কলকাতা: ‘সেদিনই মনে হয়েছিল আমি তাঁর চেয়ে খাঁটি বামপন্থী।’ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর কথা স্মরণ করতে গিয়ে এমনই লিখলেন বিতর্কিত বাংলাদেশি লেখিকা তসলিমা নাসরিন। সাধারণত, কারও প্রয়াণ ঘটলে তাঁর সম্পর্কে ভাল-ভাল কথাই শোনা যায়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রত্য়েকেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সততার কথা বলেছেন। তবে, তিনি তসলিমা নাসরিন। স্রোতের বিরুদ্ধে যাওয়াটাই তাঁর চরিত্র। এই ক্ষেত্রেও সেই পথেই হাঁটালেন তিনি। বুদ্ধ স্মরণে তাঁর কন্ঠে ঝরে পড়ল একরাশ অভিমান। কারণ, এক সময় তো এই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সঙ্গেই তাঁর ‘সখ্য’ ছিল।
সোশ্যাল মিডিয়ায় তসলিমা লিখেছেন, ২০০৩ সালের আগে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর মৃত্যু সংবাদ পেলে, মৃত্যুর আগে তাঁর কষ্টের কথা জানলে, তিনি চোখের জল ফেলতেন। কিন্তু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বেঁচে থাকাকালীন, অনেক বছর ধরে তাঁর (তসলিমার) চোখের জল ঝরিয়েছিলেন। তাই, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর জন্য আজ তাঁর আর চোখের জল অবশিষ্ট নেই। তসলিমা জানিয়েছেন, ২০০৩ সালের আগে পর্যন্ত এই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সঙ্গেই নন্দনে গিয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আড্ডা দিতেন। প্যারিস থেকে বুদ্ধ ভট্টাচার্যর জন্য উপহার নিয়ে আসতেন। কিন্তু, সেই সম্পর্ক বদলে গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে তসলিমার ‘দ্বিখণ্ডিত’ বইটি নিষিদ্ধ করার ঘটনায়। তসলিমার খেদ, “২০০২ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে সখ্য ছিল। তারপর তাঁর কী হল কে জানে।”
তসলিমা লিখেছেন, “সেদিনই মনে হয়েছিল আমি তাঁর চেয়ে খাঁটি বামপন্থী। আমি নাস্তিক, আমি নারীবাদী, আমি ধর্ম বর্ণ শ্রেণী লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের সমতা এবং সমানাধিকারে বিশ্বাস করি। একটি মৌলবাদি দেশে কিশোর বয়স থেকে আমার আদর্শের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করছি । আমার দ্বিখণ্ডিত বইটিতে আমি রাষ্ট্রের কোনও রকম ধর্ম থাকার বিরুদ্ধে লিখেছিলাম । রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথক করার জন্য লিখেছিলাম বলে তিনি আমার বই নিষিদ্ধ করেছিলেন। ভাবা যায়, একজন বড় বামপন্থী নেতা রাষ্ট্রধম ইসলাম থাকা সমর্থন করতে চান। যুক্তি দেন, তা না হলে মুসলমানরা রাগ করবে।”
কলকাতা হাইকোর্টে দ্বিখণ্ডিত নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল মানবাধিকার সংস্থা এপিডিআর। তারা সেই মামলা জিতেছিল। ফলে, দ্বিখণ্ডিতর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গিয়েছিল। তাতে বুদ্ধ ভট্টাচার্য তাঁর উপরই রেগে আগুন হয়ে গিয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন তসলিমা। আর সেই রাগ থেকেই নাকি তসলিমাকে ভারত থেকে, সম্ভব না হলে কলকাতা থেকে তাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব, এমনটাই দাবি করেছেন লেখিকা। তিনি লিখেছেন, “২০০৭ সালে আমাকে সাড়ে চারমাস গৃহবন্দি রেখেছিলেন, যেন অতিষ্ট হয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাই। কিন্তু কোথাও যাইনি আমি। শেষ পর্যন্ত একটা কুৎসিত নাটক করে তাড়িয়েছিলেন।”
বাংলাদেশ সরকার তসলিমা নাসরিনকে সেই দেশে প্রবেশ করতে না দেওয়ার পর কলকতাতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন বিতর্কিত লেখিকা। বাংলা ভাষার টানে, প্রাণের টানে, কলকাতাতেই থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, ২০০৭-এ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকার তাঁকে তা থেকেও বঞ্চিত করেছিল। সেই অভিমান যে তসলিমার এখনও যায়নি, তা তাঁর লেখাতেই পরিষ্কার। তসলিমা লিথেছেন, “আপদ তো বিদায় হলাম। তিনি নিশ্চয়ই খুব আনন্দে ছিলেন তখন। আর অসহায় নিরীহ নির্বাসিত, নির্যাতিত, সৎ ও আপসহীন মানুষটির জীবন কতটুকু দুর্বিষহ হয়েছিল, সে কথা আজ আর নাই বললাম।” তাঁকে কলকাতা ছাড়া করা নিয়ে কোথাও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কোনও অনুশোচনাও প্রকাশ করেননি। তাই তসলিমার মতে, বুদ্ধদেব মনে করতেন, “তিনি যা করেছিলেন ভাল করেছিলেন। আমার স্বপ্ন সাধ সব চুরমার করে দিয়ে তিনি ভাল করেছিলেন। একজন বাংলা-অন্ত-প্রাণের কাছ থেকে বাংলাকে ছিনিয়ে নিয়ে তিনি ভাল করেছিলেন।”
নিজেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর থেকেও ‘খাঁটি বামপন্থী’ বলে দাবি করা তসলিমা, শেষ লগ্নে জানিয়েছেন, তিনি আত্মায় বিশ্বাস করেন না। পরলোকেও বিশ্বাস নেই। তাই বুদ্ধদেবের আত্মার শান্তি কামনা তিনি করতে পারবেন না। তাই, তাঁর ভাল কাদগুলি স্মরণ করে বিতর্কিত লেখিকা লিখেছেন, “কমরেড, লাল সেলাম।”