৬ মাসের সন্তানকে কোলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই, মুর্শিদাবাদের প্রথম অনলাইন সেলিং গ্রুপের অ্যাডমিন সৌমিতার গল্প লাখো মানুষের অনুপ্রেরণা
সৌমিতা এই গ্রুপটি শুরু করেছিলেন নিজে কিছু করার কথা ভেবে। তবে সেই সময় ভাগ্য যেন তাঁর সহায় ছিল। সঙ্গে পরিশ্রম। শুরুর পরে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি সৌমিতাকে
একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তা। কোনও পণ্যের প্রোমোশন হোক বা কেনা-বেচা, চোখ বন্ধ করে এখন অধিকাংশ মানুষের ভরসা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। অন্য দিকে স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে ব্যবসা তৈরি করার জন্য এর থেকে ভাল প্ল্যাটফর্ম বোধ হয় দ্বিতীয়টি নেই। অথচ এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ঝক্কিও অনেক। কখনও হ্যাকিংয়ের চিন্তা, কখনও বা বেনিয়মের জন্য প্ল্যাটফর্ম হারানোর ভয়। অনলাইন দুনিয়ায় জনপ্রিয়তার এই লড়াইয়ে কেউ টিকে থাকেন, কেউ বা হারিয়ে যান। তবে সৌমিতার গল্পটা কিন্তু একদম অন্যরকম। হাজারো প্রতিকূলতার ভিড়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাঁর তৈরি করা ফেসবুক গ্রুপ ‘বিউটি উইথ ফ্যাশন’।
সৌমিতা এই গ্রুপটি শুরু করেছিলেন নিজে কিছু করার কথা ভেবে। তবে সেই সময় ভাগ্য যেন তাঁর সহায় ছিল। সঙ্গে পরিশ্রম। শুরুর পরে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি সৌমিতাকে। মাত্র ৩ মাসের মধ্যেই ৮০০০০-রও বেশি ফলোয়ার্স পেরিয়ে যায় ‘বিউটি উইথ ফ্যাশন’-এর। রমরমিয়ে বাড়তে থাকে বাজার।
তখন সদ্য মা হয়েছেন সৌমিতা। বুকে জড়িয়ে বড় করছেন সন্তানকে। আর পাঁচটা গৃহস্থের মতোই জীবন কাটছিল সৌমিতার। কিন্তু সেই গতে বাধা জীবন থেকে বেরিয়ে তাঁর ইচ্ছে ছিল নিজের কিছু করার। সাধারণ প্রসাধনীর ব্যবসা চালাতেন সৌমিতা। তবে নিজের মতো করে। যদিও নিজের ব্যবসা নিয়েই গুটিয়ে থাকেননি সৌমিতা। তাঁর মনে ছিল অদম্য জেদ। তাঁরই মতো অন্যদের প্রতি চিন্তা। সেই সময় একটাই কথা মনে হত সৌমিতার — ‘আমি পারলে অন্য কেউ কেন পারবে না?’
সেই ভাবনা থেকেই এই গ্রুপের উপরে জোর দিতে থাকেন সৌমিতা। চলে দিন-রাত গ্রুপের দেখভাল। সেখানেই বেচা-কেনা, প্রসাধনী সাজিয়ে রাখা ইত্যাদি। বাড়তে থাকে অনলাইন সেলারদের সংখ্যা। খুব কম সময়েই এই গ্রুপটিকে ভালবেসে ফেলেন মানুষ। বাড়তে থাকে ফলোয়ার্স। মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ১ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। বলা বাহুল্য, সেই সময় এই ফেসবুক গ্রুপটির ব্যপ্তি বেশ নজর কেড়েছিল। বড় ব্র্যান্ডের ফেসবুক গ্রুপগুলিকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল সৌমিতার গ্রুপ ‘বিউটি উইথ ফ্যাশন’।
সবটা ঠিক চলতে থাকলেও হঠাৎ যেন কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে সৌমিতার জীবনে। হঠাৎ করেই হ্যাক হয় সৌমিতার গ্রুপটি। মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ে। সৌমিতার সন্তানের বয়স তখন মাত্র ছ’মাস। গ্রুপ বাঁচাতে সেই অবস্থাতেই কলকাতা চলে আসেন সৌমিতা। ফিরে পাওয়ার জন্য যাৎপরনাই চেষ্টা করতে থাকেন তিনি। একটাই লক্ষ্য, যে ভাবেই হোক গ্রুপটাকে বাঁচাতে হবে। যদিও শত চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি সেই গ্রুপ।
