কলকাতা: কোনও ভবন বা নির্মাণের নামকরণ ব্যক্তি বিশেষের নামে হয়েই থাকে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (CM Mamata Banerjee) নামেও থাকতে পারে। তবে এবার তাৎপর্যপূর্ণ হল দমদমে গড়ে ওঠা তৃণমূলের (TMC) ঝকঝকে নয়া পার্টি অফিসের নাম রাখা হয়েছে ‘মমতাবাদী ভবন’। সেখান থেকেই রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু তাঁর বিধানসভা কেন্দ্রের কাজকর্ম দেখবেন বলেন জানিয়েছেন। ভবনের অন্যতম রূপকার-ও তিনি। এখন প্রশ্ন উঠল ভবনের নামকরণ নিয়ে। কোনও ভবনের নাম কীভাবে ব্যক্তির নামের পর ‘বাদ’ যুক্ত হতে পারে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বাদ বা ইজ়ম আসলে কী? এতগুলো প্রশ্ন উঠে আসছে এই ভবনের নামকরণ নিয়ে।
ব্রাত্যবাবুরা দাবি করেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন দর্শন, ভাবনা, তাঁর জনকল্যাণমুখী ভাবনা একটা মডেল। সেটা তো কোনও তত্ত্ব বা ভাবনা ছাড়া সম্ভব নয়। সেই দিক থেকেই এই ভবনের নামকরণ করা হয়েছে।
দমদম রোডের উপরে তৈরি এই ‘মমতাবাদী’ ভবনটি তিনতলা। তৃণমূলের নয়া পার্টি অফিস। আধুনিক নির্মাণ বলতে যা বোঝায় তার সবই আছে এখানে। কিন্তু রাজনৈতিক মহলের কাছে প্রশ্ন উঠেছে ভবনের নাম নিয়ে। কোনও বাদ বা ইজ়ম তৈরি কীভাবে হয়? কীভাবে গড়ে ওঠে কোনও ইজ়ম? কী বলছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান?
ইজ়ম বা বাদ কখনও রাতারাতি হয় না। একটা ভাবনা বা দর্শনকে ইতিহাস দ্বারা মূল্যায়িত হতে হয়। তবেই তা বাদ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। গান্ধীবাদ হোক বা মার্ক্সবাদ সবকিছুকেই ইতিহাস দ্বারা টেস্টিফায়েড হতে হয়েছে। তবে কেউ যদি এভাবে নামকরণ করতে চান, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার, তা নিয়ে মন্তব্য করতে চাইছি না, জানান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ইমন কল্যাণ লাহিড়ি।
তাঁর কথায়, “মানুষের উপর ভিত্তি করে ইজ়ম বা তত্ত্ব তৈরি হয়। ইজ়ম কে আমরা ইংরেজিতে বলি, অল ইনক্লুসিভ ডকট্রিন। বাংলা করলে দাঁড়ায়, যেটাকে ভাঙা যায় না। ব্যক্তিজীবনে যার সূত্রপাত হয়, তা ইতিহাসের দ্বারা টেস্টিফায়েড হয়। সেটা একদিনে করা যায় না। যে কোনও ইজ়মে আমরা দেখি, সেটা গান্ধীবাদ, মার্ক্সবাদ হোক বা ফ্যাসিবাদ – এগুলোর ইজ়মে পরিণত হতে গেলে সময় লাগে। ইতিহাসে পদ্ধতিগত মূল্যায়নের পর তা কোনও জনসমষ্টির কাছে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ইজ়মে রূপান্তরিত হয়। সেটা একদিনে হয় না। আজ যদি হঠাৎ করে আমি বলি আমার ভাবনাই ইজ়ম হয়ে যাবে তা অসম্ভব।”
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক রচনা দাসের মন্তব্য, “ইজ়ম তৈরি হতে গেলে সাধারণভাবে তার একটা আদর্শ লাগে, তাত্ত্বিক একটা আলোচনা লাগে। সেই জায়গা এখানে আছে বলে মনে হয় না। তবে তৃণমূল বা যে কেউ মনে করতেই পারেন কী নাম তাঁরা দেবেন। এখন বাদ বা ইজ়ম হতে গেলে যাঁরা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়াই তাঁরা জানি যে এর জন্য একটা আদর্শগত আলোচনা লাগে, তাত্ত্বিক আলোচনা হওয়া দরকার। সেই স্কুলস অফ থটে অনেকেই অনেক কিছু বলবেন। সেই জায়গাটা আছে বলে আমার মনে হয় না।”
তিনি আরও যোগ করেন, “মমতাবাদী ভবন নামকরণ আমার ব্যক্তিগত ভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক মনে হয়েছে। অনেকে বলতে পারেন মার্ক্সবাদ-ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক। তবে যে আলোচনার পরিসর দরকার ছিল সেটা এখানে নেই।”
আর এই ভবনের নামকরণ নিয়ে রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের টিপ্পনী, ” মমতাবাদী দর্শন কীভাবে তৈরি হল, বা এই শব্দের কী অর্থ আছে এটা বোঝার মতো মেধাশক্তি আমাদের নেই। এ নিয়ে বিশেষ চর্চা বা গবেষণা করার মতো সময় বা ইচ্ছাও নেই।” তিনি আরও যোগ করেন, যে কেউ তাঁর কল্পনার রঙে কোনও কিছুকে রাঙিয়ে তুলতে পারেন। কোনও মডেল বা কোনও পরিকল্পনা রূপায়ন করতে গেলে দেখতে হবে সে টাকাটা কোথা থেকে আসছে। একদিকে পরিকল্পনা রূপায়িত হচ্ছে অন্যদিকে একটা রাজ্যের মাথার উপরে সাড়ে পাঁচ লক্ষ কোটি টাকার দেনা চেপে বসেছে!”
আর সিপিএম নেতার সুজন চক্রবর্তীর কটাক্ষ, “ব্রাত্য বসু তো শিক্ষামন্ত্রী না কি? নেই তো! তাঁকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কবে খুলবে, লেখাপড়া কবে হবে, সে সব জিজ্ঞেস করলে বলেন, মুখ্যমন্ত্রী সঙ্গে কথা বলতে। আসলে পোস্ট একটাই। বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট। তাঁর (পড়ুন মমতা) নামে ‘বাদ’ হবে। তাঁর নামে পুজো হবে। তাঁর তত্ত্ব হবে। তাঁর নামে মন্দির হবে। এটাই তো হবে। আরএসএস যাঁকে দেবী দুর্গা বলে, তাঁর নামে তৃণমূলের নেতারা ‘বাদ’ তৈরি করবেন। এটাই সময়ের পরিহাস।”
আরও পড়ুন: Bangladesh: বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে কেন চুপ মুখ্যমন্ত্রী, অসন্তুষ্ট বিজেপি