Uttarakhand Disaster: ‘সবে গাড়িটা ঘোরানো হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে পাহাড়ের ওপর থেকে একটা পাথর এসে পড়ল গাড়ির ছাদে’

Uttarakhand Disaster: স্থানীয় মানুষরা যে সাহায্য করেছেন তা ভোলার নয়।যখন জিজ্ঞাসা করছি আপনাদের কাছে রেশন আছে তো, তখনও তারা একবারও বলেননি না যোগান দিতে পারব না। বরং বলেছেন আমাদের কাছে যে রেশন আছে তাতে সামান্য খিচুড়ি হলেও আপনাদের খাইয়ে দিতে পারব।

Uttarakhand Disaster: 'সবে গাড়িটা ঘোরানো হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে পাহাড়ের ওপর থেকে একটা পাথর এসে পড়ল গাড়ির ছাদে'
ছবি: বর্ণালী রায়। গ্রাফিক্স: অভীক দেবনাথ
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Oct 26, 2021 | 5:10 PM

বর্ণালী রায়, শিক্ষিকা

পাঁচ বন্ধু মিলে কলকাতা থেকে অক্টোবরের ৯ তারিখ রওনা দিয়েছিলাম ঋষিকেশের উদ্দেশ্যে। ১১তারিখ সকালবেলা সেখানে পৌঁছই। আগে থেকে একটা গাড়ি বুক করা ছিল গোটা ট্রিপের জন্য। আমাদের ট্রিপটা ছিল মূলত ১১ তারিখ থেকে ২১ অক্টোবর পর্যন্ত। ঋষিকেশ থেকে কার্তিকস্বামী মন্দির, সেখান থেকে হরিদ্বার হয়ে দিল্লি ফিরে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন। ঋষিকেশ থেকে প্রথমে সারি গ্রাম, সেখান থেকে পরেরদিন দেউরিয়া তাল ট্রেকিং। তারপরের দিন চোপ্তা ভ্যালি, সেখান থেকে ট্রেকিং করে তুঙ্গনাথ। সেখানে নাইট স্টে করে, পরেরদিন নেমে এসে যোশি মঠ হয়ে বদ্রীনাথ। বদ্রীনাথ ঘুরে আউলি, তারপর নেমে এসে কার্তিকস্বামী মন্দির। সেখানেই উত্তরাখণ্ড সফরের শেষ।

এই পরিকল্পনা অনুযায়ী সফর শুরু করে প্রথমে সারিতে গিয়ে পৌঁছলাম। পরপর পরিকল্পনাগুলো দারুণভাবে এক্সিকিউট হয়েছিল। কারণ ওয়েদার অসম্ভব ভাল ছিল। চৌখাম্বা থেকে শুরু করে প্রতিটা পিক যা যা দেখা যায় ওখানে অসাধারণ সব দৃশ্য ছিল। ঠান্ডা যেমন থাকে তেমনই ছিল। আর টুরিস্টও খুব কম নয়, বেশ ভালই টুরিস্ট যাতায়াত করছে। যাওয়ার আগে একটু আতঙ্কিত হয়েছিলাম কারণ উত্তরাখণ্ড ট্যুরিজম বিভাগ একটা স্মার্টসিটি পোর্টাল খুলেছিল রেজিস্ট্রেশনের জন্য। ভয় পাচ্ছিলাম সেখানে কোনও হ্যারাসমেন্ট যদি হয় অন্য রাজ্য থেকে যাচ্ছি বলে। কিন্তু সেসবের সম্মুখীন হতে হয়নি। সারা সফরে মাত্র এক জায়গাতেই রেজিস্ট্রেশন কপি দেখতে চাওয়া হয়, তাছাড়া সেভাবে আর কোথাও চেকও হয়নি। বলে রাখি যাওয়ার আগেই একটা ভাল খবর পেয়েছিলাম, উত্তরাখণ্ড সরকার চারধাম যাত্রা খুলে দিয়েছে এবং সেখানে কোনও যাত্রা পাস লাগছে না। যাওয়ার দুদিন আগেও যেটা সংশয় ছিল যে আদৌ বদ্রীনাথ যেতে পারব কিনা! সেটা দূর হয়ে গিয়েছিল, এবং আনন্দ হচ্ছিল যে সবকিছু আমাদের পরিকল্পনামাফিকই হবে। আর হলও সেটা। মানে বদ্রীনাথে গিয়ে এত লোক দেখলাম যে মনে হচ্ছিল করোনা বলে আদৌ কিছু ছিল কি না। হাজার হাজার মানুষ চারধাম যাত্রা করছে, কারও মুখেই মাস্ক নেই, সে এক রমরমা ব্যাপার।

