কলকাতা: আধা সেনা মাঠে নামতেই ধীরে ধীরে শান্ত হলেও বিগত কয়েকদিন ধরে লাগাতার হিংসার আগুনের জ্বলেছে মুর্শিদাবাদের একাধিক এলাকা। সুতি থেকে জঙ্গিপুর, দেখা গিয়েছে লাগাতার হিংসার ছবি। সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সামশেরগঞ্জেক একাধিক ‘পকেট’। জাফরাবাদ থেকে বেতবোনা, দিকেদিকে প্রকাশ্যেই হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। মুড়ি-মুড়কির মতো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে একের পর ঘর-বাড়ি। লুট হয়েছে সর্বস্ব। কারও অপারেশনের জন্য রাখা লক্ষ লক্ষ টাকা যেন লুট হয়েছে, তেমনই গলার হার থেকে কানের দুল, কিছুই ছেড়ে যায় দুষ্কৃতীরা। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বইপত্রও। শেষে গ্যাসের সিলিন্ডার খুলে জ্বালিয়ে দিয়েছে একের পর এক বাড়ি। হামলায় রয়েছে নির্দিষ্ট ‘প্যাটার্ন’! এখানেই দেখা যাচ্ছে সিঁদুরে মেঘ। বারবার উঠে আসছে ‘বহিরাগত’ তত্ত্ব। এলাকার জনপ্রতিনিধের মুখেও একাধিকবার শোনা গিয়েছে সেই একই কথা। কিন্তু কারা সেই বহিরাগত? বর্ডার পার করেই এপারে ঢুকছে ‘ওরা’?
বাংলাদেশের হাত?
মমতার দাবি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের একটি সূত্র বলছে মুর্শিদাবাদের ঘটনায় বাংলাদেশের হাত আছে। নেতাজি ইন্ডোরে ইমামদের সভা থেকে এ নিয়ে গর্জেও উঠেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, “আপনি ইউনূসের সঙ্গে গোপন মিটিং করুন। দেশের ভাল হলে খুশি হব। কিন্তু আপনাদের প্ল্যানিংটা কী! কোনও এজেন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে লোক নিয়ে এসে দাঙ্গা করা! স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সূত্র বলছে, বাংলাদেশের হাত আছে। বিএসএফ তো বর্ডার সামলায়। সেখানে কোনও অধিকার আমার নেই, রাজ্য সরকারের কাছে নেই। আপনি কেন ঢুকতে দিলেন। কৈফিয়ত আপনাকে দিতে হবে। আপনারা চান ভেদাভেদ তৈরি করতে।”
নেতাজি ইন্ডোরের বৈঠকে মমতা
মমতার এ মন্তব্য নিয়ে বিস্তর চাপানউতোরও চলে। অন্যদিকে ইতিমধ্য়েই ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলিতে এসেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, জাতীয় মহিলা কমিশনের সদস্যরা। শুনেছেন এলাকাবাসীর অভিযোগের কথা। জাফরাবাদে তো একদিন আগে গিয়েছিলেন খোদ রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। তাঁর কাছে আবার লিখিত আকারে সমস্ত অভিযোগ জানান এলাকার বাসিন্দারা। জোরাল দাবি উঠেছে স্থায়ী বিএসএফ ক্যাম্পেরও। প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় নামেন এলাকার মহিলারা।
কেউ কিছু টের পেল না?
