Tota Roy Chowdhury: মনোজ-লক্ষ্মীর হাত ধরে জোয়ার আসুক, জন্ম নিক আর এক সৌরভ!
Ranji Trophy Final: বাংলা, তার ওপর ক্রিকেট, ৩৩বছরের অধরা জয় যদি একবার ঘরে চলে আসে, বহু বছর ধরে এই দল চর্চার কেন্দ্রে থেকে যাবে।
টোটা রায়চৌধুরী
আগামী পাঁচটা দিন আমি যেখানেই থাকি না কেন, কাজের ফাঁকে বারবার মোবাইল দেখব। বন্ধুবান্ধবদের জিজ্ঞেস করব, ইডেনের খবর কী? বাংলা কত দূর এগোল। ৩৩ বছর পর রঞ্জি জেতার স্বপ্ন ছুঁতে আর কতখানি সময় লাগবে। আমি সিনেমার লোক। পর্দাতেই লোকে আমাকে চেনে। কিন্তু আমি মনেপ্রাণে ক্রীড়াপ্রেমী। হয়তো ফুটবলের প্রতি টানটাই বেশি, কিন্তু ক্রিকেটও তো পছন্দ করি, ভালোবাসি। আর সেখানে যদি আমার, আপনাদের বাংলা টিম এই হাতের কাছে ইডেনে রঞ্জি ট্রফির ফাইনাল খেলতে নামে, তা হলে বাড়তি আগ্রহ তো থাকবেই। ৩৩ বছর আগে বাংলা যখন রঞ্জি জিতেছিল, তখন আমি খুবই ছোট। অনেক কিছুই জানতাম না। পরে জেনেছি, শুনেছি। সেই বাংলা টিম গোটা রাজ্যকে গর্বিত করেছিল। এ বারও তেমনই একটা ছবি নেমে আসুক। লোকে আবার চর্চা শুরু করুক। ক্রিকেট নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। কিন্তু সেটা তো জাতীয় টিম নিয়ে কিংবা আইপিএল নিয়েই বেশি। রঞ্জি ট্রফি, ক্লাব ক্রিকেট নিয়ে আর কে ভাবে! এই না-ভাবার জগতটাকে এলোমেলো করে দিতে পারে রঞ্জি ট্রফি জয়। মনোজ-লক্ষ্মীরা যদি ট্রফিটা দিতে পারে, হয়তো বাংলার ক্রিকেটে নতুন করে জোয়ার আসবে। কে বলতে পারে, সেই জোয়ারেই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো এক তারকা উঠে আসবে না!
আবেগের নামই তো বাংলা
আমি বরাবরই ফুটবল প্রেমী। একটু বড় হওয়ার পর ক্রিটেক নিয়ে কম বেশি চর্চা শুরু। খেলা বিষয়টাই আমায় আগাগোড়া অনুপ্রাণিত করে। বিশেষ করে বাংলার এই জার্নিটায় আমি প্রথম থেকেই মানসিকভাবে জড়িত। যে কোনও খেলার ক্ষেত্রেই ভারত যখন জেতে, দেশ বলে কথা, তখন বুকের ভিতরটা কেমন করে ওঠে। আর এবার তো প্রসঙ্গ বাংলা ও বাঙালি, আবেগের মাত্রাটা সত্যি এক অন্য পর্যায়। কাজের মাঝে আছি, শুটিং করছি, কিংবা অবসরে দিন কাটাচ্ছি, রঞ্জি ট্রফির ওপর থেকে নজর আমার সরে না। সকালে উঠে খবরের কাগজ পড়াটা শুরু হচ্ছে ইদানিং শেষ পাতা থেকেই।
ফুটবলের সন্তোষ ট্রফি, ক্রিকেটের রঞ্জি ট্রফি বা অন্যান্য খেলার ক্ষেত্রে, বাংলা নাম জড়িয়ে পড়ার অর্থই এক অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করে শিরায়-শিরায়। ওই যে প্রথমেই লিখলাম বাংলাকে ঘিরে সকলের আবেগটাই তো আলাদা। থুরি, আবেগের নামই তো বাংলা।
প্রশংসা না করে উপায় কি!
