ব্রিগেডের গল্প: জঙ্গল কেটে ময়দান বানাতে সময় লেগেছিল দেড় দশক
পলাশির যুদ্ধ থেকে সূত্রপাত, নেহরুর চিতাভস্ম, চিন-রাশিয়ার নেতাদের অভিবাদন, মুজিবুরের জ্বালাময়ী ভাষণ, সব কিছুর সাক্ষী ব্রিগেড। আগামীর রাজনীতি, ময়দানের কথকথা কোন দিকে মোড় নেবে জানা নেই। তবে, ব্রিগেড থাকবে স্বমহিমায়। চলুন এক ঝলকে ঘুরে আসা যাক জঙ্গল কেটে তৈরি হওয়া ময়দানের ২৭৮ বছরের সরণি বেয়ে...

সে দিন পলাশির যুদ্ধের পরিণতি যদি অন্য রকম হত, তাহলে হয়ত কলকাতার ফুসফুস ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের অস্তিত্বই থাকত না। হ্যাঁ, এতটাই সুপ্রাচীন ইতিহাস বুকে নিয়ে কলকাতা তথা বাংলা তথা ভারত এবং বহির্বিশ্বকেও অক্সিজেন জুগিয়ে আসছে এই সবুজায়তন। পরিবেশগত দিক থেকে ব্রিগেডের অবদান কলকাতাতে সীমাবদ্ধ থাকলেও রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক প্রেক্ষিতে ব্রিগেড আক্ষরিক অর্থেই আন্তর্জাতিক। নেহেরু-ইন্দিরা-বাজপেয়ীরা তো আছেনই, এমনকি বুলগানিন-ক্রুশ্চেভ-চৌ এন লাই-শেখ মুজিবের মতো আন্তর্জাতিক চরিত্রদেরও কাছ থেকে দেখেছে ভারতীয় সেনা বাহিনীর এই ময়দান। রবিবার আরও একটি ব্রিগেড, ময়দানের ইতিকথায় যোগ হবে আরও একটি পাতা। সেই অবসরেই এক ঝলকে ঘুরে আসা যাক জঙ্গল কেটে তৈরি হওয়া ময়দানের ২৭৮ বছরের সরণি বেয়ে।
১৭৫৮: জঙ্গল কেটে ব্রিগেড
১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে হেরে গিয়েছিলেন সিরাজ-উদ-দৌল্লা। তার ১ বছর পরেই ১৭৫৮ সালে কলকাতার একেবারে কেন্দ্রে গোবিন্দপুরে ফোর্ট উইলিয়াম তৈরির কাজ শুরু করে ইংরেজরা। ফোর্ট উইলিয়াম তৈরির সেই কাজ শেষ হতে সময় লেগেছিল ১৫ বছর। সেই সময়ই ফোর্ট উইলিয়াম সংলগ্ন জঙ্গল কেটে ফেলে ইংরেজরা। যার ফলেই তৈরি হয় আজকের ময়দান, কিংবা ব্রিগেড। সেই ব্রিগেডে কখনও শেখ মুজিবুর রহমান এসে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছেন। কখনও চেন ফ্ল্যাগ সাজিয়েছে কংগ্রেস। আবার কখনও ময়দানেই এক মঞ্চ থেকে ‘রাজীব হঠাও’ স্লোগান দিয়েছেন জ্যোতি বসু ও অটল বিহারী বাজপেয়ী।
(প্রায় দেড়শো বছর ধরে এই সুবিশাল ময়দানে সেনা মহড়া চলত বলেই জানা যায়)
১৯১৯:ময়দানে দেশবন্ধু
স্বাধীনতার আগে একাধিকবার ব্রিগেডে সেনা মহড়া হয়েছে। হাতে বন্দুক নিয়ে উর্দিধারী সেনা বহুবার ‘কদমতাল’ অভ্যাস করেছে। এই ব্রিগেডেই সভা করেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। তাই কড়া হাতে প্রতিবাদ দমন করতে বিচারপতি সিডনি রাওলাট ৫ সদস্যের ‘সেডিশন কমিশন’ তৈরি করেন। সেই কমিশনের সুপারিশেই কার্যকরী হয় রাওলাট আইন। এই আইনে সরকার বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ যে কোনও ব্যক্তিকে তথ্য প্রমাণ ছাড়াই অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটক করে রাখা যেত। এই কুখ্যাত আইনের প্রতিবাদে বর্তমান শহিদ মিনার ও তৎকালীন অক্টেরলনি মিনারের সামনে সভা করেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস।
১৯৪৯: কার্ফুতেও ব্রিগেড
দেশ তখন সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে। দেশভাগের পর একটু একটু করে গড়ে উঠছে সরকারি ব্যবস্থা। চারপাশে ব্রিটিশ বিদায়ের ছাপ স্পষ্ট। কলকাতাজুড়ে ১৪৪ ধারা। সেই কার্ফু শিথিল হল ২ ঘণ্টার জন্য। আর তাতেই জনজোয়ার ব্রিগেডে। ১৯৪৯ সালের ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বক্তব্য শুনতে হাজির লাখো মানুষ। পরদিন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বড় বড় করে ছাপা হল- ‘ব্রিগেডে ১০ লক্ষ লোক’। তবে হাজারো ঘেরাটোপেও এড়ানো যায়নি বিশৃঙ্খলা। বোমা ফেটে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১ পুলিশকর্মী।