অন্যদিকে মুর্শিদাবাদকাণ্ডে ইতিমধ্যেই NIA তদন্তের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। এনআইএ তদন্তের দাবি উঠেছে এলাকার বাসিন্দাদের তরফেও। ঘটনার সময় বারবার পুলিশি নিষ্ক্রিয়তারও অভিযোগ উঠেছে। এদিকে দুর্গত এলাকগুলির কাছাকাছি একাধিক জনপ্রতিনিধিদের বাড়ি। কেন কেউ কিছুই টের পেলেন না সেই প্রশ্ন উঠছে। জঙ্গিপুরের সাংসদ খলিলুর রহমান, সাগরদিঘির বিধায়ক বাইরন বিশ্বাস, ফরাক্কার বিধায়ক মনিরুল ইসলাম তিনজনেরই বাড়ি রতনপুরে। সামশেরগঞ্জের বিধায়ক আমিরুল ইসলামের বাড়ি পুঁটিমারি। বাইরন স্পষ্ট বলছেন, “আমরা আগে থেকে আঁচ করতে পারিনি। আগে থেকে খবর পেলে তো এ ঘটনা ঘটতেই দিতাম না। কিন্তু বিন্দুমাত্র আমরা খবর পাইনি। বড় শিক্ষা হল এটা থেকে। আর যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখব।”
‘পেশাদার দুষ্কৃতী’?
তৈরি হয়েছে সিট। হরগোবিন্দ, চন্দন খুনে ইতিমধ্যেই চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তরমধ্যে ধৃত দিলদার নাদাবের ভূমিকা নিয়ে ঘনিয়েছে রহস্য। দিলদারের সঙ্গে বাংলাদেশ যোগ উঠে আসছে বলে পুলিশ সূত্রে খবর। দিলদারের বাড়ি সামশেরগঞ্জের দিগরি গ্রামে। তাঁকে সুতির বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে গ্রেফতার করেছে।
হামলার প্যাটার্ন দেখে বারবার উঠে আসছে ‘পেশাদার দুষ্কৃতীদের’ কথাও। যেভাবে এলাকার সিসিটিভি থেকে বিদ্যুৎ বিছিন্ন করে হামলা চলেছে তাও ভাবাচ্ছে তদন্তকারীদের। জঙ্গিপুরের সাংসদ খলিলুর রহমানের স্পষ্ট মত, যাঁরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই বাইরের। তাঁর সাফ কথা, “কোথা থেকে ডুকছে জানি না।” বাইরে থেকে যে লোক ঢুকছে সে বিষয়ে খলিলুরের সঙ্গে এক মত ফরাক্কার তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলামও। হামলা হয়েছে তাঁর বাড়িতেও। এদিকে তাঁর বাড়ি আবার সামশেরগঞ্জ থানার ঠিক পাশেই। তিনি বলছেন, “বাইরে থেকে লোকজন না ঢুকলে এই ধরনের কাণ্ড ঘটতো না।”
বিষাদের ছায়া গোটা গ্রামে
বাংলাদেশে সরকার বদলের পর থেকেই বিগত কয়েক মাসে দফায় দফায় তপ্ত হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে। বারবার ধরা পড়েছে অনুপ্রবেশকারীরা। অনেকের হাতেই দেখা গিয়েছে জাল ভারতীয় পরিচয়পত্র। বেড়েছে দুষ্কৃতী দৌরাত্ম্য। নজরদারি বাড়িয়েছে বিএসএফ। কিন্তু, দক্ষিণবঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গ, সবথেকে বেশি চিন্তা বেড়েছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাঁটাতারহীন এলাকাগুলি নিয়ে। চিন্তা বেড়েছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের রিপোর্টেও। তবে কী মুর্শিদাবাদে ঘাঁটি গেড়েছিল বাংলাদেশি জঙ্গিরা?
চিন্তাটা ঠিক কোথায়?