বদ্রীনাথ ঘুরে চলে গেলাম আউলিতে। আউলিতে একদিন স্টে। এটা বলছি ১৭ তারিখের কথা। দুপুর ১২টা নাগাদ যখন আউলি পৌঁছলাম, ততক্ষণ পর্যন্ত বরফে সমস্ত পাহাড়গুলো- নন্দাদেবী, ত্রিশূল সবকটিই পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল। হঠাৎই বিকেল নাগাদ আবহাওয়া একটু মেঘলা হতে শুরু করে আর থেকে থেকে বৃষ্টি। পাঁচ বন্ধুর কেউই প্রফেশনাল ট্রেকার নই। যে রুটগুলোতে গিয়েছিলাম তার জন্য কোনও প্রফেশনাল ট্রেকিংয়ের প্রয়োজন হয় না। সামান্য শারীরিক সুস্থতা থাকলেই যে কেউ এ পথে ট্রেকিং করতে পারবেন। এর মধ্যেই এক বন্ধু মোবাইলে খবর দেখে জানালো, উত্তরাখণ্ড সরকার রেড অ্যালার্ট জারি করেছে। আউলি চামোলি জেলার মধ্যে পড়ে। তখন চামোলিতেই রয়েছি। খবর শুনে মনে হল, পাহাড়ের একটু বৃষ্টি হলেই তো সমস্যা হয়, আর এবার এত লোকজন এসেছে, তাই হয়ত আগে থেকে সরকার একটু বাড়তি সতর্কতা হিসেবে এই ব্যবস্থা নিচ্ছে।

ছবি: কৌন্তিক মিত্র

যোশি মঠে যখন দুপুরের লাঞ্চ করছিলাম একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়ল। এত ট্যুরিস্ট থাকা সত্ত্বেও সমস্ত মার্কেট পুরো বন্ধ। মনে হল কেন বন্ধ? এতদিন পর যখন এদের ব্যবসা খুলেছে, এত ট্যুরিস্ট, তারা কেউ যোশি মঠকে বেস করে বদ্রী যাচ্ছেন, কেউ আউলি যাচ্ছেন, তাহলে হঠাৎ এরা ব্যবসা বন্ধ করে দেবে কেন। যে হোটেলে খাচ্ছিলাম তারা বলল, রেড অ্যালার্ট জারি হয়েছে, পুলিশ সমানে টহল দিচ্ছে, আর বদ্রীনাথ যাত্রাও বন্ধ করে দিয়েছে। মনে মনে ভাবলাম, ভাল দিনে বদ্রী দর্শন করে নেমে এসেছি। কারণ বদ্রীনাথের রাস্তাটা অসম্ভব খারাপ। নানা জায়গায় টানেলের কাজ চলছে, ব্রিজ, রাস্তার কাজ চলছে। আমাদের যাওয়ার সময়ই আতঙ্ক লাগছিল, একদিনের বৃষ্টিতে এখানে ধস নেমে যাবে মনে হয়।

