অগুনতি ক্যামেরার ফ্ল্যাসের ঝলকানি। সারা দেশ সেই রাতে টিভির সামনে বসে চিনেছিল এক বিদ্রোহিনীকে। আর দুর্গাপুরের মানুষ অবাক হয়ে দেখেছিল তাঁদের ছোট্ট মেয়েটা রাতারাতি কীভাবে বড় হয়ে গিয়েছে। মাথায় বাঁধা ব্যান্ডেজ নিয়েই দৃঢ়তার সঙ্গে সে আন্দোলন, সংহতির বিষয়ে কথা বলে যাচ্ছিল। ছাত্র রাজনীতির চৌহদ্দি পেরিয়ে ক্রমশ তার কথার বিষয় হয়ে উঠল মানুষের পাওয়া, না পাওয়া, দাবি দাওয়া…বৃহত্তর রাজনীতিতে আগমন ঘটল তার। ঐশী ঘোষের(Aishe Ghosh) এই পরিবর্ধিত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার কথা শুনল TV9 বাংলা ডিজিটাল
৫ জানুয়ারি। জেএনইউ ক্যাম্পাস। তারপর জীবন কতটা বদলে গেল?
জীবন বদলানোর কিছু নেই। ৫ জানুয়ারির হামলা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ৮০ দিনের লড়াই ওইদিন চূড়ান্ত আকার নেয় বলা যেতে পারে। অক্টোবর মাসে একটা হোস্টেল ম্যানুয়েল আসে। ফিজ হাইক থেকে ইউটিলিটি চার্জ। কোত্থেকে পাবে পড়ুয়ারা? শুধু জেএনইউ(JNU) নয়, গোটা সিস্টেমটাকে নিয়েই আমরা আন্দোলন শুরু করি। জেএনইউ (JNU) সেখানে একটা মঞ্চ হয়েছিল।
আচ্ছা বলতে পারেন, যত বিপ্লব কেন জেএনইউ-তেই হয়?
এখানে একটা বিষয় আমি অবশ্যই উল্লেখ করব। পন্ডিচেরি ইউনিভার্সিটি বা দুর্গাপুর কলেজে কি আন্দোলন হচ্ছে না? প্রতিবাদ হচ্ছে না? হচ্ছে। বরং জোরদার হচ্ছে। কিন্তু, মিডিয়া তা প্রকাশ করে না। কারণ, তাদেরও নিজস্ব মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি আছে। আমি একদমই চাই না জেএনইউ(JNU) বা যাদবপুর(JU) রোল মডেল হোক। সেইজন্যেই আমরা আমাদের মুভমেন্টটা একটা সর্বভারতীয় আন্দেলনে পরিণত করতে চেয়েছিলাম।
ক্যাম্পাসে এমন হামলা হতে পারে এমনটা কখনও ভাবতে পেরেছিলে?
দেখুন, পাঁচ তারিখের হামলাটা পূর্বপরিকল্পিত। বিজেপির কিছু ভাড়া করা গুন্ডারা ক্যাম্পাসে এসে ছাত্র পিটিয়ে গেল। ভিসি বা পুলিস কেবল দর্শক! পরে যখন এফআইআর করাতে যাই তখনও থানায় ডাইরি নিতে চায়নি। আমাদের দাবির কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, আমাদের সুরক্ষার সামান্য ব্যবস্থা করতেও অক্ষম ছিল কর্তৃপক্ষ।
সেই রাতের পর অনেক তারকাকেই পাশে পেয়েছিলেন। কিন্তু যাঁর উপস্থিতি ঘিরে চাঞ্চল্য ও বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, তিনি সাতে পাঁচে না থাকা দীপিকা পাড়ুকোন। এ ব্যাপারে আপনার কী বক্তব্য?
আগেই বলেছি, জেএনইউ-এর(JNU) আন্দোলন কেবল ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক নয়। কখনোই ছিল না। আমাদের ক্যাম্পাসে হামালার দিন পনেরো আগে জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা হয়। ওদের দোষও একই। মুখ বুজে সহ্য না করা। প্রতিবাদের প্রতিক্রিয়া যে অ্যাসিড বালব আর লাঠিপেটা, এটা বোধহয় ভবিষ্যতের ছবি। সেইজন্যেই ক্যম্পাসে ঢুকে পেটানো সহজ। আর যাঁরা এই অবিচারের কথা বুঝেছেন, তাঁরাই এসেছেন। দীপিকাকেও (Deepika Pdukone) আমি এর বাইরে দেখি না।
অন্যান্য তারকারা নানা মন্তব্য করেছেন। কিন্তু দীপিকা এলেন, দাঁড়ালেন, চলে গেলেন। একটা শব্দও খরচ করলেন না। একটু অস্বাভাবিক নয়?
