CPIM-CPIML: নৈহাটিতে ‘ক’বিঘা’ জমি নকশালদের? দীপঙ্করদের হাত ধরে এবার হবে CPM-এর ‘শাপমোচন’?
CPIM-CPIML: ২০১৫ সালে কলকাতায় সিপিএমের প্লেনাম উপলক্ষে অনুষ্ঠিত ব্রিগেড সমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলেন লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। তবে জোট তখনও হয়নি। যা হতে লেগে গেল আরও প্রায় ১০টা বছর। যদিও এ ক্ষেত্রে লিবারেশন সম্পাদকের স্পষ্ট কথা, “ঐক্য যখন গড়ে ওঠে তখন ঐক্যের পরিসর, ঐক্যের পরিস্থিতি, পরিপ্রেক্ষিত থেকেই সবটা হয়।”
“বিজেপির উঠে আসাটা বামপন্থীদের দুর্বলতার কারণে। আমি যখন এ কথা বলছি তখন আমার দলকে তারমধ্যে ধরেই বলছি। তবে বাংলায় নির্বাচনী ময়দানে আমাদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি কোনওকালেই থাকেনি।” কয়েকদিন আগেই টিভি-৯ বাংলা ডিজিটালের ডেপুটি এক্সিকিউটিভ এডিটর নির্ণয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎকারে এ কথা বলতে শোনা গিয়েছিল সিপিআইএমএল লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যকে। সেই লিবারেশনই প্রথমবার বাংলার মাটিতে জোট করে ভোটে লড়ছে ‘সিপিএমের’ সঙ্গে। নৈহাটিতে সিপিএমের সমর্থনে লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়েছেন সিপিআইএমএল লিবারেশন প্রার্থী দেবজ্যোতি মজুমদার। কারও কাঁধে তিন তারা, কারও কাঁধে কাস্তে-হাতুড়ি! কিন্তু মঞ্চ বাঁধা থেকে দেওয়াল লিখন, রোড শো, সবই চলছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। কিন্তু, ‘নকশালদের’ সঙ্গে মূল স্রোতের বামেদের এই সহাবস্থান এখন বঙ্গ রাজনীতির আঙিনায় অন্যতম বড় চর্চার বিষয়। চর্চা চলছে অচিরেই বামফ্রন্টের নাম বদল নিয়েও। কেউ বলছেন অপেক্ষিত জোট, কেউ বলছেন উপেক্ষিত জোট। যদিও দীপঙ্করবাবু বলছেন, ‘সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত’।
খাতায়-কলমে এই প্রথমবার ‘সমঝোতা’ হলেও লিবারেশন নেতারা কিন্তু বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন অতীতের কথা, সিপিএমকে সমর্থনের কথা। সঙ্গে শুধু জুড়ে দিচ্ছেন, ‘এই প্রথম সিপিএম আমাদের সমর্থন করল।’ একুশের ভোটের কথা মনে করিয়ে এই তো সেদিন বললেন, ‘একুশের নির্বাচনে বামফ্রন্টের দখলে থাকা ২৪ আসনে আমরা ওদের সমর্থন করেছিলাম। আমি নিজে সায়নদীপের হয়ে প্রচারে গিয়েছিলাম।’ অন্যান্য লিবারেশন নেতাদেরও একই কথা। ঠাকুরনগর থেকে কামারহাটি, একাধিক আসনে কীভাবে তাঁরা বামফ্রন্টের প্রার্থীদের সমর্থন করেছিলেন সে কথা বারেবারে মনে করাচ্ছেন। তবে এই প্রথম দেখা যাচ্ছে উল্টো ছবি। লিবারেশনের প্রার্থীদের হয় গলা তুলছেন সেলিম-বিমানরা। কিন্তু, রাজ্যের ছয় আসনে উপনির্বাচন হলেও নৈহাটিকেই কেন আলাদা করে বাছা হল জোটের জন্য? