ভারতে আছড়ে পড়েছিল, তখনই ‘লকডাউন’ (Lockdown) শব্দটা প্রথম শিখেছিল ভারতীয়রা। কোয়ারেন্টাইন, হোম আইসোলেশন এই শব্দগুলি এরপর আসতে আসতে রোজনামচায় ঢুকে পড়েছে। গত বছরের লকডাউনের সেই বেদনাদায়ক স্মৃতি এখনও দগদগে। রুটি-চিনি খেয়ে খালি পেয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটেছিলেন পরিযায়ীরা। ট্রেনে চাপা পড়ে মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছিল স্রেফ বাড়ি যাওয়ার জন্য। এ বার যখন দ্বিতীয় ঢেউ আরও কয়েকগুণ শক্তি বৃদ্ধি করে হাজির, তখন কেন্দ্র লকডাউন ঘোষণা করেনি। জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “লকডাউন শেষ অস্ত্র।” সেই শেষ অস্ত্রই প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়েছে একাধিক রাজ্য। সংক্রমণ রুখতে লকডাউনের পথেই হেঁটেছে পশ্চিমবঙ্গও। কিন্তু লকডাউনের ফলে কি আদৌ মৃত্যু মিছিল ও রাজ্যে সংক্রমণ কমানো সম্ভব? কী ছবি দেখা যাচ্ছে আগে থেকে লকডাউন হয়ে থাকা রাজ্যগুলির?

মহারাষ্ট্র: করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সবচেয়ে বেশি ভেসেছে মহারাষ্ট্র। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তেই তড়িঘড়ি অবাধ বিচরণে আটকাতে উদ্যোগী হন মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে। ১৩ এপ্রিল করোনা কার্ফু জারি হয় মহারাষ্ট্রে। তার আগে থেকেই সে রাজ্যে জারি হয়েছিল নৈশ কার্ফু। করোনা কার্ফু কার্যত ‘মিনি লকডাউনের’ চেহারা নেয়। ৫ জনের বেশি জমায়ের বন্ধ হয়ে যায় ঠাকরে রাজ্যে। পাশাপাশি চালু হয় ই-পাসের মাধ্যমে যাতায়াত। বিপুল পরিমাণে কমে যায় গণপরিবহন। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিক্রির জন্য নির্ধারিত নয় নির্দিষ্ট সময়। লাগাতার একমাস এই লকডাউন কায়েম থাকায় অনেকাংশেই কমেছে দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। ১৩ এপ্রিল মিনি লকডাউনে শুরুর দিন সে রাজ্যে দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬০ হাজার ২১২। মৃত্যু হয়েছিল ২৮১ জনের। লাগাতার বিধি-নিষেধের ফলে ১৭ মে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যাটা ২৬ হাজার ২১৬। অর্থাৎ অর্ধেকেরও কম। এক ধাক্বায় কমেছে সক্রিয় করোনা আক্রান্তের সংখ্যাও। অর্থাৎ দ্রুত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন অনেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন বৃহন্মুম্বই মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের সু-ব্যবস্থা। সঠিক ট্রেকিং-ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ কমিয়ে ফেলায় ‘মডেল’ হয়ে উঠেছে মহারাষ্ট্র। কিন্তু এতকিছুর পরেও কমানো যাচ্ছে না মৃত্যু মিছিল। ১৭ মে সে রাজ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার জন। অর্থাৎ লকডাউন কায়েম হওয়ার ৩ গুণ। যেখান থেকে স্পষ্ট বলা যায়, লকডাউন করে আক্রান্তের সংখ্যায় বেড়ি পরানো গেলেও লাগাতার বেড়েছে মৃতের সংখ্যা। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা দ্বিতীয় ঢেউয়ে দ্রুত শারীরিক অবনতি হচ্ছে আক্রান্তের তার জন্যই বাড়ছে মৃত্যু-মিছিল।