আউলিতে বসে ঠিক করলাম, কার্তিকস্বামীতে ট্রেকিংয়ে যাব না। কারণ বৃষ্টি হলে পথঘাট ভেজা থাকবে, ওপরে ওঠার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে, তাই গেলে কোনও লাভ হবে না। আমাদের দলে এক বন্ধু ছিলেন যিনি পশ্চিমবঙ্গের একজন নামী প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার। তিনি বললেন, আকাশ পরিস্কার না থাকলে গিয়ে কোনও লাভ হবে না। ঠিক করলাম নীচের দিকে নামব। একে আবহাওয়া খারাপ এবং আগামী তিনদিন খারাপই থাকবে, তার উপর পথঘাটও ভাল নয়। সেই অনুযায়ী হোটেলে জানালাম। গাড়ির ড্রাইভারও বলল, তাহলে আপনারা সকাল সকাল তৈরি থাকবেন, নামা শুরু করব।

সেদিন যত রাত বাড়ছে, তত ১২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত আউলিতে পাহাড়ের ঝোড়ো ঠান্ডা হাওয়া বাড়ছে। মনে হচ্ছে যেন ঠান্ডায় জমে যাব। স্থানীয় লোকজন জানাল বরফও পড়তে পারে এত ঠান্ডা হাওয়ার দাপট। পরের দিন নামার জন্য প্যাকিং করে রাখলাম। সকাল ৫ টা বাজে ঘড়িতে। চারদিকে পুরো ঘুটঘুটে অন্ধকার। মনে হচ্ছে না দিনের আলো ফুটবে। তখন ভয় করছিল যে আল্টিমেটলি কী নামতে পারব নীচে! ড্রাইভারকে ফোন করাতে বলল, আধঘন্টার মধ্যে আসছি, তারপর বেরিয়ে যাব। এরপর ড্রাইভার এলে বেরিয়েও পড়লাম। যে কোনও মূল্যে যদি যোশি মঠ পেরিয়ে রুদ্র প্রয়াগ অবধি যেতে পারি, তাহলে হরিদ্বার আসার দুটো রাস্তা পাব। যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, সেটা ওয়ান ওয়ে। এটা বন্ধ হলে যে অন্য রাস্তা দিয়ে যাব পাহাড়ের সব জায়গায় সেই সুযোগটা নেই। আউলি থেকে রুদ্রপ্রয়াগ পর্যন্ত যে রাস্তাটা, সেটার একদিক দিয়েই যেতে হবে, অন্য কোনও বিকল্প নেই। এর মধ্যে ক্রমাগত বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে। যোশি মঠ পেরিয়ে খানিক দূর পৌঁছতেই দেখি পাহাড় থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ে সারা রাস্তায় ছত্রাখান হয়ে আছে। এবং বেশ বড় বড় মাপের পাথর। রাস্তা দিয়ে গাড়িতে যেতে যেতে দেখতে পাচ্ছি পাহাড়ের গা বেয়ে ছোট ছোট নুড়ি পাথর গড়িয়ে পড়ছে। পথে এমন ঘটনায় ঘটেছে যে আমাদের এক বন্ধুকে ড্রাইভার বলেছে, আপনি সামনের রাস্তায় পড়ে থাকা পাথরটা সরিয়ে দিন, নইলে গাড়িটা যেতে পারবে না। সবাই মিলে সেই বড় বড় পাথর ধরাধরি করে সরিয়ে দিয়েছি বেশ কয়েকবার।

