‘আমার আশীর্বাদ রইল’ এক তরুণের জন্য মিলখার ভোকাল টনিক

ফোনের ওপার থেকে এর পর আমার জন্য এল অনেক অনেক আশীর্বাদ। বলেছিলেন, 'নিজের কাজের প্রতি সৎ থেকো, একদিন অনেক বড় হতে হবে তোমাকে। আমার আশীর্বাদ রইল।' এই বলে হিন্দি পাঞ্জাবি মেশানো প্রায় আধঘণ্টা ফোনালাপ শেষ।

'আমার আশীর্বাদ রইল' এক তরুণের জন্য মিলখার ভোকাল টনিক
দিল্লির মাদাম তুঁসোর জাদুঘরে নিজের মূর্তির সামনে মিলখা
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Jun 19, 2021 | 10:35 AM

প্রান্তিক দেব

সাংবাদিকতায় তখন সবে শুরু। অভিজ্ঞতা বলতে বছর দুয়েক। একদিন দুপুরে এডিটরের ঘরে ডাক।কাচের ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকতে, বললেন, ‘শুনেছিস নিশ্চয়ই মিলখা সিং(MILKHA SINGH) কে নিয়ে ছবি (FILM)তৈরি হচ্ছে। ফোনে ওনার একটা ইন্টারভিউ নে’। এই বলে একটা চিরকুট এগিয়ে দিলেন। তাতে লেখা একটা ফোন নাম্বার। হঠাৎ কেমন যেন ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। কলকাতা(KOLKATA) ময়দানের অ আ ক খ যে শিখছে, তাকে যদি ভারতীয়(INDIAN) লেজেন্ড(LEGEND) এর ইন্টারভিউ নিতে বলা হয় মনের অবস্থাটা এমন হয় বৈকি। ছোট্ট চিরকুটটার ওজন অনেক মনে হচ্ছিল। কাঁপা কাঁপা হাতে এগিয়ে গেলাম ফোনের দিকে। সমস্ত কিছু সেট করে, ডায়াল করলাম নাম্বার। মনে মনে ভাবলাম গুরুগম্ভীর কোন একজন মানুষ, ওপার থেকে হ্যালো বলবেন। হ্যাঁ, একটা হ্যালো শুনতে পেলাম, তবে সেটা গুরুগম্ভীর কোন মানুষের নয়। একজন শান্ত নরম মনের একজন মানুষ, পাঞ্জাবীও হিন্দি মেশানো ভাষায় জানতে চাইলেন কে বলছেন? কেন বলছেন? আমার পরিচয় জানার পর কথা বলা শুরু করলেন। ছবি নিয়ে আমার যাবতীয় কৌতুহল ও প্রশ্নের খোলামেলা উত্তর পেলাম। কথা বলতে বলতে মনে হচ্ছিল না যার সঙ্গে কথা বলছি তিনি ভারতীয় খেলার এক চিরকালীন নাম।

মিনিট দশেক কথা বলার পর আমার আমার প্রশ্ন শেষ। জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর কিছু জানতে চাও।’ আমি বললাম না স্যার। আমাকে এতটা সময় দিলেন এই জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।’ শুনে হাসলেন তবে ফোন রাখলেন না। এবার প্রশ্ন করা শুরু করলেন। জানতে চাইলেন আমার সম্পর্কে। আমি কে ? কোথায় থাকি? বাড়িতে কে কে আছেন? এমন একের পর এক প্রশ্ন। বুঝতেই পারছিলাম না কার সঙ্গে কথা বলছি। ইনি দ্য গ্রেট মিলখা সিং। দ্য ফ্লাইং শিখ। আমার মত এক তরুণ সাংবাদিকের তখনকার মনের অবস্থা পাঠক আশা করি বুঝতে পারবেন। এভাবে কথা চলতে থাকলো বেশ কিছুক্ষণ। ফোনের ওপার থেকে এর পর আমার জন্য এল অনেক অনেক আশীর্বাদ। বলেছিলেন, ‘নিজের কাজের প্রতি সৎ থেকো, একদিন অনেক বড় হতে হবে তোমাকে। আমার আশীর্বাদ রইল।’ এই বলে হিন্দি পাঞ্জাবি মেশানো প্রায় আধঘণ্টা ফোনালাপ শেষ।

ফোন রাখার পর একটা কথার মানে সেদিন বুঝেছিলাম। লেজেন্ড কাদের বলা হয়? কোথায় তিনি মিলখা সিং, আর কোথায় আমি সদ্য সাংবাদিকতায় পা দেওয়া এক যুবক। আধঘণ্টার জায়গায় উনি যদি আমার সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতেন, তাতেও আমি ধন্য হতাম। তিনি যদি আমার বা আমার পরিবারের খোঁজ না নিতেন, আমার তো মন খারাপ হত না। ফোন রাখার আগে আমাকে যদি আশীর্বাদ না করতেন, আমি তো রাগ করতাম না। কিন্তু উনি সবটাই করলেন। এক অচেনা অজানা তরুণ যে সদ্য নিজের কর্ম জীবনে পা দিয়েছে, পাখি ফোনের উপর থেকেই ভোকাল টনিক দিলেন। লোকদেখানো কোন গুরু গম্ভীর ভাব নয়, যেন পাশের বাড়ির অনেক ছোট থেকে দেখা এক ছেলের সঙ্গে কথা বলছেন। জীবনে এত কিছু পাওয়ার পরও যে মানুষটা মাটির এত কাছাকাছি থাকতে পারেন সত্যি কারের লেজেন্ড তো তিনিই।

আজও ভুলিনি সেই দিনটা। রাতে যখন খবরটা পেলাম, কিছুক্ষণ স্তব্ধ। তারপর বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই দিনটার কথা। যেদিন ফোনের এক পারে এক পারে আমি আর অন্য পাড়ে দ্যা গ্রেট মিলখা সিং। দ্যা লেজেন্ড। দ্য ফ্লাইং শিখ। বারবার মনে পরছে সেই কথাটা, ‘তোমাকে অনেক বড় হতে হবে।’ কতটা বড় হতে পারব জানি না স্যার, তবে আপনার আশীর্বাদ সঙ্গে নিয়ে লড়াই নিশ্চয়ই করে যাব, আর নিজের কাজের প্রতি সততা রাখবো। আপনার কাছে একটাই অনুরোধ, মহাশূন্য থেকেই এই দেশটাকে আশীর্বাদ দেবেন। আশীর্বাদ দিতেন এই দেশের খেলাধুলোকে।