নয়া দিল্লি : ভারতীয় বিজ্ঞাপনে নতুনত্ব ভাবনা এনে বরাবরই মন কড়েছে ফেভিকল। বহু ইতিহাস পেরিয়ে ফেভিকল একটি স্বনামধন্য ব্র্যান্ড। পিডিলাইট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর অন্তর্গত ব্র্যান্ড হল ফেভিকল। বাজারে গিয়ে লোককে আঠা কম, একটা ফেভিকল দিন বলতেই শোনা যায়। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্র্যান্ড হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে ফেভিকল। আঠাকে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে গড়ে তোলার পিছনে যাঁর নাম জ্বলজ্বল করছে তিনি হলেন ভারতের ‘ফেভিকল ম্যান’ বলবন্ত পারেখ।
বলবন্তের প্রথম জীবন
গুজরাতের ভাবনগর জেলার মাহুবা গ্রামে ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন ভারতের ‘ফেবিকল ম্যান’। জৈন পরিবারের সন্তান বলবন্ত পারেখ। তাঁর ঠাকুরদা ছিলেন এলাকার স্বনামধন্য আইনজীবী। বলবন্তের বাবা চেয়েছিলেন তাঁর বাবার মতো ছেলেও এই পেশাকে নিয়েই এগিয়ে যাবেন। কিন্তু সে পথে চলা শুরু হলেও মাঝ পথেই থেমে যায় বলবন্তের। বাবার কথায় আইন নিয়ে পড়াশোনা করতে মুম্বইয়ের একটি সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু পড়াশোনা মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছিলেন। বরাবরই সত্যের পূজারী ছিলেন এই ‘ফেভিকল ম্যান’। তাই আইনজীবীর পেশার সঙ্গে জড়িত মিথ্যের ঝুড়ির বোঝা নিতে পারেননি তিনি। দ্বিতীয়বারের জন্য পড়াশোনা শেষ করতে গুজরাত থেকে মুম্বই ফিরলেও আইনের ডিগ্রি তাঁর নামের আগে জোড়েনি।
যৌবনে ভারত ছাড়ো আন্দোলন
যৌবনে রাজনীতি, আন্দোলন সবার রক্তে থাকে। বলবন্তেরও ছিল। ভারত তখনও স্বাধীন হয়নি। ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খলে বারবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠছেন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। এর মধ্যেই মুম্বইতে আইন নিয়ে পড়তে গিয়ে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন বলবন্ত। পড়াশোনা শেষ না করেই গ্রামে ফিরে এসেছিলেন। সেখানে দেশের স্বাধীনতার উদ্দেশে তিনি বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মে যোগ দেন। পরে আবার মুম্বই ফিরে যান।
আইনের কোট খুলে রাতারাতি বেকার
বেকার থাকবেন কিন্তু মিথ্যে বলবেন না। আইনজীবীর মতো সম্মানজনক পেশা ত্যাগ করে বেকার হতে দু’বার ভাবেননি তিনি। হাতে কোনও চাকরি নেই। মাথার উপর ছিল না কোনও ছাদ। এই অবস্থায় তিনি বিয়ে করেন কান্তাবেনকে। চরম আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে কেটেছে তাঁর দৈনন্দিন জীবন। তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে গুদামে থাকতেও শুরু করেন তিনি। সংসার চালাতে বেছে নেন পিওনের চাকরিও।
তাঁর মনে ছিল ব্যবসা
বলবন্তের ব্যবসায়ী মন তাঁকে কোনও চাকরিতে স্থায়ী হতে দেয়নি। শেষ পর্যন্ত পিওনের চাকরিও ছেড়ে দেন তিনি। এর মাঝে জার্মানি যাওয়ার সুযোগ পান। সেখানে তিনি ব্যবসার বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল শিখে আসেন। তার পর এক বন্ধুর সাহায্যে বিদেশ থেকে সাইকেল, পেপার ডাই আমদানি করে সেটা নিয়েই ছোটোখাটো ব্যবসা শুরু করেন। এরপর ১৯৫৯ সালে তাঁর স্বপ্নের সংস্থা পিডিলাইট তৈরি হয়। এই সংস্থার অন্যতম উৎপাদন হল ফেভিকল। একটি ব্র্যান্ড নিয়ে ব্যবসা শুরু আসতে এমসিল, ফেভিকুইক, ফেভিক্রিল অ্যাক্রিলিক রং-সহ ২০০ টিরও বেশি জিনিস বিক্রি হয় পিডিলাইটের ছাতার তলায়। পিডিলাইট সংস্থার ফেভিকলের শক্তির গল্প ভারতীয়দের ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। এবং তা করতে সাহায্য করে অনন্য উপায়ে ফেভিকলের টেলিভিশন বিজ্ঞাপন। ধীরে ধীরে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও পৌঁছে যায় পিডিলাইট। আমেরিকা, তাইল্যান্ড, দুবাই, মিশর ও বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করে পিডিলাইট সংস্থা। সিঙ্গাপুরে একটি গবেষণা কেন্দ্রও তৈরি করেছে এই সংস্থা।
বলবন্তের সমাজ-দর্শন
শুধুমাত্র ব্যবসায়ী হিসেবে নয়। সমাজের বিভিন্ন দিকেও বহু অবদান রয়েছে বলবন্ত পারেখের। গুজরাতের মাহুবাতে আর্টস ও সায়েন্স কলেজের স্থাপনের জন্য তিনি সাহায্য করেছেন। ভাবনগর সায়েন্স সিটি প্রজেক্টের জন্য ২ কোটি টাকা দান করেছিলেন তিনি। এছাড়াও তাঁর আরও অবদান রয়েছে সমাজে। ২০১১ সালের ২৮ অক্টোবরে এশিয়ার মধ্যে তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি টেক্সাসের দ্য ইনস্টিটিউট অব জেনেরাল সেমানটিক্সের জে টালবত উইনচেল পুরস্কারে সম্মানিত হন। ২০১৩ সালে ৮৮ বছরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভারতের ‘ফেভিকল ম্যান’।