এসব করতে করতে যখন আরও খানিকটা এগিয়েছি, সামনে দেখি বিশাল জ্যাম। কী ব্যাপার খোঁজ করতেই দেখি একটা নালা, স্থানীয়রা বলে পাগল নালা। এই নালা পাহাড়ের উপর থেকে প্রবল বেগে কাদা মাটি, নুড়ি পাথর বয়ে নিয়ে নীচের দিকে নেমে আসছে। হঠাৎ চোখের সামনে দেখতে পেলাম মুহূর্তের মধ্যে রাস্তাটা মাঝখান দিয়ে ভেঙে দিল। রাস্তার ওপাশে কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে, আর এপাশে কিছু গাড়ি। কেউই আর এগোতে পারছে না। সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার জানাল এখুনি কোথাও আশ্রয় নিতে হবে, নইলে সাংঘাতিক ব্যাপার হতে পারে। ড্রাইভারকেও খানিকটা বিচলিত হতে দেখলাম। মনে হল উনি যখন স্থানীয় মানুষ হয়ে ভয় পাচ্ছেন তাহলে আমাদের কী হবে। সবে গাড়িটা ঘোরানো হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে পাহাড়ের ওপর থেকে একটা মাঝারি মাপের পাথর এসে পড়ল গাড়ির ছাদে। কপাল ভাল কারও আঘাত লাগেনি। ড্রাইভার জানাল আরেকটু বড় পাথর হলে গাড়ির ছাদ ফুটো হয়ে বিপদ হতে পারত। দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে চলে এলাম হেলঙ্গ বলে একটা গ্রামে।

ছবি: কৌন্তিক মিত্র

পঞ্চকেদারের এক কেদার কল্পেশ্বর ট্রেক করা শুরু হয় এই হেলঙ্গ  থেকেই। একটা ছোট্ট গ্রাম, হাতে গোনা মাত্র গোটা তিনেক হোম স্টে রয়েছে সেখানে। সেখানেই তড়িঘরি একটা ঘর দেখে নিলাম। অন্যান্যরাও তখন গাড়ি ঘুরিয়ে সেখানে আসা শুরু করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, যারা চারধাম যাত্রায় বেড়িয়েছিলেন সকলেই বয়স্ক। তারা সকলেই ইউপি, বিহার বিভিন্ন জায়গার মানুষ। তারা বাসে করে চারধাম যাত্রা করছিলেন। সেই সব লাক্সারি বাস এনে এই গ্রামে দাঁড় করানো হল। ঘন্টাখানেকের মধ্যে ওই ছোট্ট গ্রামটায় প্রায় ৫০০ লোক গিজগিজ করছে। কারণ তিনটে হোম স্টের প্রত্যেকটাতে বড়জোর তিনটে থেকে চারটে ঘর। এমনও দেখেছি এক একটা ঘরে যেখানে চারজন থাকা যায় সেখানে ১০-১২জন করে রয়েছেন। মাটিতে কম্বল বিছিয়ে রয়েছেন। বিকেলের দিকে কিছু বাঙালির সঙ্গে দেখা হওয়ায় তারা প্রশ্ন করল আপনারা ঘর পেয়েছেন? হ্যাঁ বলাতে তারা উত্তর দিলেন আপনারা অত্যন্ত ভাগ্যবান। আমাদের গাড়িতেই কাটাতে হবে। তাদের সঙ্গে দু আড়াই বছরের বাচ্চাও রয়েছে। সন্ধে বাড়তেই কারেন্ট চলে যায়। এত লোককে থাকতে দেওয়ার মতো জায়গা নেই। খাওয়ারও যে গোটা তিনেক হোটেল তাদের মধ্যে একটা হোটেল মাত্র খাবার দাবার দিতে পারছে। বাকিদের কাছে খাবার দাবারও নেই। শেষদিন যে হোটেলটা খাবার দিচ্ছিল, তারা তাদের খাবারের জায়গা থেকে বেঞ্চগুলো সরিয়ে দিয়ে মাদুর, চাটাই গোছের জিনিস পেতে দিয়ে সেখানেই বহু মানুষকে থাকতে দিল।