একদমই নয়। প্রথমত, দীপিকা (Deepika Padukone) আসবেন এটাই আমরা জানতাম না। দীপিকা এখানে আসার আগে বা পরে, কখনোই মুখ খোলেননি এ বিষয়ে। স্বাভাবিক, তাঁর মতো বলিউডের প্রথম সারির তারকা যদি আসেন তবে বিতর্ক হবেই। আর তা শুরুও হয়েছিল। টুইটারে ‘#বয়কট ছপক’ বা ‘#বয়কট দীপিকা’-র মতো ট্রেন্ডও শুরু হয়েছিল। খাপ পঞ্চায়েত বসানোর সুযোগ পেলে দীপিকা হোন বা অন্য কেউ, কাউকেই রেয়াত করে না আমাদের মাননীয় সরকার। আর নিন্দা যাঁদের করার, তাঁরা করবেনই। তাঁর ব্যক্তিগত কোনও ইস্যু ছিল কি না তা আমাদের কাছে অপ্রয়োজনীয়। অন্যায় হয়েছে। বুঝেছেন। অন্যদের মতো এসেছেন। সলিডারিটি চেয়েছেন। ব্যস।
আরও পড়ুন : ১২ বছরের আগে একটি শহরের মৃত্যুর গল্প! আজও শিউরে ওঠে দেশবাসী
জেএনইউ-এর সেই রাতই আপনাকে এক ঝটকায় ক্যাম্পাস থেকে মূল স্রোতের রাজনীতিতে নিয়ে এল। এই বড় জগৎটায় অভিজ্ঞতা কেমন?
সত্যি বলতে, না এলে মিস করতাম। অনেক কিছু শিখতে পারতাম না। গ্রাউন্ড লেভেলে, মাটির কাছাকাছি কীভাবে কাজ হয় তা বুঝতে গেলে মাটির কাছেই যাওয়া প্রয়োজন। এসি ঘরে বা ক্যামেরার ঝলকানিতে বোঝা সম্ভব নয়। মানুষের যে সাধারণ চাহিদাগুলোই এতদিন পূরণ হয়নি তা স্পষ্ট। রেশন , শিক্ষা ,ঘর , চাকরি। চাহিদা যৎসামান্য ওদের।
ছাত্র রাজনীতি থেকে বৃহত্তর রাজনীতিতে আসা ঐশী ঘোষ কি আগামী দিনে নির্বাচনে লড়বেন?
(হাসি) সেটা তো আমি বলার কেউ নই। মানুষ যা চাইবেন। তাঁরা চাইলেই হবে। তাছাড়া, মুখ হওয়ার চেয়েও জরুরি, কাজ করা। মানুষের পাশে থাকা। সেখানে কোনও ভোট নেই। শুধুই কাজ।
বিহারের প্রচারে গিয়ে কানহাইয়াকে তো অনেকটা সময় কাছ থেকে দেখেছেন। কী বুঝলেন?
কানহাইয়া ভাল বক্তা তো বটেই, মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষও বটে। তাই বোঝেন অনেক বেশি।
কিন্তু, এত বুঝেও তো হেরে গেল! এমনকী বিজেপি ওই কেন্দ্রে ভোট বাড়াল!
কানহাইয়াকে ওরা ভোটে হারাতে পেরেছিল, কিন্তু উপেক্ষা করতে পারেনি। তখন কানহাইয়া সদ্য কলেজ পাস আউট, অভিজ্ঞতার অভাব ছিল। ওরা টাকা খাইয়েই হোক বা ভয় দেখিয়ে কানহাইয়াকে হারাতে সব শক্তি লাগিয়েছিল। তবু মনে রাখবেন, কানহাইয়া কোনও একটি মানুষ নন। অনেকগুলো মানুষের কণ্ঠস্বর। কানহাইয়া জিতলে যে অনেকগুলি প্রশ্ন জিতে যাবে। সাধারণ মুখ জিতে যাবে! তা কী করে হয়? এ সরকার যে প্রতিপক্ষ চায় না। ওদের প্রতিপক্ষ ওরা নিজেরাই। নরেন্দ্র মোদী। একটিই মুখ। একটিই নাম। এতগুলো মুখের কখনও একটা চেহারা হতে পারে?
আরও পড়ুন : সোনাগাছিতে লাফিয়ে বাড়ল যৌনকর্মীর সংখ্যা! কেন এমন হল?
আচ্ছা, কানহাইয়া যদি বহুজনের স্বর হতে পারেন তাহলে মোদী নন কেন?
