১৯০২ সালের ৪ জুলাই। ভারতীয় বেদান্ত দর্শনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক স্বামী বিবেকানন্দের প্রয়াণ দিবস। সারা বিশ্বের হিন্দুধর্ম ও দর্শন প্রচারে একলব্য বীর সন্ন্যাসী দেহত্যাগ হয় মাত্র ৩৯ বছরে। তাঁর নশ্বর দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হলেও চিরন্তন হয়ে রয়েছে তাঁর অমর বাণী। বিবেকানন্দের মৃত্যু নিয়ে কোনও রহস্য সেই ভাবে না থাকলেও মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কিছু ভিন্ন মত ও ধারণা রয়েছে।
১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি কলকাতায় তাঁর জন্ম হয় । স্বামী বিবেকানন্দ সন্ন্যাস জীবন নেওয়ার আগে নরেন্দ্র নাথ দত্ত নামে পরিচিত ছিলেন। ভারতীয় দর্শনের বেদান্ত শাখা এবং যোগচর্চার মাহাত্ম্য তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য দুনিয়ার সামনে তুলে ধরেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে পৃথিবীর সামনে হিন্দুধর্মের গুরুত্ব মেলে ধরেন তিনি। বিভিন্ন ধর্মমতের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক স্থাপনের কৃতিত্বও তাঁকে দিয়ে থাকেন অনেকে। রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা করেন স্বামী বিবেকানন্দ। পরাধীন ভারতে হিন্দুত্বের নবজাগরণ এবং জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটান তিনি। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতা, যার শুরু ‘হে আমার আমেরিকার ভাই ও বোনেরা…’, তার মাধ্যমেই পাশ্চাত্য সমাজে প্রথম হিন্দুধর্মের মাহাত্ম প্রচার করেন তিনি।
আরও পড়ুন: সিদ্ধিলাভের আশায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন রামকৃষ্ণ! জানতেন?
“শরীরমম ব্যধিমন্দিরম”, অর্থাৎ শরীর ব্যাধির মন্দিরে পরিণত হয়েছিল। স্বামীজি সর্বদা শারীরিক শক্তির উপর জোর দিয়ে এসেছেন, তিনি বলেছিলেন, “বসে গীতা পড়ার চেয়ে মাঠে ফুটবল খেলা ভাল।”আশ্চর্যের বিষয় হল, স্বামীজীর একমাত্র প্রিয় ভক্ত ভগিনী নিবেদিতাকে মৃত্যুর তিনদিন আগেই মৃত্য়ুর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। ১৯০২ সালে ২ জুলাই, নিবেদিতাকে নেমন্তন্ন করে পরম যত্নে নিজের হাতে করে খাইয়েছিলেন তিনি। বারে বারে নানাভাবে ইঙ্গিত দিলেও সেই মুহূর্তে বুঝতে পারেননি যে, স্বামীজী নিজেই মহাপ্রয়াণের কথা বলছেন। গুরুর মৃত্য়ুর পর তাঁর কথাগুলি স্মরণ করে বুঝতে পারেন। ২০০৩ সালে বাঙালী উপন্যাসিক শঙ্কর ‘জানা অজানা বিবেকানন্দ বলে একটি বই লেখেন। সেখানে লেখক লিখেছেন, ৪ জুলাই, স্বামীজীর মৃত্যু একই সময়ে ( ৯:১০ এ) ভগ্নী নিবেদিতা স্বপ্নে দেখেছিলেন, রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের দেহ দ্বিতীয় বার ধরাধাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তাহলে কি স্বামীজির দেওয়া দ্বিতীয় মৃত্যুর বার্তা এটিই ছিল!
