Mughal Food Recipe Part VI: খানা খানদানি-পর্ব ১৪, কিস্সা কাহিনি মোড়া কোফতা আর দোপেঁয়াজির টানাপোড়েনের রান্না
অব্দ্ অল-মোমিন ওরফে মোল্লা দোপিয়াজ়াহ্। জন্ম ভারতে। কিন্তু তিনি ১৫৮২-তে হিন্দ ছেড়ে ইরানে চলে যান। ফেরেন ছত্রিশ বছর পরে। তাঁর গোর রয়েছে মধ্য ভারতের হাণ্ডিয়া নামের কোনও প্রত্যন্ত জনপদে। ইনিই নাকি মাত্র দু’টি পেঁয়াজ দিয়ে বাদশাহকে এক পরমাশ্চর্য মাংস রেঁধে খাইয়েছিলেন। সেই থেকেই দোপিয়াজ়াহ্-র চল।
দোপিয়াজ়াহ্ কোফতা লবাবদার।
Follow Us
নীলাঞ্জন হাজরা: পর্ব ১৪
দোপিয়াজ়াহ্ কোফতা লবাবদার—নামটার মধ্যেই যে কত মজার কিস্সা ঠাসা আছে সে কথা উত্থাপন করেই শেষ করেছিলাম গতকাল। এই রান্নাটার মজা এখানেই যে এটা দু’টি খাস ইসলামি রান্নার মধ্যে দুরন্ত টানাপোড়েনের কাহিনি। কোফতা এবং দোপিয়াজ়াহ্। দু’টিই অজস্র উপায়ে রাঁধা হয়ে থাকে। আবার এ-ও মনে রাখা দরকার এর মধ্যে একটি—দোপিয়াজ়াহ্—আসলে রান্নার পদ্ধতি, আর কোফতা রান্নার বস্তু।
অ্যালান ডেভিডসনের Oxford Companion to Food (২০১৪) খুললেই দেখা যাবে ‘কোফতা’ এসেছে ফারসি শব্দ ‘কুফতে’ থেকে। মশলাপাতি, নুন দিয়ে পিটিয়ে-পিটিয়ে, পিটিয়ে-পিটিয়ে মিহি করে ফেলা মাংসের গোলক, হতে পারে বিভিন্ন মাপের। কতক্ষণ পেটাতে হবে? কোফতার অন্যতম সেরা রন্ধনক্ষেত্র উত্তর ইরানের ত্যাবরিজ়। সেখানের এক মহিলা ডেভিডসনকে দিয়েছিলেন এর সহজ উত্তর—যতক্ষণ না হাত দু’টো ছেড়ে পড়ে যায়! আবার সেরা পারসিক কুফতের মাঝখানে পোরা থাকবে কিছু না কিছু—সিদ্ধ ডিম, নানা কিসিমের বাদাম, ভাজা পেঁয়াজ ইত্যাদি। তারপর তাকে নানা স্বাদের ঝোলে চুবিয়ে কিংবা ঝলসে কিংবা সিদ্ধ করে কিংবা ভেজে রান্না।
এই কুফতের প্রথম কুকবুকে আবির্ভাব একটি আদি-মধ্যযুগের আরবি পাকপ্রণালী কেতাবে। কোন কেতাব? আমি বার করতে পারিনি। আমার কাছে বাগদাদের দু’টি এবং আন্দালুসিয়ার একটি আরবি কুকবুকের তরজমা আছে। তার কোনওটিতেই নেই। তবে এই কুফতে কাছাকাছি নাম নিয়ে কালে-কালে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে—মরোক্কোতে কেফতা, বুলগেরিয়াতে কিয়ুফতে, আলবানিয়াতে কোফতে, গ্রিসে কেফতে, আরমেনিয়াতে কুফতে, তুরস্কে কোফতে আর আফগানিস্তানে ও ভারতে কোফতা। মুঘল দস্তরখওয়ানে সব থেকে বিখ্যাত কোফতাটির নাম নারগিসি কোফতা। নারগিস ফুল, ইংরেজিতে Narcissus। মাঝখানটা তার গাঢ় হলুদ। এ কোফতারও তাই। সে রান্নাও করা যাবে অন্য কোনও দিন। এই হল কোফতা-কিস্সা।