নেহরু কলকাতায়
১৯৫৫: ব্রিগেডে রাশিয়ার কমিউনিস্ট প্রধান
স্বাধীনতার পর একাধিকবার ব্রিগেডে জনসভা করেছেন নেহরু। কিন্তু স্বাধীনতার ঠিক পরে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ব্রিগেড হল ১৯৫৫-এর ব্রিগেড। তখন ভারতে এসেছিলেন রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান নিকোলাই বুলগানিন। এসেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান নিকিতা ক্রুশ্চেভও। সে বার পুষ্প বৃষ্টি হয়েছিল রাস্তায়। রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানকে দেখতে ঢল নেমেছিল গোটা ভারতে। তবে রুশ নেতাদের সম্মান জানানোর জন্য ব্রিগেডই বেছে নিয়েছিলেন নেহরু। সেই মঞ্চে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ও। ২৯ নভেম্বর ব্রিগেডে এত জনসমাগম হয়েছিল যে রীতিমতো চমকে গিয়েছিলেন রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির আধিকারিকরাও।

নিকিতা ক্রুশ্চেভ
১৯৫৬: ব্রিগেডে চিনের রাষ্ট্রপ্রধান
বুলগানিন ছাড়াও ব্রিগেডে পা রেখেছেন বহু বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানরা। ১৯৫৬ সালের ৯ ডিসেম্বর চিনের তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান চৌ-এন-লাইকে স্বাগত জানিয়েছিলেন বিধান রায়। সেই ঐতিহাসিক সভারও সাক্ষী ব্রিগেড। তবে ইতিহাসবিদদের একাংশ বলেন, রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের মতো অতটা ভিড় নাকি হয়নি ৫৬-র ব্রিগেডে।
১৯৬৪: ব্রিগেডে নেহরুর চিতাভস্ম
বারবার নিজের রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য ব্রিগেডকে বেছে নিয়েছেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু। ১৯৬৩ সালের ২ জুলাই ব্রিগেডে শেষ বক্তব্য পেশ করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহরু। ঠিক ১ বছর পর ২৭ মে মৃত্যু হয় তাঁর। তখন বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করে জওহরলাল নেহরুর চিতাভস্ম আনা হয়েছিল ব্রিগেডে। সারা রাত ধরে সেখানে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিল শহরের মানুষ।
১৯৬৬: ব্রিগেডে ইন্দিরা
নেহরুর মৃত্যুর পর কার্যকরী প্রধানমন্ত্রী হন গুলজ়রিলাল নন্দ। এরপর লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, তারপর ফের গুলজ়রিলাল নন্দ। রাজনৈতিক সমীকরণের ফেরে ক্ষমতা আসে ইন্দিরা গান্ধীর হাতে। ১৯৬৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হন ইন্দিরা গান্ধী। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ১৯৬৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ব্রিগেডে প্রথম বার জনসভা করেন ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা।
১৯৬৭: ব্রিগেডে মারমুখী পুলিশ
১৯৬৭ সালে সদ্য গঠিত যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা বাতিল হয়। তার পরিবর্তে গঠিত হয় প্রফুল্ল ঘোষের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের মন্ত্রিসভা। প্রতিবাদে ২২ নভেম্বর ব্রিগেডে সভা করেন যুক্তফ্রন্ট নেতৃত্ব। সেখানে মারমুখী হয় পুলিশ। পুলিশের হাতে প্রহৃত হন একাধিক প্রাক্তন মন্ত্রী।
১৯৬৯: বামেদের বিজয়োৎসব
১৯৬৯ সালে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে যুক্তফ্রন্ট। ব্রিগেডের এই সভায় দেখা গিয়েছিল নকশাল নেতা কানু স্যান্যালকেও।
১৯৭২: ব্রিগেডে ‘তোমার নেতা, আমার নেতা মুজিবুর’
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ। পাক শাসন থেকে বেরিয়ে এসে বুক ভরে শ্বাস নিল বাংলাদেশ। মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণ সমর্থন করেছিল ভারত। একাত্তরের যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার পর ব্রিগেডে এসেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সেই ব্রিগেডে লাখো মানুষ এসেছিলেন। মুজিবুরের উপস্থিতিতে ‘ঐতিহাসিক’ হয়ে উঠেছিল সে বারের ব্রিগেড।