এটা একটা পজিটিভ দিক এই যাত্রায় দেখলাম, এত সমস্যাতেও ওরা শুধু খিচুড়ি বানিয়েছে আর অত লোক সকলেই সেই খিচুড়ি খেতে পেয়েছে। তাদের কোনও বিরক্তি নেই। যারা ঘর পায়নি, হোটেলওয়ালারা তাদের একবারও বলেননি যে আপনারা থাকবেন না এখানে, বসবেন না। ওরা কিন্তু যথেষ্ট কোঅপারেট করেছেন। যে জায়গাটায় ছিলাম তার পাশ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে অলকানন্দা। তার যে কী ভয়ংঙ্কর রূপ, তা দেখে বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে, ২০১৩ সালের কেদারনাথে ঘটা দুর্ঘটনার কথা। সেখানেও তো অলকানন্দার একটা ভূমিকা ছিল।

স্থানীয় চায়ের দোকানে প্রশ্ন করে জানলাম শুধু অলকানন্দা নয়, আরও দুদিক থেকে দুটি নদী এসে মিশেছে। ডান দিক থেকে এসেছে কল্পগঙ্গা, আর বাঁ দিক থেকে এসেছে কর্মনাশা নদী। ওরা নিজেরাই বলছেন, কর্মানাশা যখন বইতে শুরু করে তখন সেখানে কিছু না কিছু একটা ঘটে। তার উপর এই যে ক্রমাগত বৃষ্টি চলছে, কেদারনাথ কাণ্ডের পর এমনটা আর কখনও তারা দেখেননি। জিজ্ঞাসা করলাম কেনও বর্ষাকালে? তাদের উত্তর বর্ষাকালেও এমন ক্রমাগত বৃষ্টি হয় না। দেখতেও পাচ্ছি, যে পাহাড়গুলো শুকনো ছিল, সেগুলোর যেখান সেখান থেকে ঝর্ণা বওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই জলে কাদা, মাটি, পাথর, নুড়ি প্রবল স্রোতে নীচে নামছে। কল্পেশ্বরের রাস্তাটায় একটা ব্রিজ ছিল, যেটা নদীর উপর দিয়ে গেছে, সেটায় বুক অবধি কাদা জল হয়ে গেল।

ছবি: কৌন্তিক মিত্র

রাতের বেলা আওয়াজ পাচ্ছি এদিক থেকে কাঁচ ভেঙে পড়ছে, ওদিক থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ছে। আমাদের সঙ্গে দুজন জুনিয়র ছিল, ওরা একটু ভয় পাচ্ছিল। আমরা যেমন পাহাড়ে গিয়ে গিয়ে অভ্যস্ত ওরা তেমন নয়। ওদের খানিকটা কাউন্সেলিং করতে হল। রাতে তো ঘুম হলই না, একটু ভোরের দিকে যখন সবে তন্দ্রাটা একটু এসেছে, ওই জুনিয়রদের একজন তুলে বলল দিদি চলো, সামনের বাথরুমটা ধসে গেছে। আমি তো অবাক, কী ব্যাপার হল! বারান্দায় গিয়ে দেখি হোটেলের সিঁড়ির সংলগ্ন যে বাথরুমটা ছিল সেটা আর নেই, ধসে গেছে পাথর পড়ে। ওই পাহাড়ের নীচে একটা নীল রঙের ম্যাটাডোর ছিল সেটাও গুঁড়িয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম ম্যাটাডোরে কেউ ছিল না, পাথরটা আগে ম্যাটাডোরটাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে তারপর আমাদের বাথরুমটাকে ধসিয়ে দিয়েছে।