দোপিয়াজ়াহ্-র কিস্সা আরও এক কাঠি ওপরে। ইন্টারনেট খুললেই দেখা যাবে ভূরি-ভূরি লেখা বলছে মহামতি আকবর বাদশাহর জমানায় (১৫৫৬-১৬০৫) মহেশ দাস ওরফে বিরবল একাই নিজের প্রখর রসিকতায় সক্কলকে কাত করতেন না, তাঁরও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। নাম অব্দ্ অল-মোমিন ওরফে মোল্লা দোপিয়াজ়াহ্। জন্ম ভারতে। কিন্তু তিনি ১৫৮২-তে হিন্দ ছেড়ে ইরানে চলে যান। ফেরেন ছত্রিশ বছর পরে। তাঁর গোর রয়েছে মধ্য ভারতের হাণ্ডিয়া নামের কোনও প্রত্যন্ত জনপদে। ইনিই নাকি মাত্র দু’টি পেঁয়াজ দিয়ে বাদশাহকে এক পরমাশ্চর্য মাংস রেঁধে খাইয়েছিলেন। সেই থেকেই দোপিয়াজ়াহ্-র চল।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোফেসর ইমেরিটাস, উর্দুর বিদগ্ধ পণ্ডিত এক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন বিরবল বাস্তব চরিত্র হলেও মোল্লার অস্তিত্ব বাস্তব নয়। ইনি মধ্য এশিয়া ও ইরানের লোকগাথার একটি চরিত্র, যাঁকে পাওয়া যায় আকবরের কালের বহু আগে থেকেই।
কাজেই দু’টি পেঁয়াজ দিয়ে দোপিয়াজ়াহ্ রান্নার গপ্পো ধোপে টেকে না। রান্নাটা করলেই দেখা যাবে, এতে দু’ বার পেঁয়াজ ভাজা প্রয়োজন। সেই থেকে দোপিয়াজ়াহ্ বা আমাদের দোপেঁয়াজি। আর এই দোপেঁয়াজিও হতে পারে হরেক কিসিমের। যেমনটা আগেই দেখেছি, এই আলোয়ান-এ-নি’মতেই আছে সাত রকমের দোপেঁয়াজির প্রকরণ। আর তার সবই যে আমিষ বা মাংসের হতে হবে, তা মোটেই নয়। শেষ পদটির নাম ‘দোপিয়াজ়াহ্ চৌলাই’, নটে শাকের দোপেঁয়াজি!
কিস্সা অনেক হল, এবার রান্নাটা করা যাক। সেটার জন্য মূল রেসিপিটা আর একবার দেখে নিয়ে কয়েকটা কথা বলা জরুরি —
মূল রেসিপি—
মাংস—সোয়া সের (১ কেজি. ৪৯.৫ গ্রাম)
ঘি—আধ সের (৪১৯.৮ গ্রাম)
দারুচিনি—৪ মাশা (৪ গ্রাম)
লবঙ্গ, ছোটো এলাচ—৩ মাশা (৩ গ্রাম)
পেঁয়াজ—আধ সের (৪১৯.৮ গ্রাম)
আদা—৬ তোলা ৮ মাশা (১২৮ গ্রাম)
ধনে—আদার সমান
নুন—তারই সমান
এক সের মাংস বাদামের মাপের টুকরো করে ঘি আর পেঁয়াজ দিয়ে সাঁতলে নিন। তারপর তাকে ওপর-নীচে করে নেড়ে নিলাম। অল্প পরে এক পোয়া মাংস কিমা করে ঘি আর পেঁয়াজ দিয়ে সাঁতলে নিলাম। তার মধ্যে নুন, ধনে আর জল দিয়ে দোপেঁয়াজি করে নিন। অল্প পরে এক তোলা ৮ মাশা কাঁচা কিমা এবং তার মধ্যে তার অর্ধেক চর্বি দিয়ে তার মধ্যে পেঁয়াজ আর আদা দিয়ে শিলে বেটে নিন। তারপর এক তোলা ৮ মাশা ময়দা দিয়ে গোটা কিমাটার কোফতা বানান। এবং সেগুলোকে ঘিতে ভেজে নিন। এবং টুকরোর দোপেঁয়াজির সঙ্গে মিশিয়ে দিন। যখন কোফতাগুলো ঝোলে গুলে যাবে এবং একটুখানি লবাব থেকে গেল তখন মশলা দিয়ে চুলা থেকে তুলে নিন। এবং জ়াফরান জলে গুলে ঝোলে দিয়ে দিন।