সম্প্রতি সবথেকে বেশি অশান্তির ছবি দেখা গিয়েছে ধুলিয়ান, সুতি, সামশেরগঞ্জের মতো জায়গাগুলিতে। এই সমস্ত জায়গাই মারাত্মকবাবে ‘স্পর্শকাতর’ বলে মত ওয়াকিবহাল মহলের। এর একদিকে রয়েছে ঝাড়খণ্ডের পাকুড়, সাহেবগঞ্জ, অন্যদিকে রয়েছে বাংলাদেশ। পুলিশ সূত্রে খবর, গত কয়েক বছরে এই এলাকাগুলি লাগাতার অস্ত্র পাচারের করিডোর হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। সঙ্গে মাদক পাচার, জাল নোটের রমরমা তো রয়েইছে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, মুর্শিদাবাদে জঙ্গিদের গতিবিধি শুধু আজ থেকে বাড়েনি। উঠে আসছে ২০১৮ সালে বুদ্ধগয়ার কালচক্র ময়দানে দলাই লামার সফরকালে বিস্ফোরণ প্রসঙ্গও। ওই সময় কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স ২০১৯ সালের জুলাই মাসে প্রথম একজন জেএমবি অপারেটিভকে গ্রেফতার করে। তাঁকে জেরা করেই উঠে এসেছিল ধুলিয়ান মডেলের কথা। ২০১৪ সালের খাগড়াগড় বিস্ফোরণকাণ্ডের অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে উঠে এসেছিল জেএমবি নেতা কওসরের নাম।
সিঁদুরে মেঘ গোয়েন্দা রিপোর্টে
জানা যায়, এই কওসরই তৈরি করেছিল ‘ধুলিয়ান মডেল’। ধুলিয়ান, পাকুড়, সাহেবগঞ্জ সহ আশপাশের এলাকার বেশ কিছু যুবকদের নিয়ে তৈরি হয়েছিল ধুলিয়ান মডেল। বিশেষজ্ঞদের মতে, বেশ কিছু বছর আগে থেকেই ওই এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছিল জেএমবি। শুধু জেএমবি নয়, উদ্বেগ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিয়েও। জেএমবি-র মডিউলের বড় অংশই পরবর্তীতে এবিটি-তে ঢুকে যায় বলে খবর। উদ্বেগ কেন্দ্রীয় রিপোর্টেও। মুর্শিদাবাদের জেলে থাকা কুখ্যাত জেএমবি জঙ্গি তারিকূলের ভূমিকাও বারবার পড়েছে প্রশ্নের মুখে। সে সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে ধুলিয়ান, সুতি এলাকায় একাধিকবার বৈঠক করেছে বলে খবর। এমনকি সাম্প্রতিককালে মুর্শিদাবাদ ঘুরে গিয়েছেন বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন আনলারুল্লা বাংলা টিমের হেড জসিমুদ্দিন রহমানি। ABT-র ধৃত সদস্যদের গ্রেফতার করে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে গোয়েন্দাদের হাতে। একইসঙ্গে গত বছর মে মাসে হিজবুত তাহিরির দুই জঙ্গি মালদহ দিয়ে ঢোকে মুর্শিদাবাদের সুতি এলাকায়। মিটিংও করে। সবটাই স্পষ্ট গোয়েন্দা রিপোর্টে। পাশাপাশি এই সব এলাকায় পিএফআইয়ের মতো সংগঠনেরও ভালই ছাপ রয়েছে বলে একাধিকবার গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজবিরোধীদের দাপাদাপি তো ছিলই, সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় দিনের পর দিন বেআইনি কাজের রমরমা, আবার বিগত কয়েক মাসে মৌলবাদীদের দাপট, অশান্ত ছিলই সীমান্তবর্তী এলাকাগুলি। সেখানে ঘোলা জলে এবার মাঝ ধরতে কারা নামল সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। শুভেন্দুরা বলছেন, NIA হলেই ‘দুধ কা দুধ, পানি কা পানি’ হয়ে যাবে। গ্রামবাসীদেরও একই মত। তবে তাঁরা আস্থা রাখতে পারছেন না স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের উপর। তাঁদের একটাই কথা, স্থায়ী বিএএসএফ ক্যাম্প চাই। তৃণমূলের বিধায়ক সাংসদদের পাশে বসিয়েই সেই দাবি তুলছেন তাঁরা। এখন দেখার সব মিলিয়ে জল কোনদিকে গড়ায়।