শুধু তাই নয়, স্বামীজি তার অনুগামী স্বামী অভেদানন্দকে তার মৃত্যুর ৫ বছর আগেই তার মহাপ্রয়াণে কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন । তিনি বলেছিলেন , ” বুঝলে অভেদানন্দ আমি হয়তো আর পাঁচ ছয়েক বছর বাঁচবো, আমার আত্মা দিন দিন বড় হয়ে যাচ্ছে । এত বড় হয়ে যাচ্ছে যে,শরীরের মধ্যে থেকে তাকে আর ধরে রাখা যাচ্ছে না , সে বারে বারে এ শরীর ছেড়ে পালাতে চাইছে “।
তাঁর লেখা বই থেকে জানা যায়, ৪ জুলাই, তাঁর মহাপ্রয়াণের দিন স্বামীজি অত্যন্ত সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়েছিলেন। বেলুড় মঠের প্রার্থনা গৃহে তিন ঘণ্টা ধ্যান করেন তিনি। এরপর ছাত্রদের শুক্লা-যজুর্বেদ, সংস্কৃত ব্যকরণ ও দর্শনশাস্ত্র শেখান। পরে স্বামী প্রেমানন্দের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করেন তিনি, আলোচনা করেন রামকৃষ্ণ মঠের ভবিষ্যত্ নিয়ে। সেদিন বেলুড়ঘাটে জেলের নৌকো ভিড়েছিল। নৌকো ভর্তি গঙ্গার ইলিশ মহোত্সাহে কিনিয়েছেন বিবেকানন্দ। সবার সঙ্গে বসে দুপুরে খেয়েছেন ইলিশের নানা পদ। অনেকেই মনে করেন স্বামীজি নিরামিষাশী ছিলেন। যদিও এ কথা সত্য নয়। তিনি মাছ-মাংস খেতেও যথেষ্ট পছন্দ করতেন বলে জানা যায়। রামকৃষ্ণ মিশনে থাকাকালীন সময়েও তিনি শুধু নিরামিষ আহার গ্রহণ করতেন না। সন্ধে ৭টা নাগাদ নিজের ঘরে চলে যান তিনি। বলে যান, এখন কেউ যেন তাঁকে বিরক্ত না করে। ঘরে গিয়ে ধ্যানে বসেন তিনি। ধ্যান করতে করতেই রাত ৯টা ১০ মিনিটে আনন্দলোকে যাত্রা করেন এই বীর সন্ন্যাসী।
আরও পড়ুন: বুদ্ধের এই ৫ বাণী মেনে চললে ব্যাপক বদল আসবে আপনার জীবনে!
উল্লেখ্য, শিষ্যদের মতে, বিবেকানন্দ মৃত্যুর আগে মহাসমাধি লাভ করেছিলেন। যদিও মস্তিষ্কের রক্তনালী ফেটে যাওয়াই মৃত্যু সম্ভাব্য কারণ হিসেবে দাবি করছে ডাক্তারি রিপোর্ট। তাছাড়া বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিলেন। মৃত্যুর আগে ২ বার হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। মৃত্যুর দিনও ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল বলে ডাক্তারদের ধারণা। তবে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ ডাক্তাররাও নিশ্চিত করে বলতে পারেননি। তাঁর শিষ্যদের দাবি, মহাসমাধির সময় মস্তিষ্কের ব্রহ্মরন্ধ্র ফেটে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।মৃত্যুর মাত্র তিনদিন আগে বেলুড় মঠে ঘুরতে ঘুরতে একটা জায়গায় তাঁর চোখ যায়। সেখানে নির্দেশ করে স্বামীজি বলেছিলেন, “আমার দেহ গেলে ঐখানে সৎকার করবি।” বেলুড়ে গঙ্গার ধারে সেই স্থানেই চন্দনকাঠের চিতায় দাহ করা হয় তাঁকে। ১৬ বছর আগে ঠিক এর উল্টোদিকে দাহ করা হয়েছিল শ্রী রামকৃষ্ণকে। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব একবার বলেছিলেন, নরেন যবে বুঝতে পারবে তার কাজ সম্পন্ন হয়েছে, তখন সে নিজেই চলে যাবে। স্বয়ং বিবেকানন্দই বলেছিলেন, ৪০ বছরের আগেই তিনি চলে যাবেন। স্বামীজির যখন মৃত্যু হয়, তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৯ বছর, ৫ মাস, ২৫ দিন। সেই পূর্বনির্ধারিত স্থানে স্বামীজির চিতা জ্বলে ওঠার পর যেন এক নিমেষে শূন্য হয়ে যায় বেলুড়।
তথ্যসূত্র- অচেনা অজানা বিবেকানন্দ/ শংকর