নৈঃশব্দ্যের শব্দ শুনতে শিখিয়েছেন তিনি, ৯০-এর দোরগোড়ায় আজ কবি শঙ্খ ঘোষ

‘সুপুরিবনের সারি’ ও ‘সকালবেলার আলো’ যেভাবে চেতনার দ্বন্দ্বকে ভরে তোলে, ফিরিয়ে আনে, কবি শঙ্খের যাত্রা শুরু সেখান থেকেই। নিজের রচনায় নিজেকে বোধহয় এভাবেই নিক্ষেপ করতে পারেন শঙ্খ।

নৈঃশব্দ্যের শব্দ শুনতে শিখিয়েছেন তিনি, ৯০-এর দোরগোড়ায় আজ কবি শঙ্খ ঘোষ
শঙ্খের আজ ৯০, নিজস্ব চিত্র
Follow Us:
| Updated on: Feb 06, 2021 | 10:12 AM

তিস্তা রায় চৌধুরী: রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী প্রজন্মে যখন হারিয়ে যাচ্ছিল সৃষ্টির পথ, তখন বাংলা সাহিত্যের পালে প্রাণের জোয়ার এনেছেন শঙ্খ ঘোষ। সেই শঙ্খ ঘোষ যিনি জীবন দ্বন্দ্বের সমীকরণে নতুন করে চিনতে শিখিয়েছেন সাহিত্যকে। বাজারিকরণের দুনিয়ায়, সাহিত্য যখন কেবল পণ্যে পরিণত, তখন নতুন এক জীবনবোধকে তুলে আনলেন শঙ্খ। আর সেই বোধকে যত্নে লালন করতে শিখল বাংলা সাহিত্য।

শৈশবের ‘মিথ্যা কথা’ থেকে চিনতে শেখা সেই চেতন-নিশ্চেতন-অচেতন পর্বের বটবৃক্ষ আজ ৯০ বছরের প্রবীণ। নিজেকে প্রবীণ বলতে যদিও অপারগ শঙ্খ ঘোষের মননের গভীরে আজীবন লালিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। জীবনানন্দ, সমর সেন পরবর্তী খানিকটা ঘেঁটে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া সাহিত্যকে গদ্যে ও ছন্দে ফিরিয়ে এনেছেন শঙ্খ ঘোষ। ‘কুন্তক’ ছদ্মনামে বাংলা ভাষাকে পৌঁছে দিয়েছেন শৈশবের দ্বারপ্রান্তে। বাংলা ভাষাকে ভাল না বাসলেও শঙ্খবাবুর দৌলতে বাংলাকে চিনতে শিখবে আগামী শৈশব।‘ছোট্ট একটা স্কুল’-এর গণ্ডি তাই হয়ে উঠতে পারে বিশ্ব মানচিত্র, এক অখণ্ড দর্শনের জীবন্ত চালচিত্র।

শৈশব সারণীকে খানিক সরিয়ে রাখলে যে পরম জীবনবোধ বার বার তুলে এনেছেন কবি শঙ্খ ঘোষ তাকে বোধহয় খানিকটা চুপ করিয়ে রাখতে পারেন আরেক শঙ্খ। তিনি গদ্যকার শঙ্খ ঘোষ। সদ্য দেশ ভাগের পর এক কিশোর চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে কীভাবে অনেকে ছেড়ে আসছে দেশের মাটি। কী এই দেশ? জীবনের বাঁকে বার বার বদলে যায় দেশের সংজ্ঞার্থ। সেই বদলটাকে চেনালেন শঙ্খ। বোঝালেন দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক। নীলুর দাদুর ‘সুপুরিবনের সারি’ আসলে আমাদের চিনিয়ে দেয় আমাদের সত্ত্বা,অস্তিত্বের সুর। চোখের সামনেই বদলে যায় দেশের সংজ্ঞার্থ। আমরা বুঝতে পারি, দেশ আসলে আমাদের শিকড়। যে শিকড়ের টানে আমরা বেড়ে উঠি। সেখানেই রাষ্ট্রের সঙ্গে দেশের পার্থক্য।

আরও পড়ুন : সুখবর! জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ৪৫তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা

‘সুপুরিবনের সারি’ ও ‘সকালবেলার আলো’ যেভাবে চেতনার দ্বন্দ্বকে ভরে তোলে, ফিরিয়ে আনে, কবি শঙ্খের যাত্রা শুরু সেখান থেকেই। নিজের রচনায় নিজেকে বোধহয় এভাবেই নিক্ষেপ করতে পারেন শঙ্খ। ‘চেতনে অবচেতনে বাঁধি মিল’ এই হয়ে ওঠে শঙ্খের লেখনীর মূল সুর। ‘নিঃশব্দের তর্জনীর’ ভূমিকায় তাই শঙ্খ সহজেই লিখতে পারেন, ‘…কবিতা শেষ অবধি একটা সৃষ্টির কাজ। তাই যখনই দেখতে পাই যে এই এক একটি লেখা হয়ে উঠছে এক একটি সৃষ্টি আর এই একটি অভিজ্ঞতা যা এই প্রথম যেন জেগে উঠল কবির মনে তখনই তাকে বলতে চাই কবিতা।’ শঙ্খের কবিতার এই নির্যাস বার বার এসেছে তাঁর প্রবন্ধে। শঙ্খের প্রবন্ধে তাই উপলব্ধির উষ্ণতা আর যুক্তিমননের শৃঙ্খলায় সমস্ত অপবাহূল্য বর্জিত হয়ে উঠে এসেছে সত্যের উপলব্ধি। যে উপলব্ধিকে রবীন্দ্রনাথ নাম দিয়েছিলেন, ‘সত্যম শিবম সুন্দরম।’

সময়ের দেশের বাসিন্দা শঙ্খ নিজেই বলেছেন, ‘কথাগুলি যেন স্তর থেকে স্তরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে, ভিড় থেকে দূরে,একারই কোনো কেন্দ্রে, নিজের একেবারে মুখোমুখি।’ খুব সহজেই তাই কবিকলমে লেখা হচ্ছে, ‘এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো, শব্দহীন হও/ শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর।’ এখানে ‘আদর’ শব্দটির ব্যবহার অভাবিত। একটি নতুন আশ্চর্যকে কবি উপহার দিলেন এখানে। ‘আদর’ শব্দটিকে ঘিরে যে অর্থস্তর বিদ্যমান, তাকে অতিক্রম করে গিয়ে এই প্রয়োগ একটি নতুন মাত্রা যোগ করল, বিশেষত লাইনের শেষে ‘সম্পূর্ণ মর্মর’ কথাটি থাকার জন্য। …‘ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর’— এখানে ‘র’ বর্ণটি একটি গোপন ও নিরুচ্চার অনুপ্রাসের সৃষ্টি ঘটিয়ে পাঠকের শ্রবণকে পাঠককে প্রায় অজান্তেই মোহিত করে দিল।

অপেক্ষমান পরিবর্তমান নিত্যজায়মান অস্তিত্বের যে ছবি সেই ছবি গড়ে ওঠে দেশকালের বিন্যাসে, being আর becoming-এর মুখোমুখি যে অন্তর্নিবিষ্ঠ ছবি তাই বারবার ফিরে আসে শঙ্খের রচনায়। দ্বন্দ্বের যন্ত্রণা আর বিষাদেই সৃষ্টি, sadness আর plentitude –এর ধারক হয়ে ওঠেন শঙ্খ। সেই শঙ্খ,যিনি একাধারে কবি অন্যদিকে জীবনছবির কাণ্ডারী।