কলকাতা: আধা সেনা মাঠে নামতেই ধীরে ধীরে শান্ত হলেও বিগত কয়েকদিন ধরে লাগাতার হিংসার আগুনের জ্বলেছে মুর্শিদাবাদের একাধিক এলাকা। সুতি থেকে জঙ্গিপুর, দেখা গিয়েছে লাগাতার হিংসার ছবি। সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সামশেরগঞ্জেক একাধিক ‘পকেট’। জাফরাবাদ থেকে বেতবোনা, দিকেদিকে প্রকাশ্যেই হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। মুড়ি-মুড়কির মতো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে একের পর ঘর-বাড়ি। লুট হয়েছে সর্বস্ব। কারও অপারেশনের জন্য রাখা লক্ষ লক্ষ টাকা যেন লুট হয়েছে, তেমনই গলার হার থেকে কানের দুল, কিছুই ছেড়ে যায় দুষ্কৃতীরা। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বইপত্রও। শেষে গ্যাসের সিলিন্ডার খুলে জ্বালিয়ে দিয়েছে একের পর এক বাড়ি। হামলায় রয়েছে নির্দিষ্ট ‘প্যাটার্ন’! এখানেই দেখা যাচ্ছে সিঁদুরে মেঘ। বারবার উঠে আসছে ‘বহিরাগত’ তত্ত্ব। এলাকার জনপ্রতিনিধের মুখেও একাধিকবার শোনা গিয়েছে সেই একই কথা। কিন্তু কারা সেই বহিরাগত? বর্ডার পার করেই এপারে ঢুকছে ‘ওরা’?
বাংলাদেশের হাত?
মমতার দাবি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের একটি সূত্র বলছে মুর্শিদাবাদের ঘটনায় বাংলাদেশের হাত আছে। নেতাজি ইন্ডোরে ইমামদের সভা থেকে এ নিয়ে গর্জেও উঠেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, “আপনি ইউনূসের সঙ্গে গোপন মিটিং করুন। দেশের ভাল হলে খুশি হব। কিন্তু আপনাদের প্ল্যানিংটা কী! কোনও এজেন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে লোক নিয়ে এসে দাঙ্গা করা! স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সূত্র বলছে, বাংলাদেশের হাত আছে। বিএসএফ তো বর্ডার সামলায়। সেখানে কোনও অধিকার আমার নেই, রাজ্য সরকারের কাছে নেই। আপনি কেন ঢুকতে দিলেন। কৈফিয়ত আপনাকে দিতে হবে। আপনারা চান ভেদাভেদ তৈরি করতে।”
নেতাজি ইন্ডোরের বৈঠকে মমতা
মমতার এ মন্তব্য নিয়ে বিস্তর চাপানউতোরও চলে। অন্যদিকে ইতিমধ্য়েই ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলিতে এসেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, জাতীয় মহিলা কমিশনের সদস্যরা। শুনেছেন এলাকাবাসীর অভিযোগের কথা। জাফরাবাদে তো একদিন আগে গিয়েছিলেন খোদ রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। তাঁর কাছে আবার লিখিত আকারে সমস্ত অভিযোগ জানান এলাকার বাসিন্দারা। জোরাল দাবি উঠেছে স্থায়ী বিএসএফ ক্যাম্পেরও। প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় নামেন এলাকার মহিলারা।
কেউ কিছু টের পেল না?