মহারাষ্ট্রের করোনা গ্রাফ

দিল্লি: মহারাষ্ট্রের পর করোনায় চূড়ান্ত বিধ্বস্ত হয়েছিল দিল্লি। লাগাতার বাড়ছিল সংক্রমণ। এই পরিস্থিতিতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যায় দ্রুত রাশ টানতে রাজধানীতে ১৯ এপ্রিল সম্পূর্ণ লকডাউন কায়েম করেন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল। ১ সপ্তাহের জন্য জারি হওয়া সেই লকডাউন এরপর লাগাতার বেড়েছে যা আপাতত ২৪ মে পর্যন্ত জারি থাকবে বলে জানিয়েছেন কেজরীবাল। লকডাউনের সুফল হাতেনাতে পেয়েছে রাজধানী। ১৯ এপ্রিল দিল্লিতে দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ৩৮৬। করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ২৪০ জন। লাগাতার লকডাউনের জেরে একমাস ঘুরতে না ঘুরতেই রাজধানীতে দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে ৪ হাজারের ঘরে নেমে গিয়েছে। তবে এখানেও কমেনি মৃত্যু। ১৭ মে দিল্লিতে ৩৪০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। যা লকডাউন হওয়ার আগের থেকেও বেশি। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের দাবি মৃত্যু গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার অন্যতম কারণ দিল্লির স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় গাফিলতি। কারণ একাধিকবার প্রকাশ্যে এসেছে দিল্লির অক্সিজেন সঙ্কট। যা নিয়ে বারবার দিল্লি হাইকোর্টের ভর্ৎসনার মুখে পড়েছে কেন্দ্র ও কেজরীবালের সরকার। বিশেষজ্ঞদের মতে সে কারণেই দিল্লিতে আক্রান্তের সংখ্যা ৫ গুণ কমলেও কমেনি মৃত্যু।

দিল্লির করোনা গ্রাফ

উত্তর প্রদেশ: সবে ১৫ দিন হয়েছে উত্তর প্রদেশের লকডাউন। তাতেই যোগীরাজ্যে কয়েকগুণ কমে গিয়েছে দৈনিক সংক্রমণ। ২মে লকডাউন কায়েম হওয়ার দিন সে রাজ্যে দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩০ হাজারের বেশি, মৃত্যু হয়েছিল ২৮৮ জনের। স্রেফ ১৫ দিনের কড়া লকডাউনেই উত্তর প্রদেশের দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা এখন ১০ হাজারের নীচে। ১৭ মে সে রাজ্যে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন স্রেফ ৯ হাজার ৩৪৫ জন। মৃত্যু হারও কিছুটা কমেছে। ১৭ মে সে রাজ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ২৭১ জন। যদিও উত্তর প্রদেশে গঙ্গায় মৃতদেহ ভাসতে দেখা যাওয়ার পর বিরোধীদের অভিযোগ মৃতের সংখ্যা লুকিয়ে রাখছে এই রাজ্য।

ঝাড়খণ্ড: ২২ এপ্রিল লকডাউন ঘোষণা করেন ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন। সে দিন সে রাজ্যে দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ৫৯৫। মৃত্যু হয়েছিল ১০৬ জনের। এরপর আক্রান্ত ও মৃতের গ্রাফ কয়েকদিন ওপরের দিকে উঠলেও আসতে আসতে নিম্নমুখী হয়েছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। ১৭ মে সে রাজ্যে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন স্রেফ ২ হাজার ৫০৭ জন। মৃত্যু হয়েছে ৬০ জনের। লকডাউনে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যু দুটোই কমাতে পেরেছে হেমন্ত সোরেনের রাজ্য।

কেরল: কেরলে বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে। লাগাতার নির্বাচনী প্রচারে অনুকূল পরিবেশ পেয়ে সে রাজ্যে করোনা বৃদ্ধির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। আর সেই সুযোগে বেড়েছে করোনাও। নির্বাচনের পরে ২৯ এপ্রিল লকডাউন ঘোষণা করে কেরল। সে দিন সে রাজ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪১ হাজার ৯৭১। প্রাণ হারিয়েছিলেন ৪৮ জন। দেশের মধ্যে করোনায় মৃতের হার যেসব রাজ্যগুলির কম, তার মধ্যে অন্যতম কেরল। লকডাউন কায়েম হওয়ার পরে সে রাজ্যে দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কমেছে। কিন্তু মৃত্যুর গ্রাফ অল্প হলেও ওপরে উঠেছে। ১৭ মে সে রাজ্যে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ২১ হাজার ৪০২ জন। মৃত্যু হয়ছে ৮৭ জনের।