৩৩ বছরের অপেক্ষা। আরও একবার ইতিহাসের দরজায় বাংলা। এত বছর পর আবার। গত কয়েকসপ্তাহ ধরে কেবল পড়ছি, শুনছি, জানার চেষ্টা করছি, নজরে রেখেছি দলের প্রতিটা খবর। যখনই চোখে পড়ে এই দম এতটা প্রাণোবন্ত, এতটা গুণী, দক্ষ, ভীষণ-ভীষণ আশা জাগছে। আরও একটা বড় প্রাপ্তীর সাক্ষী থাকতে চলেছি মনে হচ্ছে। এত পরিশ্রম করছেন সকলে… প্রশংসা না করে উপায় কি! এমন নয় যে ভাগ্যের জোরে এই জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে দলটা, নাহ্ একে বারেই নয়। রীতিমত কঠোর পরিশ্রম করে, লড়াই করে, এই জায়গাটায় পৌঁছানো।
“আমরাও পারি”, এই শব্দটার ক্ষমতাই আলাদা
সকলেরই চোখে পড়ছে তাঁরা কীভাবে জান-প্রাণ লড়িয়ে খেলছে। এই দলটার প্রতি শ্রদ্ধা, ভাললাগা, ভালবাসা আমার প্রথম থেকেই জন্মিয়েছে। বাংলা বলে কেবল আবেগ ঢেলে লিখতে বসে গিয়েছি এমনটা নয়, এই দলটার প্রতি আমার এক আলাদা মুগ্ধতা, ভরসা কাজ করছে। এই ট্রফি যদি এবার ঘরে আসে, সত্যি এটা এক অন্যদিগন্ত খুলে দেবে। এই দলটা আবারও স্বপ্ন দেখতে শেখাবে। অনেক ছেলে-মেয়েরা যাঁরা ক্রিকেটটাকে কেরিয়ার করে তুলতে আগ্রহী, তাঁরা নতুন করে ভরসা পাবে। আরও বেশি করে এগিয়ে আসবে, লড়াই করবে, পরিশ্রম করবে। একটা স্বপ্নপূরণ মানেই তো তা আরও দশটা স্বপ্নের জন্ম দেয়। এ ক্ষেত্রেও সেটাই হতে চলেছে। আমাদের বাংলায় কি প্রতিভার অভাব আছে? তাঁরা ভীষণ অনুপ্রাণিত হবেন। “আমরাও পারি”, এই শব্দটার ক্ষমতাই আলাদা। আর আমার বিশ্বাস এই শব্দটার জন্মই খেলার মাঠে। গোটা বিশ্বে যদি নজর রাখা যায়, তবে দেখা যাবে এই আমি পারার ভরসাটা প্রথম যোগায় খেলার মাঠই।
এটা কেবল এক ট্রফি জয় নয়
আমার মনে হয় প্রতিটা জয়ের সঙ্গে সমাজের অনেক ওঠাপড়া জড়িয়ে থাকে। একটা খেলায় জয়ের অর্থ কেবল কাপ ঘরে আনা নয়, শত শত মানুষের বুকে বল হয়ে জ্বলে ওঠা। আমরাও যে সাহেবদের কড়া টক্কর দিতে পারি, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে সংগ্রামী মনে সেই বিশ্বাস আনতে কি কম পিছিয়ে ছিল ফুটবল! সাল ১৯১১, আজও স্বর্ণাক্ষরে লেখা। আজ লিখতে বসে যেন পর পর সবটাই কেমন ছবির মতো সাজানো মনে হচ্ছে। মোহনবাগানের সেই ঐতিহাসিক জয়, আজও বাঙালির রক্ত গরম করে তোলে। সেই দিনটা কেবল একটা ট্রফি জয় নয়, শত-শত মানুষের মনে ভরসার জন্ম দিয়েছিল, সাহস সঞ্চার করেছিল। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, সাহেবরা কোনও ক্ষেত্রেই অজেয় নয়। তাঁদের শক্তির খেলাতেও হারানো যায়, তাঁদের বুদ্ধির খেলাতেও হারানো যায়। এই খেলার মাপকাঠিকে সেই পর্যায়ের সঙ্গে তুলনা করছি না, তবে এই জয়ও কিছু না কিছুর জন্ম দেবে, দেবেই। যাঁরা খেলাকে পেশা করতে চান, তাঁদের কাছে তো এই জয় এক কথায় পাথেয় হয়ে থাকবে।
বাংলা, তার ওপর ক্রিকেট, ৩৩বছরের অধরা জয় যদি একবার ঘরে চলে আসে, বহু বছর ধরে এই দল চর্চার কেন্দ্রে থেকে যাবে। নজির হয়ে থেকে যাবে। বাঙালি মাথায় করে রাখবে। কেবল ঐতিহাসিক মাইল ফলক সৃষ্টি করছে বলেই নয়, রঞ্জি জয় ঘিরে সকলের মনের যে খিদে, যে তৃষ্ণা রয়েছে, তা পূরণের মর্যাদাটাই তো ভিন্ন, তাই নয় কি!
শেষবার যখন বাংলা রঞ্জি চ্যাম্পিয়ন বাংলা
১৯৮৯-৯০ মরসুমে শেষবার যখন বাংলা রঞ্জি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, তখন আমি খুবই ছোট। সেভাবে মনেও নেই। সত্যি বলতে তখন আমি ফুটবল ছাড়া অন্য কোনও বিষয় কান দিতাম না। তবে জানি, সেই টিমে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যেমন ছিলেন, সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অশোক মালহোত্রা, অরুণ লালদের মতো তারকারা মাঠে ঝড় তুলেছিলেন। ৩৩ বছর পর বাংলা ইডেন গার্ডেন্সে নামছে রঞ্জি ফাইনালে। এর আগে বেশ কয়েকবার রঞ্জি ফাইনালে খেললেও জয়ের মুকুট আসেনি বাংলা মস্তকে। তাই প্রতিবারের মতো এবারই সেই আশাতেই বুক বেঁধেছি।
বিশাল কর্মকাণ্ডের কাণ্ডারী সৌরভ
সত্যি বলতে যখন-ই, যতবার-ই দেখি ঘরের ছেলে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় কীর্তি স্থাপন করছেন, একের পর এক পালাবদলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন ঝড়ের গতিতে, গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে। ভারতীয় ক্রিকেট টিমকে মানসিকভাবে অনেক বেশি পরিণত ও মজবুত করেছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর নেতৃত্ব। সুতরাং একজন বাঙালি যদি এই বিশাল কর্মকাণ্ডের কাণ্ডারী হয়ে উঠতে পারে, তবে বাংলার একটা গোটা তরতাজা তরুণ দল, বাঙালির মানসিকতায় কতটা গভীর প্রভাব ফেলবে, তা অনুমান করাই যায়। সেই সুবাদেই কলম ধরলাম। ইতিহাস গড়ার পথে সাক্ষী থাকতে কে না চায়। সকলের এই চেষ্টা পরিশ্রমকে কুর্নিশ।বাংলার টিমকে অনেক শুভেচ্ছা। ফাইনালের জন্য রইল শুভকামনা।
(সাক্ষাৎকার ভিত্তিক অনুলিখন)