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বড় অংশের মতে, হুগলি নদীর দুই তীরে শ্রমিক বেল্টে বরাবরই কাজ করে আসছেন লিবারেশনের নেতারা। কিন্তু, ঘর গুছিয়ে সংসদীয় ভোটের ময়দানে নজরকাড়া উপস্থিতি সেই অর্থে দেখা যায়নি। কিন্তু, লোকসভা ভোট হোক বা বিধানসভা হুগলি থেকে হাওড়া, পূর্ব বর্ধমান, দুই ২৪ পরগনার একাধিক জায়গায় প্রার্থী দিতে দেখা গিয়েছে সিপিআইএমএলকে। ভোটের হার দেখে নেতারা বলেছেন ‘মন্দের ভাল’।
কংশাল থেকে ‘অতিবাম’ ফ্রন্ট
অতীতের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যাবে বামফ্রন্টের সঙ্গে সমঝোতা করেছিল নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায়ের দল কমিউনিস্ট রেভলিউশনারি লিগ। যদিও তখন তৃণমূল নয়, মূল প্রতিপক্ষ ছিল কংগ্রেস। তবে অতীত আবার এও বলছে একসময় কংগ্রেস এবং নকশালদের আক্রমণে সিপিএম নেতাদের জুড়ি মেলা ছিল রীতিমতো ভার। দুই দলকে এক বন্ধনীতে ফেলে চলত চাঁচাছোলা আক্রমণ। বারবার শোনা যেত একটাই শব্দবন্ধ, ‘কংশাল’। এবার সেই সিপিএমএম-ই প্রথমবার হাত ধরল ‘অতিবাম’ লিবারেশনের সঙ্গে। অন্যদিকে সাম্প্রতিক ইতিহাস বলছে, লোকসভা ভোটের সময়ই চার কেন্দ্রে উপনির্বাচন হয়েছিল। তখনই লিবারেশন-বামফ্রন্ট সমঝোতার কথা শোনা যায়। সূত্রের খবর, সিপিএমের সঙ্গে লিবারেশন নেতৃত্বের বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছিল তখনই। ঠিক হয়েছিল পরের দফায় যখন ছ’টি আসনে উপনির্বাচন হবে তখন একটি আসন ছাড়া হবে লিবারেশনকে। ফলশ্রুতি, নৈহাটি। যদিও নৈহাটিকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার পিছনে সেখানকার সাংগঠনিক দক্ষতার কথাই বলছেন সুব্রত সেনগুপ্তর মতো জেলা স্তরের শীর্ষ নেতারা।
সুব্রতবাবুর কথায়, “সিপিএমের সঙ্গে তো আমরা একাধিক ইস্যুতে একসঙ্গে পথে নেমেছি। গলা তুলেছি। একসঙ্গে মিছিল করেছি। হ্যাঁ আমাদের মধ্যে কিছু তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। একটা পার্টি জন্মই হয়েছে সিপিএম থেকে ভেঙে। তাই তাঁদের মধ্যে বিরোধ থাকবে না? সেটা নিয়েও চর্চা হয়েছে। আমরা চাই বিতর্ক সুস্থভাবে হোক। অনেক প্রশ্নের চলতে চলতে ফায়সালা হবে। আমরা চাই সব বাম দল এক ছাতার তলায় আসুক। সেলিমও তো সে কথাই বলেছেন। আমরাও সেটাই ভাবছি। সময়ের দাবি মেনেই সবটা হচ্ছে। সময়ের দাবি মেনেই সবটা হয়। আর নৈহাটিতে প্রচারেও আমরা ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। মানুষ আমাদের কথা শুনছেন।”
কেন নৈহাটি?
