বাঙালির নেতৃত্বে তৈরি দেশি ‘ব্রহ্মাস্ত্র’, আরও নিখুঁত পূর্বাভাস দেবে ‘ভারত’
আবহাওয়ার নিখুঁত পূর্বাভাস দিতে বিদেশি গাণিতিক মডেলের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার দিন শেষ। এবার মগজও দেশি, মডেলও দেশি। এবং উন্নত। এতদিন ব্লক স্তরের পূর্বাভাস দেওয়া যেত, এবার পঞ্চায়েত স্তরের নিখুঁত পূর্বাভাসও দিতে পারবে মৌসম ভবন।

আকাশতির, অগ্নিকা, ব্রহ্মস। চিরশত্রু পাকিস্তানকে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র শক্তি টের পাইয়েছে ভারত। দেশি আকাশেই রক্ষা পেয়েছে দেশের আকাশ। এ বার আকাশকে হাতের তালুর মতো চিনতেও হাতিয়ার দেশি ‘অস্ত্র’। আবহাওয়ার নিখুঁত পূর্বাভাস দিতে বিদেশি গাণিতিক মডেলের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার দিন শেষ। এবার মগজও দেশি, মডেলও দেশি। এবং উন্নত। এতদিন ব্লক স্তরের পূর্বাভাস দেওয়া যেত, এবার পঞ্চায়েত স্তরের নিখুঁত পূর্বাভাসও দিতে পারবে মৌসম ভবন। সোমবারই যাত্রা শুরু হয়ে যাচ্ছে ‘ভারত ফোরকাস্টিং মডেল’-এর। যার নেপথ্যে বাঙালি বিজ্ঞানী পার্থসারথি মুখোপাধ্যায় ও তাঁর টিম।
কী আছে এই ‘ভারত’-এ, যা নেই ভূভারতে?
আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে আবহবিজ্ঞানীরা নিউমেরিক্যাল ওয়েদার প্রেডিকশন মডেলের উপর ভরসা করেন। সেই মডেলেই দেশের বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করে পূর্বাভাস দেয় মৌসম ভবন। এত দিন বিদেশি মডেল -‘দত্তক’ নিয়েই চালাতে হয়েছে ভারতকে। নিজেদের প্রয়োজনে কিছুটা মাজাঘষা করে নিতে হয়েছে, এটুকুই। ভারত ফোরকাস্টিং সিস্টেম পুরোপুরি ভারতীয়। বাঙালির বিজ্ঞানীর নেতৃত্বে ভারতেই তৈরি হয়েছে, পুণের ‘গবেষণাগার’ ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেটেরোলজিতে। ২০১৮ সাল থেকে গবেষণার প্রথম ধাপের কাজ হয়েছিল। ২০২২ সাল থেকে পরীক্ষামূলক কাজ হয়েছে পুণেয়। এ বার পাকাপাকি কাজে লাগানোর অপেক্ষা।
জলবায়ু বিজ্ঞানী পার্থসারথির কথায়, ‘‘আবহাওয়ার মতিগতি একেবারে ঠিক নেই। প্রাকৃতিক বিপর্যয় বাড়ছে। এই অবস্থায় যত আগে পূর্বাভাস দেওয়া যাবে, তত ক্ষয়ক্ষতি বাঁচানো যাবে। কিন্তু আগে বললেই হবে না, ঠিকটাই বলতে হবে, ভুল বললে চলবে না।’’ দেশি মডেল এখানেই সহায়ক হয়ে উঠবে। পার্থসারথির ব্যাখ্যা, ‘‘এখনও পর্যন্ত দুনিয়ায় যা গাণিতিক মডেল রয়েছে, সর্বোচ্চ ১২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত পূর্বাভাস দেওয়া যেত। আমাদের মডেলে ৬ বর্গকিলোমিটার এলাকারও পূর্বাভাস দেওয়া যাবে।’’
ইদানীং আবহাওয়ার যা খামখেয়ালিপনা, তাতে ছোট অঞ্চলের পূর্বাভাস বিশেষ জরুরি হয়ে উঠছে। একে ক্রান্তীয় অঞ্চল, তার উপর জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে প্রকৃতি আরও খ্যাপা হয়ে উঠছে। বিশেষত বৃষ্টিপাতের ধরনে বড়সড় পরিবর্তন হচ্ছে। টানা শুখা-পর্বের পর আচমকা অল্প সময়ে অতিবৃষ্টি হচ্ছে। চলতি মাসেই ১২ ঘণ্টায় ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে বেঙ্গালুরুতে। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল টেকসিটির জনজীবন। গোয়ার মাপুসায় একদিনে বৃষ্টি হয়েছে ২০২ মিলিমিটার। দেশে বর্ষা ঢুকে পড়েছে, এরকম চরম ভারী বর্ষণের ঘটনা আরও হওয়ার আশঙ্কা। এমতাবস্থায় অনেক আগে পূর্বাভাস জরুরি, জরুরি নিখুঁত ইঙ্গিত। জলবায়ু বিজ্ঞানী পার্থসারথির কথায়, ‘‘২০২২ সালের ২২ অগাস্ট মধ্যপ্রদেশে ভারী, অতি ভারী বৃষ্টি হয়েছিল। সেসময় আমাদের মডেল পরীক্ষামূলক ভাবে চলছিল। পাঁচ দিন আগে থেকেই আমরা টের পাই, মধ্যপ্রদেশে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া হতে চলেছে। অন্য মডেলে সেই আঁচ আমরা পেয়েছিলাম অনেক পরে।’’ এই ধরনের বৃষ্টিবাদলার ইঙ্গিত পেতে জলীয় বাষ্প পরিমাণ যথাযথ বোঝা দরকার, সেই তথ্যের জোগানও এই মডেল নির্ভুল ভাবে দিতে পারে।
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ঘূর্ণিঝড়ের নিখুঁত পূর্বাভাস দিচ্ছে মৌসম ভবন। সামান্য যেটুকু ‘এরর’ রয়েছে, সেই খুঁতও মুছে ফেলবে ভারত ফোরকাস্টিং সিস্টেম, আশায় আবহবিদরা। ২০২৩ সালের উদাহরণ টেনে পার্থসারথি বলছেন, ‘‘আরব সাগরের ঘূর্ণিঝড় বিপর্যয় যে বাঁক নিয়ে গুজরাত উপকূলের কাছে সরে আসবে, তা আর পাঁচটা মডেলের অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলাম আমরা।’’
ভারত ফোরকাস্টিং মডেলের এই ‘ক্ষমতা’ই সোমবার থেকে কাজে লাগাবে মৌসম ভবন। নতুন সুপার কম্পিউটারে নতুন মডেল ইনস্টল হয়েছে। আপাতত ‘ভার্সন ওয়ান’। অর্থাৎ, আরও আপডেটের সুযোগ থাকছে। এ বার দুনিয়াও ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর মুখাপেক্ষী হবে, আশায় বিজ্ঞানীরা।