ঘটনার পরে ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছিলেন সৌমিতা। এত বড় পরিবারকে কেউ কখনও হারাতে চায়? এই প্রসঙ্গে সৌমিতা বলেন, “আমি সত্যিই ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু লক্ষ্য হারাইনি।” সেই সময় সৌমিতার কাঁধে হাত রাখেন পুরনো গ্রুপের অনলাইন সেলাররা। সৌমিতাকে নতুন করে সবটা শুরু করার সাহস যোগান তাঁরা। পুরনো দুঃখ ঝেড়ে ফেলে দ্বিতীয় গ্রুপ তৈরি করেন সৌমিতা। মাত্র ২ মাসের মধ্যেই সদস্য সংখ্যা হয় ১ লক্ষেরও বেশি। দূর্ভাগ্যবশত সেই গ্রুপটিও হ্যাক হয়। বিফলে যায় ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাও।
এত কিছুর পরেও দমে যাননি সৌমিতা। সৌমিতা বিশ্বাস করতেন, তার এই লড়াই দাম পাবেই। তাঁকে রোখা যাবে না। নিজের ইচ্ছাকে সঙ্গী করেই লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। সেই পথ ধরেই ফের তৃতীয় বার ফের গ্রুপ তৈরি করেন সৌমিতা। এর পরে আর ঘুরে তাকাতে হয়নি। বিগত ৬ ধরে রমরমিয়ে চলছে তাঁর গ্রুপ — বিউটি উইথ ফ্যাশন। বর্তমানে এই গ্রুপের সদস্য সংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ। প্রায় ২৫০-৩০০ সেলার এই গ্রুপের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। বছরে ৩-৪টি অফলাইন প্রদর্শনীর আয়োজন করে এই গ্রুপ। গ্রুপের তরফে আয়োজন করা সবক’টি প্রদর্শনীর জন্যই বছরভর অপেক্ষা করে থাকে একটা বড় অংশের মানুষ।
বলা হয়, অনলাইন দুনিয়া সীমানা মানে না। তাই মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে শুরু হলেও বর্তমানে সারা দেশ থেকে বিভিন্ন মহিলা সেলাররা এখানে ব্যবসা করছেন। বলা বাহুল্য, ‘বিউটি উইথ ফ্যাশন’ মুর্শিদাবাদের প্রথম অনলাইন সেলিং ফেসবুক গ্রুপ। বর্তমানে এই গ্রুপ থেকে হওয়া অনলাইন সেলারদের এক একটি লাইভে দর্শকসংখ্যা থাকে চোখে পড়ার মতো। বিক্রিও হয় তেমনই। এমনকি, এই গ্রুপ থেকে বিক্রি শুরু করে বহু সেলার বর্তমানে নিজস্ব দোকানও খুলেছেন।
তবে কলকাতায় আয়োজন করা সৌমিতার প্রদর্শনীগুলি বরাবরই নজর কেড়েছে। এই বছর দুর্গা পুজো উপলক্ষ্যে কলকাতার সুদেশ ব্যাঙ্কোয়েটে আগামী ১৫, ১৬, ও ১৭ সেপ্টেম্বর ফের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করতে চলেছেন সৌমিতা। প্রদর্শনীর নাম ‘দূর্গতিনাশিনী’।
বরাবরই পুজোর আগের এই প্রদর্শনীটির নজর কেড়েছে। এই বছরেও তার অন্যথা হবে না বলে আশাবাদী সৌমিতা। গ্রাহকদের জন্য একগুচ্ছ স্টলের পসার সাজানো থাকবে প্রদর্শনীতে। থাকবে ডিজাইনার শাড়ি ও ব্লাউজ, ব্যাগ, সানগ্লাস, সুগন্ধী, জাঙ্ক জুয়েলারি, লহেঙ্গা, আচার ও বিভিন্ন ধরনের হজমি, ঘর সাজানোর জিনিস, ঘরে তৈরি ঘি, দই, ক্ষীর, টেরেকোটা ও মাটির কাজ, জ্যোতিষী সহ আরও অনেক কিছু। বলা বাহুল্য, কোনও ব্যক্তির সাধারণ জীবন অসাধারণ ভাবে কাটানোর জন্য যা যা প্রয়োজন তা পাওয়া যাবে প্রদর্শনীতে।
ইউটিউবে সৌমিতার ভিডিয়ো দেখতে হলে ক্লিক করুন এখানে- Ansh n Mumma’s World