কেরলের করোনা গ্রাফ

হরিয়ানা: হরিয়ানাতে লকডাউন জারি হয় ২ মে। সে দিন সে রাজ্যে দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৩২২, মৃত্যু হয়েছিল ১৪৫ জনের। এরপর লাগাতার লকডাউনের ফলে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কমতে থাকে হরিয়ানায়। ১৭ মে সে রাজ্যে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৮৮ জন। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক হয়েছে দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্য। কিন্তু এই নিম্নগমন দেখা যায়নি মৃত্যুর ক্ষেত্রে। কার্যত একই সরলরেখায় মৃত্যুর গ্রাফ। ১৭ মে সে রাজ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে। ১১৪ জনের।

জম্মু ও কাশ্মীর: ওপরের অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় লকডাউনের সঙ্গে দৈনিক করোনা আক্রান্তের কার্যত ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক দেখা গিয়েছে জম্মু কাশ্মীরে। এখানে ২৯ এপ্রিল লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পরও লাগাতার বেড়েছে সংক্রমণ। যদিও ১০ মে-এর পর থেকে কিছুটা হলেও কমতে শুরু করেছে সংক্রমণ। ২৯ এপ্রিল সেখানে দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৪৭৪, মৃত্যু হয়েছিল ২৬ জনের। লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পর ৯ মে সংখ্যাটা ৫ হাজারও পার করে ফেলেছিল। এরপর অবশ্য নিম্নমুখী হয় গ্রাফ। এখন ১৭ মে সেখানে দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৩ হাজার ৪৪৪। মৃত্যু হয়েছে ৭৩ জনের। অর্থাৎ মৃত্যু রোখা যানি সেখানেও।

পশ্চিমবঙ্গের করোনা গ্রাফ

পশ্চিমবঙ্গ: আট দফায় নির্বাচন হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। অগণিত রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বরা চষে ফেলেছেন গোটা বাংলা। ঠাসাঠাসি ভিড়ে লাফিয়ে বেড়েছে পশ্চিমবঙ্গে করোনা। এক মাসের গ্রাফ দেখলেই বিষয়টা স্পষ্ট। ১৮ এপ্রিল এ রাজ্যে দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৪১৯। প্রাণ হারিয়েছিলেন ২৮ জন। এরপর লাগাতার প্রচারে লাফিয়ে বেড়েছে মারণ ভাইরাস। ১৬ মে যখন রাজ্যে কার্যত লকডাউন কায়েম হচ্ছে দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যাটা ১৯ হাজার ১১৭। মাঝে ২০ হাজারও টপকেছে দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। বেড়েছে মৃত্যুও। ১৮ এপ্রিল রাজ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ২৮ জন। ১৬ মে সংখ্যাটা ১৪৭। রাজ্যের মুখ্যসচিব লকডাউন ঘোষণার পর থেকে মিষ্টি দোকান বাদে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দোকান খোলা স্রেফ ৭টা থেকে ১০টা। বন্ধ গণপরিবহণ। ১৪ দিনের এই লকডাউনে অন্যান্য রাজ্যের মতো এখানেও দৈনিক সংক্রমণ কমার আশা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু মৃত্যু মিছিল কি রোখা যাবে? প্রশ্ন সেটাই। কারণ দেশের সার্বিক করোনা পরিস্থিতিও একই। দৈনিক সংক্রমণ নিম্নমুখী তবে মৃত্যু রেকর্ডের পথে।

আরও পড়ুন: দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা নিম্নমুখী হলেও একদিনেই ৪৩২৯ জনের মৃত্যুতে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড দেশে

Next Article