অন্যদিকে মুর্শিদাবাদকাণ্ডে ইতিমধ্যেই NIA তদন্তের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। এনআইএ তদন্তের দাবি উঠেছে এলাকার বাসিন্দাদের তরফেও। ঘটনার সময় বারবার পুলিশি নিষ্ক্রিয়তারও অভিযোগ উঠেছে। এদিকে দুর্গত এলাকগুলির কাছাকাছি একাধিক জনপ্রতিনিধিদের বাড়ি। কেন কেউ কিছুই টের পেলেন না সেই প্রশ্ন উঠছে। জঙ্গিপুরের সাংসদ খলিলুর রহমান, সাগরদিঘির বিধায়ক বাইরন বিশ্বাস, ফরাক্কার বিধায়ক মনিরুল ইসলাম তিনজনেরই বাড়ি রতনপুরে। সামশেরগঞ্জের বিধায়ক আমিরুল ইসলামের বাড়ি পুঁটিমারি। বাইরন স্পষ্ট বলছেন, “আমরা আগে থেকে আঁচ করতে পারিনি। আগে থেকে খবর পেলে তো এ ঘটনা ঘটতেই দিতাম না। কিন্তু বিন্দুমাত্র আমরা খবর পাইনি। বড় শিক্ষা হল এটা থেকে। আর যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখব।”
‘পেশাদার দুষ্কৃতী’?
তৈরি হয়েছে সিট। হরগোবিন্দ, চন্দন খুনে ইতিমধ্যেই চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তরমধ্যে ধৃত দিলদার নাদাবের ভূমিকা নিয়ে ঘনিয়েছে রহস্য। দিলদারের সঙ্গে বাংলাদেশ যোগ উঠে আসছে বলে পুলিশ সূত্রে খবর। দিলদারের বাড়ি সামশেরগঞ্জের দিগরি গ্রামে। তাঁকে সুতির বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে গ্রেফতার করেছে।
হামলার প্যাটার্ন দেখে বারবার উঠে আসছে ‘পেশাদার দুষ্কৃতীদের’ কথাও। যেভাবে এলাকার সিসিটিভি থেকে বিদ্যুৎ বিছিন্ন করে হামলা চলেছে তাও ভাবাচ্ছে তদন্তকারীদের। জঙ্গিপুরের সাংসদ খলিলুর রহমানের স্পষ্ট মত, যাঁরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই বাইরের। তাঁর সাফ কথা, “কোথা থেকে ডুকছে জানি না।” বাইরে থেকে যে লোক ঢুকছে সে বিষয়ে খলিলুরের সঙ্গে এক মত ফরাক্কার তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলামও। হামলা হয়েছে তাঁর বাড়িতেও। এদিকে তাঁর বাড়ি আবার সামশেরগঞ্জ থানার ঠিক পাশেই। তিনি বলছেন, “বাইরে থেকে লোকজন না ঢুকলে এই ধরনের কাণ্ড ঘটতো না।”
বিষাদের ছায়া গোটা গ্রামে
বাংলাদেশে সরকার বদলের পর থেকেই বিগত কয়েক মাসে দফায় দফায় তপ্ত হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে। বারবার ধরা পড়েছে অনুপ্রবেশকারীরা। অনেকের হাতেই দেখা গিয়েছে জাল ভারতীয় পরিচয়পত্র। বেড়েছে দুষ্কৃতী দৌরাত্ম্য। নজরদারি বাড়িয়েছে বিএসএফ। কিন্তু, দক্ষিণবঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গ, সবথেকে বেশি চিন্তা বেড়েছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাঁটাতারহীন এলাকাগুলি নিয়ে। চিন্তা বেড়েছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের রিপোর্টেও। তবে কী মুর্শিদাবাদে ঘাঁটি গেড়েছিল বাংলাদেশি জঙ্গিরা?
চিন্তাটা ঠিক কোথায়?