প্রসঙ্গত, নৈহাটি বিধানসভা আসনটি ফাঁকা হয়েছে কিছু আগে। ব্যারাকপুর লোকসভা আসন থেকে জিতে সংসদে গিয়েছে পার্থ ভৌমিক। ফলে নৈহাটি খুঁজছে নতুন জনপ্রতিনিধি। সেই নৈহাটিতেই এবার বৃহত্তর বামেদের পছন্দ দেবজ্যোতি মজুমদার। ১৯৮০ সাল নাগাদ বঙ্গবাসী কলেজে পড়ার সময় থেকেই নৈহাটি লিবারেশনের পায়ের তলার জমি শক্ত করতে ময়দানে নেমে পড়েছিলেন তিনি। কথা হচ্ছিল, গঙ্গী তীরে শ্রমিক বেল্টে সংগঠন তৈরি প্রসঙ্গে। এ ক্ষেত্রেও দলের হয়ে অগ্রণী ভূমিকায় দেখা গিয়েছে তাঁকে। গৌরীপুর জুটমিলে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বর্তমানে চটশিল্পে ট্রেড ইউনিয়নের আন্দোলনের অন্যতম নেতা। অসংগঠিত শ্রমিকদের বিশেষ করে আইসিডিএস, আশা এবং মিড ডে মিলের কর্মীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা নেন তিনি। সম্প্রতি তাঁর মনোনয়ন পর্বে উপস্থিত থাকতে দেখা যায় সিপিএম নেতা পলাশ দাস এবং সিটু নেত্রী গার্গী চট্টোপাধ্যায়দের। সেই দেবজ্যোতিবাবুও বলছেন খানিক একই কথা। তাঁর মতে, মানুষ বিকল্প খুঁজছে। ধরে ফেলেছে তৃণমূলের কারসাজি। উন্নয়নের নামে আসলে পাহাড়-প্রমাণ অনুন্নয়নের মুখে দাঁড়িয়ে বাংলা। নৈহাটির মানুষও সেটা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছেন। তাঁর মতে, এই এলাকায় রাজনীতি করেছেন। বোঝেন মানুষের পালস। মানুষ যে তাঁদের গ্রহণ করছেন তা বোঝা যাচ্ছে প্রচারে গেলেই।
টিভি-৯ বাংলা ডিজিটালের মুখোমুখি হয়েছিলেন নৈহাটির সিপিএমএল লিবারেশনের প্রার্থী দেবজ্যোতিবাবুও। বলছেন, “মানুষের মধ্যে শাসকদলের বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভ রয়েছে। সেটা কিন্তু, শুধু আরজি কর নিয়ে নয়। সবথেকে দূরে যে গ্রাম রয়েছে সেখানে স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও সেখানকার রাস্তায় আলো নেই। গ্রামের রাস্তায় হাঁটা রীতিমতো কষ্টকর। ওখানকার মেয়েদের টিউশন পড়ে বাড়ি ফিরতে গিয়ে রীতিনতো বেগ পেতে হয়। কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার দিলেও মানুষ বোঝে ওটা সরকারের কোষাগার থেকে যাচ্ছে। তৃণমূল দিচ্ছে না। সরকারের টাকা সাধারণ মানুষের টাকা। তাই মানুষের টাকা নিয়ে মানুষকেই দেওয়া হচ্ছে, এটা সবাই বোঝে। তাই ক্ষোভের জায়গাগুলো আলাদা। আরজি কর নিয়ে তো ওখানকার বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরাও রাস্তায় নেমেছে। স্লোগান দিয়েছে। এটা অভূতপূর্ব।”
নেপথ্যে যখন আরজি কর
যদিও লিবারেশন সম্পাদক আবার এই জোটের পিছনে আরজি করের আন্দোলনকে কিছুটা হলেও বাড়তি ধন্যবাদ দিতে চান। দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের কথায়, “আমার মনে হয় এর নেপথ্যে আরজি করের আন্দোলন একটা বড় ভূমিকা পালন করছে। আমি তো এটাকে গণজাগরন বলি। গোটা দেশ তথা রাজ্যের জন্য অভূতপূর্ব আন্দোলন এটা। আর সেই প্রেক্ষাপটে এবারের উপনির্বাচন আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে। যে সময়ে এই