প্রথমেই খটকা লাগবে বাদামি মাপের মাংস টুকরো করা নিয়ে। মনে রাখুন, এ ক্ষেত্রে ‘বাদামি’ মানে আখরোটের মাপের। মানে ছোটো পিস্, কিন্তু কুচি-কুচি নয়।
এর আগের কোনও একটি লেখায়, এই সিরিজেই, লিখেছিলাম মধ্যযুগীয় কুকবুক রচনাকারদের সমস্যার কথা। বাদশাহি বাওর্চিকে রেসিপি আউড়াতে রাজি করিয়ে কোনও সাধারণ কলমচির পক্ষে তা টুকে নেওয়া যে কী সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জ হতে পারে, তা বোঝাতে একটা কিস্সা শোনাই। আলোয়ানের তরজমার শত খানেক বছর আগের কথা। লখনওয়ি খানদানি অন্দরমহলের। শোনাচ্ছেন আব্দুল হালিম শরর। তাঁর যুগান্তকারী স্মৃতিকথাতে —‘হিন্দুস্তানমে মশরিকি তমদ্দুন কা আখরি নমুনা ইয়ানি গুজ়িশ্তা লখনও’ (হিন্দুস্তানে পূর্বী সংস্কৃতির শেষ নমুনা অর্থাৎ পুরনো লখনও)। তখন লখনওয়ের নবাব আসফ উদ-দৌলা (রা. ১৭৭৫–১৭৯৭)। তাঁর জবানিতেই কিস্সাটা এ রকম, ‘‘অসফ উদ-দৌলার সামনে হাজির এক নয়া বাওর্চিকে নিয়ে একটা গপ্পো আছে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘কী রাঁধেন ভাই আপনি?’। তিনি জবাব দিলেন, ‘আজ্ঞে, আমি শুধু ডাল রাঁধি।’ এরপর যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল কত মাইনে চান, তিনি বললেন ‘পাঁচশো টাকা’। নবাবজাদা তাঁকে চাকরি দিতে রাজি হয়ে গেলেন, কিন্তু বাওর্চি জানালেন চাকরি তিনি নিতে পারেন কয়েকটি শর্তে। জিঞ্জাসা করা হল, কী শর্ত। তিনি বললেন, ‘জাহাঁপনার যদি আমার হাতের ডাল খেতে হয় তা হলে আমাকে একদিন আগে জানাতে হবে, আর ডাল রান্না হওয়া মাত্র তা খেতে হবে।’ নবাব রাজি হয়ে গেলেন, এবং কয়েক মাস পরে সেই ডাল পাকানোর হুকুম দিলেন। বাওর্চি রান্না করে নবাবকে জানালেন, নবাব বললেন, ‘এক মিনিট, দস্তরখওয়ান লাগাও, এই এলাম বলে।’ দস্তরখওয়ান পাতা হলে কী হবে নবাব কারও একজনের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন। বাওর্চি ফের নবাবকে মনে করালেন, নবাব এলেন না। তৃতীয়বার মনে করানোর পরেও নবাব খেতে না আসায়, বাওর্চি ডালের পাত্রটা তুলে একটা শুকিয়ে যাওয়া গাছের গোড়ায় সব ডাল ফেলে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। নবাবের পরে খুব অনুশোচনা হল, এবং সেই বাওর্চিকে খুঁজে আনতে লোক পাঠালেন, কিন্তু কোত্থাও তাঁর দেখা মিলল না। কিছুদিন পরে দেখা গেল যে গাছটার নীচে সেই ডাল ফেলা হয়েছিল তা ফুলে ভরে গেছে।’’ কোনও সন্দেহ নেই ঘটনাটা রং চড়িয়ে বলা হয়েছে, নিজেই লিখছেন শরর, কিন্তু এমন বিস্তর কিস্সা থেকে বোঝা যায় ইসলামি বাদশাহি, নবাবি সংস্কৃতিতে বাবুর্চিদের কী দাপট ছিল। কাজেই কল্পনা করুন, যে ব্যক্তিকে এ হেন রকাবদারদের কাছ থেকে রেসিপির পর রেসিপি আদায় করতে হচ্ছে তার অবস্থাটা কী।
আর পাঁচটা ক্ষেত্রের মতো বোঝাই যাচ্ছে এ রেসিপিতেও অল্প বিস্তর গোলমাল রয়েছে। আদা ৬ তোলা ৮ মাশা মানে প্রায় ১৩০ গ্রাম। ধনে ও নুনও ১৩০ গ্রাম করে—এ সবই আমার খুবই গোলমেলে মনে হয়েছে। সেগুলো ঠিক করে, ওজনে একটু রদবদল করে আমার রেসিপি দাঁড়াল এ রকম।
মাংস—১২৫০ গ্রাম (মাংস টুকরো ৯০০ গ্রাম। ২৫০ গ্রাম, ১০০ গ্রাম করে কিমা দু’ ভাগে)
চর্বি—৫০ গ্রাম
ঘি—১৫০ গ্রাম
দারুচিনি—৪ গ্রাম
লবঙ্গ, ছোটো এলাচ—৩ গ্রাম
পেঁয়াজ—৬০০ গ্রাম। (৩০০ গ্রাম, ২০০ গ্রাম, ১০০ গ্রামে ভাগ করা)
আদা—৫০ গ্রাম
ধনে—৫০ গ্রাম
নুন—স্বাদ মতন
কর্ন ফ্লাওয়ার—প্রয়োজন মতন
৮৫০ গ্রাম মাংস বাদামের মাপের টুকরো করে ঘি আর পেঁয়াজ দিয়ে ভাল করে সাঁতলে নিলাম। সরিয়ে রাখলাম। অন্য কড়াইতে ২৫০ কিমা করা মাংস ঘি আর পেঁয়াজ দিয়ে ভাল করে সাঁতলে নিলাম। এই কিমার মধ্যে সরিয়ে রাখা সাঁতলান টুকরো মাংস, ধনে, নুন আর জল দিয়ে দোপেঁয়াজি করে নিলাম। সরিয়ে রাখলাম। এর পরে ১০০ গ্রাম কাঁচা কিমা এবং তার মধ্যে ৫০ গ্রাম চর্বি, অল্প পেঁয়াজ, সামান্য আদা, সামান্য ধনে এবং নুন দিয়ে বেটে নিলাম। তারপর প্রয়োজন মত কর্নফ্লাওয়ার মিশিয়ে গোটা কিমাটার কোফতা বানালাম। এবং সেগুলোকে ঘিতে ভেজে নিলাম। (এইটিই এ রান্নার কঠিনতম কাজ। মুঘল হেঁশেলে তো ডুবো ঘিতে চুবিয়ে ভাজা হত, তবেই না আধ শের ঘি! বাড়িতে অল্প ঘিতে ভাজতে হবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে, সাবধানে, ধৈর্য্য ধরে।) এবং ভাজা কোফতাগুলো টুকরোর দোপেঁয়াজির ঝোলে ফেলে দিলাম। ভাল করে ফুটিয়ে ঝোল গাঢ় করে নিতে হবে। লবাব কথাটার আক্ষরিক অর্থ লালা। ‘লবাবদার’ বাংলায় যাকে বলবে ‘ল্যাসলেসে’, সহজার্থে বেশ গাঢ়। তা হলে দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ দিয়ে চুলা থেকে তুলে নিলাম। এবং জ়াফরান জলে গুলে ঝোলে দিয়ে দিলাম। গরম ভাত বা যে কোনও রকম রুটির সঙ্গে পরিবেশন করলাম।