কমলেশ চৌধুরী: ‘এগিয়ে বাংলা’। হ্যাঁ, রাজ্যজুড়ে অ্যাসিড হামলার ঘটনা ‘এগিয়ে’ই রাখছে বাংলাকে। উত্তরপ্রদেশকে টপকে ফের শীর্ষে রাজ্য। দেশের অন্তত ২৮ শতাংশ অ্যাসিড আক্রমণের ঘটনা ঘটছে বাংলাতেই। এই তথ্য উঠে এসেছে সদ্য প্রকাশিত ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (NCRB) ২০২০-র রিপোর্টে।
বাংলা এবং উত্তরপ্রদেশ। এই দুই রাজ্যেই অ্যাসিড হামলার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। পালা করে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে থাকে দুই রাজ্য। এনসিআরবি-র একাধিক বছরের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, দেশের প্রায় অর্ধেক অ্যাসিড হানার ঘটনাও লিপিবদ্ধ হয় দু’রাজ্যের পুলিশের খাতাতেই।
২০১৪ সাল থেকেই ধরা যাক। দেশে মোট হানার ঘটনা ২০৫। উত্তরপ্রদেশ ৪৩, বাংলা ৪১। ২০১৫ সালে দেশে মোট হানা ২২৮। উত্তরপ্রদেশ ৬১, বাংলা ৪১। পরের বছর শীর্ষে বাংলা (৮৩), দুয়ে উত্তরপ্রদেশ (৬১)। দেশে মোট হামলা ২৮১। ২০১৭ সালে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ২৩৫-এ। উত্তরপ্রদেশে ৬০, বাংলা ৫৪। এক বছরের ফারাকে ফের শীর্ষে উঠে আসে বাংলা। দেশে ২২৯, বাংলায় ৫৩, উত্তরপ্রদেশে ৪৩। ২০১৯ সালে দেশে সংখ্যাটা পৌঁছয় ২৪৯-এ। উত্তরপ্রদেশ ৫২, বাংলা ৩৬। ২০২০ সালে কোভিড আর লকডাউনের বছরে দেশে লিপিবদ্ধ হওয়া হামলার ঘটনা কমেছে। কিন্তু দেশে যেখানে সংখ্যাটা ১৮৩, বাংলা-উত্তরপ্রদেশ মিলিয়েই তা ৮৩। অন্য রাজ্য অনেক পিছনে। বলা ভালো, অ্যাসিড হামলা কমিয়ে অনেক ভাল জায়গায়।
অ্যাসিড হামলা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে দীপিকা পাড়ুকোন ‘ছপাক’ সিনেমার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছিলেন আক্রান্ত মালতীর দুর্বিষহ যন্ত্রণার কথা। লক্ষ্মী আগরওয়ালের সেই কাহিনি গোটা দেশ দেখেছে, কিন্তু সচেতনতা আসেনি। বন্ধ হয়নি হামলা। বরং, উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। অ্যাসিড যোদ্ধারা বলছেন, এর অন্যতম কারণ, হামলা বন্ধে সরকারের, প্রশাসনের উদাসীনতা। কলকাতার হিউম্যান রাইটস ল’ নেটওয়ার্কের কো-অর্ডিনেটর অপরাজিতা গঙ্গোপাধ্যায় অ্যাসিড যোদ্ধাদের নিয়ে কাজ করেন। তিনি বলছেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের রায়, খোলা বাজারে অ্যাসিড বিক্রি করা যাবে না। কাউকে বিক্রি করলে নাম-ধাম-কেনার কারণ সব লিখে রেখে থানায় জমা করতে হবে। কিন্তু এ রাজ্যে কোনও নিয়মই মানা হয় না। বাথরুম ক্লিনারের নামে রাজ্যজুড়ে অ্যাসিড বিক্রি হচ্ছে, চাইলেই পাওয়া যায়। কারও কোনও হুঁশ নেই।’
জয়নগরের মণীষা পৈলান ছ’বছর আগে অ্যাসিড আক্রান্ত হন। তাঁর অভিজ্ঞতা, হামলাকারীর সাজা হয় না। তাই সামান্য ভয়-ডরও নেই। মণীষা বলছেন, ‘২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে আমার উপর অ্যাসিড হামলা হয়। অভিযুক্ত বিয়ে করে সংসার করছে। লোকসমক্ষে ঘুরে বেড়াচ্ছে। উল্টে আমি ভয়ে ভয়ে থাকি, আবার যদি হামলা করে! কোর্টে দৌড়েও কোনও লাভ হচ্ছে না। তাও আমি লড়ছি। বহু মেয়ের এই লড়াই করার শক্তিটাও থাকে না। ভয় দেখানো হয়। যেন দোষটা আমাদেরই। পুলিশ-প্রশাসন কেউ দায়িত্ব এড়াতে পারে না। অনেক জায়গায় তো থানার পাশেই মুদির দোকানে অ্যাসিড বিক্রি হচ্ছে!’
২০১৪ সালে দমদমের তরুণী সঞ্চয়িতা যাদবের জীবনে হঠাৎ করেই অন্ধকার নেমে আসে। সঞ্চয়িতা লড়াই ছাড়েননি। সাত বছর ধরে হাইকোর্টে লড়েছেন। শাস্তি হয়েছে হামলাকারীর। সঞ্চয়িতা বলছেন, ‘পুলিশের খাতায় লিপিবদ্ধ হওয়া ঘটনার চেয়ে আসল ঘটনা আরও বেশি। অনেক ঘটনাই ধামাচাপা পড়ে যায়। আমাদের কাছে প্রায়ই হামলার ঘটনার খবর আসে। সামান্য ঝগড়া-বিবাদের মধ্যেই অ্যাসিড ছোড়ার ঘটনা ঘটছে। গ্রামে নয়, কলকাতাতেই। এতে বোঝা যায়,
অ্যাসিড মারা যে একটা অপরাধ, এই ভয়টাই কারও মধ্যে কাজ করে না।’
সাত বছরের মধ্যে তিন বার শীর্ষে বাংলা। চার বার দ্বিতীয়। কুখ্যাতি রাজ্যেরই। তবু কেন সরকার চোখ বন্ধ করে থাকছে, বিস্মিত অপরাজিতা, মণীষা, সঞ্চয়িতারা। অ্যাসিড হামলা কমিয়ে কবে সত্যিই ‘এগিয়ে বাংলা’ হবে? অপেক্ষায় ওঁরা।
আরও পড়ুন: NCRB Report: শিশুঘটিত অপরাধে হাইজাম্প! সবার উপরে বাংলা, তবে পিছিয়ে গো-বলয় থেকে