নির্বাচন হচ্ছে তা আসলে আন্দোলন চালাকালীন মানুষকে এটা আলাদা সুযোগ দিচ্ছে। মত প্রকাশের সুযোগ করে দিচ্ছে।” এখানেই না থেমে তাঁর আরও সংযোজন, “এই আন্দোলন একইসঙ্গে মহিলাদের আন্দোলন, নিরাপত্তার আন্দোলন, ডাক্তারদের আন্দোলন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, রোগীদের আন্দোলন।” তাঁর মতে, আরজি কর শিখিয়েছে কীভাবে শাসকের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করতে হয়, কীভাবে গড়ে তুলতে হয় জন আন্দোলন। পশ্চিমবঙ্গের যে কোনও ইস্যুই তো এখন এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। এই আন্দোলন রাজনীতির একটা নতুন ভাষা, নতুন এজেন্ডা গড়ে দিয়েছে।
তবে তৃণমূলকে যে তিনি ছেড়ে কথা বলছেন এমনটা নয়। লিবারেশনের শীর্ষ নেতার সাফ কথা, পশ্চিম বাংলায় যেভাবে পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থা চলছে তাতে যে কোনও মুহূর্তে এই রাজ্যও ওড়িশা হয়ে যেতে পারে। তাই বামপন্থীদের দ্রুত উঠে আসতে হবে। দ্রুত বাম বিকল্প না হলে বিজেপি বাংলা দখল করে নিতে পারে বলেই মনে করছেন তিনি। স্পটতই বলছেন, “আমরা বলেছিলাম বিজেপিকে একটিও ভোট নয়, কিন্তু তার সঙ্গে একটা কথা বলেছিলাম যে তৃণমূলকে একটুও ছাড় নয়। সেটা অনেকেই খেয়াল করেননি।”
জোটে কাজ করল কোন রসায়ন?
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে কলকাতায় সিপিএমের প্লেনাম উপলক্ষে অনুষ্ঠিত ব্রিগেড সমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলেন লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। তবে জোট তখনও হয়নি। যা হতে লেগে গেল আরও প্রায় ১০টা বছর। যদিও এ ক্ষেত্রে লিবারেশন সম্পাদকের স্পষ্ট কথা, “ঐক্য যখন গড়ে ওঠে তখন ঐক্যের পরিসর, ঐক্যের পরিস্থিতি, পরিপ্রেক্ষিত থেকেই সবটা হয়।” তুললেন ইউপিএ থেকে ইন্ডিয়া জোটের প্রসঙ্গও। বললেন, “কেন্দ্রে ২০০৪ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ইউপিএ সরকার ছিল। এবারে যে জোট হয়েছে সেটা ইন্ডিয়া জোট। এর মধ্যে ইউপিএ জোটের অনেক দল রয়েছে। আবার দল যাঁরা ইউপিএ তে ছিল না কিন্তু এর মধ্যে রয়েছে। যেমন আমরা। একইভাবে আগে আমরা আগে বামফ্রন্টে ছিলাম না।” কিন্তু, মানুষ যে বৃহত্তর বাম ঐক্য চাইছে বারবার জোর দিলেন সেই কথায়। বললেন, “আমাকে তো অনেকেই বলছেন বিহারে যদি এটা হতে পারে বাংলায় নয় কেন? বাংলা তো অতীতে আটকে নেই। বাংলায় প্রচুর বাম মনষ্ক মানুষ আছেন। যাঁরা কোনও দলের সঙ্গে যুক্ত নন। তাঁরা কেন এটা চান। এই ঐক্যের পক্ষে বরাবর সওয়াল করেছেন। হিন্দি বলয়ে লিবারেশন উঠে এসেছে। ছাত্র রাজনীতির আঙিনাতেও তো আমরা একসঙ্গে লড়ি। এবারে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে তো এসএফআই ও আইসার কমরেডরা একসঙ্গে লড়েছেন। জেনইউ-তে আমরা দীর্ঘদিন আলাদা লড়েছি আবার একসঙ্গেও লড়েছি। কৃষক ফ্রন্টেও একই অবস্থা।সোজা কথায় বৃহত্তর বামপন্থী ঐক্য দরকার। একটা সংগ্রামী, গতিশালী বামপন্থী ঐক্য দরকার।”