সম্প্রতি সবথেকে বেশি অশান্তির ছবি দেখা গিয়েছে ধুলিয়ান, সুতি, সামশেরগঞ্জের মতো জায়গাগুলিতে। এই সমস্ত জায়গাই মারাত্মকবাবে ‘স্পর্শকাতর’ বলে মত ওয়াকিবহাল মহলের। এর একদিকে রয়েছে ঝাড়খণ্ডের পাকুড়, সাহেবগঞ্জ, অন্যদিকে রয়েছে বাংলাদেশ। পুলিশ সূত্রে খবর, গত কয়েক বছরে এই এলাকাগুলি লাগাতার অস্ত্র পাচারের করিডোর হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। সঙ্গে মাদক পাচার, জাল নোটের রমরমা তো রয়েইছে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, মুর্শিদাবাদে জঙ্গিদের গতিবিধি শুধু আজ থেকে বাড়েনি। উঠে আসছে ২০১৮ সালে বুদ্ধগয়ার কালচক্র ময়দানে দলাই লামার সফরকালে বিস্ফোরণ প্রসঙ্গও। ওই সময় কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স ২০১৯ সালের জুলাই মাসে প্রথম একজন জেএমবি অপারেটিভকে গ্রেফতার করে। তাঁকে জেরা করেই উঠে এসেছিল ধুলিয়ান মডেলের কথা। ২০১৪ সালের খাগড়াগড় বিস্ফোরণকাণ্ডের অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে উঠে এসেছিল জেএমবি নেতা কওসরের নাম।
সিঁদুরে মেঘ গোয়েন্দা রিপোর্টে
জানা যায়, এই কওসরই তৈরি করেছিল ‘ধুলিয়ান মডেল’। ধুলিয়ান, পাকুড়, সাহেবগঞ্জ সহ আশপাশের এলাকার বেশ কিছু যুবকদের নিয়ে তৈরি হয়েছিল ধুলিয়ান মডেল। বিশেষজ্ঞদের মতে, বেশ কিছু বছর আগে থেকেই ওই এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছিল জেএমবি। শুধু জেএমবি নয়, উদ্বেগ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিয়েও। জেএমবি-র মডিউলের বড় অংশই পরবর্তীতে এবিটি-তে ঢুকে যায় বলে খবর। উদ্বেগ কেন্দ্রীয় রিপোর্টেও। মুর্শিদাবাদের জেলে থাকা কুখ্যাত জেএমবি জঙ্গি তারিকূলের ভূমিকাও বারবার পড়েছে প্রশ্নের মুখে। সে সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে ধুলিয়ান, সুতি এলাকায় একাধিকবার বৈঠক করেছে বলে খবর। এমনকি সাম্প্রতিককালে মুর্শিদাবাদ ঘুরে গিয়েছেন বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন আনলারুল্লা বাংলা টিমের হেড জসিমুদ্দিন রহমানি। ABT-র ধৃত সদস্যদের গ্রেফতার করে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে গোয়েন্দাদের হাতে। একইসঙ্গে গত বছর মে মাসে হিজবুত তাহিরির দুই জঙ্গি মালদহ দিয়ে ঢোকে মুর্শিদাবাদের সুতি এলাকায়। মিটিংও করে। সবটাই স্পষ্ট গোয়েন্দা রিপোর্টে। পাশাপাশি এই সব এলাকায় পিএফআইয়ের মতো সংগঠনেরও ভালই ছাপ রয়েছে বলে একাধিকবার গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজবিরোধীদের দাপাদাপি তো ছিলই, সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় দিনের পর দিন বেআইনি কাজের রমরমা, আবার বিগত কয়েক মাসে মৌলবাদীদের দাপট, অশান্ত ছিলই সীমান্তবর্তী এলাকাগুলি। সেখানে ঘোলা জলে এবার মাঝ ধরতে কারা নামল সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। শুভেন্দুরা বলছেন, NIA হলেই ‘দুধ কা দুধ, পানি কা পানি’ হয়ে যাবে। গ্রামবাসীদেরও একই মত। তবে তাঁরা আস্থা রাখতে পারছেন না স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের উপর। তাঁদের একটাই কথা, স্থায়ী বিএএসএফ ক্যাম্প চাই। তৃণমূলের বিধায়ক সাংসদদের পাশে বসিয়েই সেই দাবি তুলছেন তাঁরা। এখন দেখার সব মিলিয়ে জল কোনদিকে গড়ায়।