বহুজনের হয়ে কথা পৌঁছে দেওয়া আর বহুজন হওয়া, দুটো কি এক? ‘আমিই সরকার। আমিই দশ। আমিই দেশ।’ ইজ ইক্যুয়াল টু মোদীজী। যত না কাজ হয়েছে, হাটেবাজারে তার চেয়ে বড় কাটআউট আছে আমাদের মহামান্য প্রধানমন্ত্রীর।
জেএনইউ গোটা পাবলিক এডুকেশন সিস্টেমকে প্রশ্ন করতে পারে?
অবশ্যই। ওই যে বললাম জেএনইউ শুধু মঞ্চ। আসলে মডেল ইন্সটিটিউশন বলতে আছে যাদবপুর, জেএনইউ, দিল্লির মতো হাতগোনা কিছু ইউনিভার্সিটি। যেখানে এখনও কম খরচে পড়ানো হয়। সব ধরনের ছেলেমেয়েরা আসে। বাকি আর প্রায় নিখরচায় পড়ার সুযোগ কোথায় পায় ভারতীয়রা?
নয়া শিক্ষা নীতি প্রসঙ্গে কী বলবেন? ভিন দেশি বিশ্ববিদ্যালয় আসছে তো…
শিক্ষা তো আর শিক্ষা নেই। বাজারি পণ্য। আমরা সবাই জানি জাতীয় শিক্ষানীতি বা এনইপির কথা। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের টোপ দিয়ে যে লগ্নিকরণ করা হচ্ছে , তাতে তো ডক্টরেট বা গবেষণার কোনও মূল্যই থাকবে না। শিক্ষা তখন তাদের জন্যই কেবল বরাদ্দ হবে, যারা ক্ষমতাবান। তোমার -আমার মতো সাধারণ বা এসসি, এসটিদের মতো নিম্নমধ্যবিত্তদের কোনও জায়গাই থাকবে না।
আরও পড়ুন : আমি শ্রী মদন গোপাল মিত্র…
কেন, ‘বেটি বাঁচাও ,বেটি পড়াও’-এর মত যোজনা তো আছে?
চালু হয়েছে। কাজ হয়েছে কতটুকু? সবার জন্য শিক্ষা কই? এমআইটির মতো প্রাইভেট কলেজ গুলোতে সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা বা ফার্স্ট লার্নাররা পড়ার সুযোগ পাবে?
আজ যখন ফিরে তাকান, ক্যাম্পাসের ওই ভয়াবহ রাত, আপনার মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে প্লাস্টার। নিজের সেই ছবিটা দেখে কী মনে হয়?
না, আলাদা করে কিছু মনে হয় না। আমি একা নয়, আমার অনেক বন্ধুরাও মার খেয়েছে। অনেকেই আহত হয়েছে। জামিয়া মিলিয়ায় পুলিসের লাঠিচার্জের কথাই ধরো। কে বলেছে আমি একা মার খেয়েছি! আগেও বলেছি, আমাদের মিডিয়ায় যেভাবে যা দেখানো হয় তা বরাবরই আংশিক সত্য। বাস্তবটা আদৌ তা নয়। সব জায়াগাতেই পড়ুয়ারা বিরোধিতা করেছে। কিন্তু নজরে এসেছে কম। আমরা জানতাম, আমাদের উপর হামলা হবে। কিন্তু আমরা চুপ করে থাকব না। এটা শিখেই এগিয়েছি। শুধু কর্তৃপক্ষের নীরব ভূমিকা দেখেই আমরা হতবাক।
এই যে আপনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে এলেন, বাড়িতে মা-বাবার চিন্তা হয় না?
হ্যাঁ, মা-বাবা তো। তাঁরা চিন্তা করেনই। করবেনও। ৫ জানুয়ারির পর যখন বাড়ি ফিরি তখন মা-বাবা থেকে শুরু করে আশেপাশের সবাই একটা কথাই বার বার বলত। শুধু মাত্র হোস্টেল ইস্যুকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে ঢুকে পিটিয়ে গেল! তবে আগে ভয় পেতেন বাড়ির লোক। এখন সহজ হয়ে গেছে।
মা-বাবা কি তবে বুঝে গিয়েছেন যে তাঁদের মেয়ে আর ক্যাম্পাসের ছাত্রী নেই, বরং অনেক মানুষের গলার স্বর?
(হাসি) অনেক মানুষের গলার স্বর কি না জানি না। তবে হ্যাঁ, তাঁরা বুঝেছেন আমি ছেড়ে কথা বলি না। বলব না। অন্যায় দেখলে রুখে দাঁড়াবই। বাধা পেয়েছি। মতবিরোধও হয়েছে। কিন্তু হার মানিনি। এটাই তো জীবনের চ্যালেঞ্জ।
আরও পড়ুন : মদন মিত্রের স্ট্রাইকারই তো আমাদের ক্যাপ্টেন: অর্জুন