পরে ওখানে দাঁড়িয়ে যেটা বুঝলাম, ওখানে রাস্তার কাজ হচ্ছিল সেটা খুব বেশিদিন হয়নি, বাথরুমটা সে জন্য একটা কাঁচা কনস্ট্রাকশন ছিল। কিন্তু ভয় তো স্বাভাবিকভাবেই করে। এসে পর্যন্ত দেখছি, আমাদের ব্যালকনির দিকে যে ঘাসজমি ছিল সেটাও অনেকটা গড়ানের মতো অবস্থা বেশ জোরে জোরে দুলছে। হোম স্টের মালিককে জিজ্ঞাসা করলাম হোটেলটাও কী ধসে যেতে পারে? তিনি অভয় দিলেন এটা ড্রিল করে বসানো আছে কিছু হবে না। কিন্তু তখন কিছুই বিশ্বাস করতে পারছি না। কারণ খাটে বসেও এত দুলুনি হচ্ছে যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। পুরো ঘরটাই বাস্তবে নড়ছে। ঠিক করলাম লাগেজপত্র গাড়িতে রাখব এবং এবং ঘরে কেউ থাকব না। কারণ কখন কী হয় কেউই বলতে পারে না। তাই লাগেজ গাড়িতে তুলে বৃষ্টির মধ্যেই রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। কোথায় যাব, কোথাও তো তিল ধারণের জায়গা নেই।

এর মধ্যেই তখন জেসিবি চলে এসেছে, আর্মির বিভিন্ন গাড়ি চলে এসেছে, উত্তরাখন্ড সরকারের বড় কর্তাদের গাড়িও চলে এসেছে। কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে তারাও কিছুই করতে পারছেন না। ক্রমাগত বৃষ্টি আর পাথর বর্ষণ চলছে। শেষমেশ এমন অবস্থা আমাদের গাড়িগুলো যেখানে রাখা, তার উপরও এসে পড়তে শুরু করল পাথর। মানুষজন আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন তা দেখে। এতগুলো গাড়ি কোথায় সরিয়ে নিয়ে যাবে। এমনিতেই যানজট হয়ে রয়েছে। ব্রিজের উপর বুক সমান কাদা জল, সেখানেও নিয়ে যাওয়া যাবে না। মানে তথৈবচ অবস্থা। গোটা দিনটা এমন টানাপোড়েনেই কাটল। বিকেল যখন ৬টা বাজে সেই সময় একটা গাড়ি এসে জানাল আর এক ঘন্টা পর রাস্তা খোলার একটা সম্ভবনা আছে। তখন মনে হচ্ছিল এখানেই রাত কাটাই, কারণ রাতেরবেলা এই রাস্তা দিয়ে যাব, সেটা আরও বেশি রিস্ক হয়ে যাবে না তো। আবার ড্রাইভার বলছে এখানে থাকাটাও নিরাপদ নয়, মানে কোথায় গেলে যে নিরাপদ সেটাই বুঝতে পারছিলাম না।

শেষমেশ সন্ধে সাতটা নাগাদ ওখান থেকে রওনা দিলাম। যে রাস্তা দিয়ে এলাম, তার অবস্থা বর্ণনা করা মুশকিল। যে জায়গায় বৃষ্টির মধ্যে ছিলাম, বৃষ্টির পরিমাণ দেখে মনে হবে না যে এরকম হতে পারে, কিন্তু যা দেখলাম তা অবর্ণনীয়। সারা রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বড় বড় পাথর। পরে তো শুনলাম উপরের পাহাড়ে তুষার ধস হয়েছে। যা পরে খবরে দেখিয়েছে। তখন অনুধাবন করতে পারলাম এই ঘটনা কেন হয়েছে। বুঝতে পারলাম কোথা থেকে এত কাদা, মাটি, পাথর গাছপালা ভেসে এল। যাওয়ার সময় দেখলাম রাস্তাঘাট বাস্তবেই গুঁড়িয়ে গিয়েছে। ওই রাস্তা পেরিয়ে কীভাবে গাড়িতে যে ফিরেছি তা একমাত্র আমরাই জানি।