ব্রিগেডে মুজিব
১৯৭৫:ব্রিগেডে জনতা দল
১৯৭৫ সালে প্রথম বার ব্রিগেডে বক্তব্য পেশ করেছিলেন জনতা দলের নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ (জেপি)। ঠিক দু’বছর পর ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে ব্রিগেডে জনসভা করেন জয়প্রকাশ। জেপি-র আন্দোলন শাসনের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল।
১৯৭৭: লাল ব্রিগেড
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তখন সিদ্ধার্থ শংকর রায়। কংগ্রেসের ভরা শাসনে তখন হুল ফুটিয়েছিল বামেরা। জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বিধানসভা ভোটের আগে এই সমাবেশ হয়। তারপর রাজ্যের কংগ্রেস সরকারকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দেয় বামেরা। রাজ্যের মসনদে বসেন জ্যোতি বসু। সেই থেকেই শুরু বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের নিরবিচ্ছিন্ন জয়যাত্রা।
১৯৮৬ ব্রিগেডে পোপ
শুধু রাজনৈতিক নেতারা নয়, ব্রিগেডে সভা করেছেন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরাও। ১৯৮৬ সালে ব্রিগেডে এসেছিলেন ভ্যাটিকান সিটির পোপ দ্বিতীয় জন পল।
১৯৯০ ব্রিগেডে পদ্ম
১৯৯০ সাল রাজ্য তখন লাল শাসন কায়েম। প্রথমবার এই ব্রিগেডেই সভা করল বিজেপি। মঞ্চ থেকে সেদিন হুঙ্কার ছেড়েছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী ও অটল বিহারী বাজপেয়ীরা। রাম রাজনীতি বিশেষ দৃপ্ত করেছিল সেদিনের দুই প্রধান বক্তার কণ্ঠকে।
১৯৯২ ব্রিগেডে ‘বামফ্রন্টের মৃত্যু ঘণ্টা’
কংগ্রেসের ব্রিগেড হত প্রধানমন্ত্রীকে সামনে রেখেই। প্রদেশ নেতৃত্বরা কখনও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে এড়িয়ে ব্রিগেড সভার কথা ভাবেননি। কিন্তু ৯২ সালেই প্রথম যুব কংগ্রেসের হয়ে সেই সভা আয়োজন করেছিলেন তৎকালীন যুব নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যুব কংগ্রেস সে দিন ব্রিগেডে ‘বামফ্রন্টের মৃত্য ঘণ্টা’ বাজানোর ডাক দিয়েছিল। সেদিন এক প্রকাণ্ড নকল ঘণ্টা তৈরি করেছিল সবুজ জনতা।

১৯৯২, ব্রিগেডে মমতা
১৯৯২: পাল্টা সভা বামেদের
২৫ নভেম্বর সভা করেছিল যুব কংগ্রেস। তারপর মাত্র ৯৬ ঘণ্টার ব্যবধানে পাল্টা সভা ডাকে বামফ্রন্ট। জনসমর্থনের বাম আস্ফালন দেখেছিল ২৯ নভেম্বরের ব্রিগেড। বক্তা এক ও অভিন্ন জ্যোতি বসু। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সে দিন অস্বাভাবিক জমায়েত হয়েছিল ব্রিগেডে।
২০০৬: ব্রিগেডে শেষ জ্যোতি
সপ্তম বামফ্রন্ট তৈরির লক্ষ্যে ব্রিগেড জনসভার ডাক দেয় বামেরা। ওই জনসভায় শেষবারের জন্য সশরীরে এসেছিলেন জ্যোতি বসু।

জ্যোতি বসু
২০১১: ব্রিগেডে জয়ী মমতা
৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে প্রথমবার ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই সভা ছিল রাজ্যে জোড়াফুল শিবিরের জয়ের পরে প্রথম বড় কোনও সভা।

ব্রিগেডে মমতা
২০১৯ ইন্ডিয়া ইউনাইটেড র্যালি
লোকসভা ভোটের আগে বিজেপিকে দেশ থেকে উৎখাত করতে ব্রিগেডে ২০টি বিরোধী দলকে একত্রিত করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপি বিরোধী জোটের প্রস্তুতিতে সেদিন ব্রিগেডে ছিলেন শরদ পাওয়ার, কেজরীবাল, ফারুক আবদুল্লাহ, মল্লিকার্জুন খাড়গে-সহ এক ঝাঁক নেতৃত্ব। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ এই ব্রিগেডের সঙ্গে তুলনা করেন ১৯৮৮ সালের বামেদের ‘বিরোধী কনক্লেভের।’ ময়দানের সেই ৮৮-র সভায় ছিলেন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ, জ্যোতি বসু, অটলবিহারী বাজপেয়ী। সকলে হাত ধরে স্লোগান তুলেছিলেন, “রাজীব হঠাও।”

২০১৯-এ লোকসভা ভোটের আগে ব্রিগেডে সভা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তারপর সময়ের চাকা গড়িয়েছে, এখন ২০২১, আবারও একটা ব্রিগেড। বামেদের ব্রিগেড। ছাত্র যুবরা গান বেঁধেছে, “২৮ তারিখ দিন চল ব্রিগেড চল।” একদা শাসক সিপিআইএম, লোকসভা ভোটের বিচারে এখন অনেকটাই পিছিয়ে। তবু ব্রিগেডে খামতি নেই। শহরের অলিগলিতে আড়ি পাতলেই অনুভূত হচ্ছে ব্রিগেডের উষ্ণতা। আগামীর রাজনীতি, ময়দানের কথকথা কোন দিকে মোড় নেবে জানা নেই। তবে, ব্রিগেড থাকবে স্বমহিমায়।
