সাঁতরাগাছি ঝিলে কেন আসছে না পরিযায়ী পাখি? নেপথ্যে রাজ্য-রেলের ‘ঠান্ডা লড়াই’, জানুন রহস্য
Santragachi Jheel: জমির লাইসেন্স ফি মকুব নিয়ে রাজ্য-রেলের দ্বন্দ্ব, সাঁতরাগাছি ঝিলের দূষণ ছাড়াচ্ছে সহ্যের সীমা। জমির লাইসেন্স-ফি নিয়ে রাজ্য ও রেলের মধ্যে জটিলতা দূর হচ্ছে কিছুতেই। ক্ষুব্ধ পরিবেশ আদালত। দ্রুত সমস্যা সমাধানের নির্দেশ এলেও বাস্তবের মাটিতে কাজের কাজ কবে হবে? উঠছে প্রশ্ন।
আবাস থেকে একশো দিনের কাজ, নানা ইস্যুতে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত তো লেগেই রয়েছে। এবার আরও সংযোজন। নর্দমা তৈরির জমি নিয়ে প্রবল সংঘাতে রেল-পুরসভা। আর তার জেরেই আটকে নিকাশির কাজ। উদ্বেগ বাড়াচ্ছে সাঁতরাগাছি ঝিলের লাগামহীন দূষণ। নিকাশির জলে চরম দূষণ। ভুগছে জলজ প্রাণী থেকে জলজ উদ্ভিদ। নষ্ট হচ্ছে বাস্তুতন্ত্র। এদিকে জমির লাইসেন্স ফি মকুব নিয়ে রাজ্য-রেলের দ্বন্দ্ব ক্রমেই বেড়েই চলেছে। কিছুতেই কাটছে না জটিলতা। রেগে লাল পরিবেশ আদালত। দ্রুত সমস্যা সমাধানের কথা বলা হলেও আসলে বাস্তবের মাটিতে হচ্ছে না কিছুই। তা নিয়েই তৈরি হয়েছে চাপানউতোর। চর্চা চলছে রাজনীতির পাড়াতেও। পাল্টা রাজ্যকে চেপে ধরছে বঙ্গ বিজেপি। কিন্তু, সমস্যার সমাধান কবে? উত্তর দিতে পারছে না কেউই।
জট কোথায়?
আট বছর আগে সাঁতরাগাছি ঝিল সংলগ্ন জায়গায় এসটিপি তৈরির নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। এসটিপি তৈরির জমির জন্য কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (কেএমডিএ) ও দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ের মধ্যে লিজ়-চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। সেই চুক্তি অনুযায়ী রেলওয়ের ১৪,৯৬২ বর্গমিটার জমিতে ওই এসটিপি হবে বলে ঠিক হয়েছে। ৩৫ বছরের মেয়াদে ওই জমির লাইসেন্স-ফি বাবদ কেএমডিএ ২ লক্ষ ৪৪ হাজার ৫৮৮ টাকা দিয়েছে রেলকে। কিন্তু, সমস্যা দেখা দেয় অন্যত্র। দূষণ নিয়ন্ত্রণে ঝিলের চারদিকে প্রায় ৩০২০ বর্গমিটার নর্দমার মালা (গারল্যান্ড ড্রেনস) তৈরির কথা ছিল। কিন্তু জটিলতা সেই জমির লাইসেন্স-ফি নিয়ে।
এই খবরটিও পড়ুন
মে মাসে রাজ্য নগরোন্নয়ন ও পুর বিষয়ক দফতর রেলের কাছে প্রস্তাব পাঠায়। এই নর্দমার মালা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় জমির লাইসেন্স-ফি বাবদ প্রায় ১.৯২ কোটি টাকা পুরোপুরি মকুব করার আবেদন করে। কিন্তু, তা দিতে নারাজ রেল। মে মাসের শেষেই রেল জানিয়ে দেয়, রেলওয়ে বোর্ডের ‘মাস্টার সার্কুলার পলিসি’ অনুযায়ী, লাইসেন্স-ফি সম্পূর্ণ মকুবের নিয়ম নেই। স্বাভাবিকভাবেই গোটা বিষয়টি জটিলতার মধ্যে আটকে সাঁতরাগাছি ঝিল। কিছুতেই করা যাচ্ছে না ‘শুদ্ধ’। দিনেদিনে আরও খারাপ হচ্ছে পরিস্থিতি। তাতেই চিন্তায় পরিবেশবিদরা। জল গড়িয়েছে পরিবেশ আদালতেও।
উদ্বিগ্ন পরিবেশবিদরা, কী বলছে সরকার?
উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদ সুভাষ দত্তের মতো ব্যক্তিত্বও। তিনি বলছেন, “এত প্রতিকূলতা থাকার পরেও পরিযায়ী পাখিরা প্রতি বছর ওখানে আসে। কিছু একটা আকর্ষণ তো নিশ্চিতভাবে রয়েছে। সে কারণেই ওরা আসে। তাই এই সমস্যার সমাধান না করা গেলে আমাদের তার খেসারত দিতে হবে।” তবে ঝিলের দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্ট তৈরি করা হয়ে গিয়েছে বলে রাজ্যে জানিয়েছে। প্রায় ২৮.৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রস্তাবিত এসটিপি তৈরি, নিকাশির গতিপথ পরিবর্তন-সহ যাবতীয় কাজ করা হবে। পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলছেন, “রেলের জন্য কী কী অসুবিধা হচ্ছে তা জানতে হাওড়া পৌরসভাকে বলেছি। ওরা লিখিত আকারে সবটা জানাক। তারপর ফের একবার রেলের সঙ্গে বসব।”
কী বলছে রেল?
সূত্রের খবর, ৩০২৪ বর্গমিটার এলাকায় গারল্যান্ড ড্রেন হওয়ার কথা রয়েছে। এদিকে এলাকার প্রায় ৩৫ শতাংশ এলাকায় দাপট দখলদারদের। বেআইনিভাবে ওই জমিতে চলছে বাস। রয়েছে বাজার, ঝুপড়ি। কিন্তু, তাদের তোলা না গেলে কোনওভাবেই ওখানে ড্রেন তৈরি সম্ভব নয় বলে মনে করছে রেল। যদিও গোটা কাজ থমকে যাওয়ার পিছনে দখল হওয়া জমি উদ্ধারে রাজ্য সরকারের গড়িমসিকে দুষছেন পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত। সরাসরি বলছেন, “দখলদারদের নিয়ে রাজ্য সরকার এখনও কোনও নীতি গ্রহণ করেনি। শুধু বলেছিল আমরা কখনওই তুলব না। এদিকে রেল পুলিশি সাহায্য চেয়েছিল গোটা কাজের জন্য। কিন্তু সেটাও তাঁদের দেওয়া হয়নি।” এই ইস্যুতে মুখ খুলেছেন দক্ষিণ-পূর্ব রেলের জনসংযোগ আধিকারিক সোপান দত্ত। বলেন, “দখল হয়ে যাওয়া জায়গা নিয়েই সবথেকে বেশি সমস্যা। ওই এনক্রোচমেন্ট (Encroachment) সরে গেলে গারল্যান্ড ড্রেন তৈরিতে সুবিধা হবে। ল্যান্ড লাইসেন্সের জন্য নতুন আইন এসেছে। ফলে টাকার অঙ্কটাও অনেকটাই কমে গিয়েছে। তাছাড়া বিষয়টা আদালতের বিচারাধীন রয়েছে। আদালত যা নির্দেশ দেবে সেরকমই আমরা কাজ করব।”
চাপানউতোর চলছে রাজনৈতিক মহলেও। রাজ্যকে আক্রমণ করেছেন বিজেপি নেতা সজল ঘোষ। খোঁচা দিয়ে বলছেন, “এই সরকারের কাছে প্রচুর টাকা। এই সরকার মানুষকে ডিএ দেয় না। মানুষকে চাকরি দেয় না। সমস্ত পদ শূন্য করে এই সরকার সিভিক দিয়ে কাজ করায়। খেলা-মেলায় খরচ করে। তাদের ট্যাক্স কেন মুকুব হবে?” মাঠে রয়েছে বামেরাও। একযোগে সুর চড়িয়েছে রাজ্য-কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। সিপিআইএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলছেন, “এটা তো বিনা কারণে ঝগড়া। কর্তৃত্বের ঝগড়া। এটা ওরা মেটাক। দূষণের সঙ্গে কিন্তু কোনওভাবেই সমঝোতা করা যায় না। ব্যবস্থা নিতেই হবে।” চাপানউতোর তো চলছে, দোষারোপ-পাল্টা দোষারোপের খেলাও চলছে। কিন্তু, সমাধান কোথায়? উত্তর নেই কারও কাছেই। এদিকে দীপাবলির রিপোর্ট বলছে বিগত কয়েকদিনে দূষণের নিরিখে একেবারে দিল্লির সঙ্গে কড়া টক্কর দিয়েছে বাংলা। ভেঙেছে অতীতের রেকর্ড। দূষের চাদরে ঢাকা পড়েছে তিলোত্তমা। এখন দেখার সাঁতরাগাছি ঝিলের ভাগ্য বদলায় কিনা!