ছবি: কৌন্তিক মিত্র

পেছনে অনেক গাড়িই ছিল, মানে লরি, বাস, অন্যান্য টুরিস্টদের গাড়ি। শেষমেশ রাত দশটা নাগাদ পীপলকোটি বলে একটা নীচু অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায় সেই রাতের মতো আশ্রয় নিলাম। তারপরের দিন একটু বেলার দিকে বেড়িয়ে হরিদ্বার পৌঁছে সেখান থেকে দিল্লি হয়ে ফ্লাইট ধরে কলকাতায় ফিরলাম ২১ তারিখ। ভাগ্যের জেরে কাররই খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, সামান্য কিছু আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়া ছাড়া। যেটা ওই অবস্থায় স্বাভাবিকও ছিল।

স্থানীয় মানুষরা যে সাহায্য করেছেন তা ভোলার নয়।যখন জিজ্ঞাসা করছি আপনাদের কাছে রেশন আছে তো, তখনও তারা একবারও বলেননি না যোগান দিতে পারব না। বরং বলেছেন আমাদের কাছে যে রেশন আছে তাতে সামান্য খিচুড়ি হলেও আপনাদের খাইয়ে দিতে পারব। আরও যাতে রেশন আনা যায় তার ব্যবস্থাও করছি। সবচেয়ে বড় কথা,দেখেছি কোনও একটা বিপর্যয় হলে মানুষ ব্যবসায় নেমে পড়ে, তারা বেশি দাম নেয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে উত্তরাখন্ডের মানুষ কিন্তু তা করেননি। মানে চায়ের দাম যেমন ১০ টাকা ছিল তাই নিয়েছে, এমনকী টোটাল খাবারের দাম থেকেও অনেকটা ছাড় দিয়েছেন। আশ্চর্য লেগেছে যে এখনও ভাল মানুষ ভারতে রয়েছেন। এমনকী যে বাথরুমটা ধসে গিয়েছিল তার উপরেই ছিল রান্নাঘর, তাতে ফাটল ধরে বিপদজ্জনক হয়েছিল। সেসব উপেক্ষা করে তারা রান্নার কাজ করে গিয়েছে ওখানে আশ্রয় নেওয়া মানুষকে খাবার দিতে। স্থানীয় প্রসাশনের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষও রাস্তা পরিস্কারের কাজে হাত লাগিয়েছিলেন, মানে সে এক অদ্ভুত কো অপারেশন।

আমাদের ওখানে যারা ছিলেন তাদের কোনও প্রাণহানি হয়নি। কিন্তু খবর পাচ্ছিলাম, গাড়ি চুরমার হয়ে গেছে, খাদে গড়িয়ে পড়েছে, মানুষজন তাতে মারা গেছে। সেটা কতদূর ঠিক বা ভুল জানা নেই। তবে একটা ব্যাপার বলার, সারা দেবভূমিতে গোটা রাস্তায় দেখেছি অদ্ভুত সব কনস্ট্রাকশনের কাজ হচ্ছে। পাহাড়ের মাঝখানে আড়াআড়িভাবে বুক চিরে টানেল তৈরি করে সেখানে রেললাইন পাতার কাজ চলছে। বড় বড় বিল্ডিং তৈরি এবং রাস্তা চওড়া করার যে কী হিড়িক, যেন ন্যাশনাল হাইওয়ের মত রাস্তা বানানোর চেষ্টা চলছে। প্রতি মুহূর্তে পুরো সফরে এটাই বলতে বলতে গিয়েছি, এই যে ২০১৩ সালে এখানে দুর্ঘটনা ঘটেছিল তা এদের শিক্ষা দেয়নি। তারপরেও এদের এত কী প্রয়োজন যে পাহাড় পুরো কেটে ফেলে রাস্তা বানাতে হচ্ছে এত ব্যাপক হারে। এটাও কিন্তু এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের একটা বড় কারণ। সারা রাস্তাজুড়েই কাজ চলছে।

অনুলিখন: শুভেন্দু দেবনাথ

আরও পড়ুন: Uttarakhand Rain: মৃত্যু ভয় কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, চাক্ষুষ করে ফিরল উত্তরপাড়ার ঘোষ পরিবার