পশ্চিমবঙ্গ: গত চারদিনে ফোন লাগেনি। যায়নি মেসেজ। যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। পরিজনদের খোঁজ নেই। কেউ বা আত্মরক্ষার্থে ফিরে এসেছেন বাংলার মাটিতে। ব্যবসা ফেলে নিজের দেশে (Afganistan) ফিরতে পারেননি কেউ কেউ। ডাকছে দেশ। তবে যাওয়ার উপায় নেই। পাহাড় ঘেরা সেই শান্ত দেশে যেখানে মিনির ‘কাবুলিওয়ালার’ বসবাস, সে দেশের মাটি এখন অশান্ত। গ্রেনেড-বোমা-বারুদের গন্ধে দূষিত বাতাস। বিমানবন্দর থেকে নিজের মাকে নিয়ে বেরিয়ে আসতে গিয়ে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়াতে হয়েছে চুঁচুড়ার কাবুলিওয়ালাকে। সকলেই ভাবছেন এরপর দেশে ফিরলে ‘নতুন করে আলাপ জমাবে কীভাবে’!
সুদের কারবার করতে সুদূর পাহাড়-দেশ ছেড়ে এদেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন তাঁরা। চুঁচুড়ার চকবাজারের একটি পুরনো বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেই বাড়িতেই বাস। তাঁরা আফগানিস্তানের কাবুল নিবাসী, ভারতে প্রবাসী। আফগানিস্তানে তালিবান শাসন নিয়ে উদ্বিগ্ন আইনুদ্দিন, জামালরা। আর কখনও কি দেশে ফেরা হবে? দেশ মানে তো কেবল একটা ভূখণ্ড নয়। সে দেশের সঙ্গে একটা ‘আমি আছি’ এই অস্তিত্বটাও জড়িয়ে থাকে। চোখে জল নিয়ে কোনওরকম ‘দুর্গম গিরি মরুপ্রান্তর’ পেরিয়ে নিজের মাকে ভারতে আনতে পেরেছেন আইনুদ্দিন। বিমানবন্দরে ঝেঁকে ধরে তালিবান। গত ১৩ অগস্ট রাইফেলের নলের সামনে ভারতের পাসপোর্ট দেখিয়ে তবে ছাড়পত্র মিলেছে আইনুদ্দিন ও তাঁর মায়ের। প্রায় বছরপাঁচেক এখানেই সুদের কারবার চালাচ্ছেন তিনি। কিন্তু, যা ফেলে আসলেন পাহাড়ের ওপারে তা কি আর ফিরে পাবেন? তাঁর কথায়, “আফগানিস্তানের এই অবস্থার পেছনে চিন-পাকিস্তান-আমেরিকা সবার হাত রয়েছে। তিন লক্ষের উপর সেনা দশ দিনে আত্মসমর্পণ নয়ত করতে পারে না। পাকিস্তান ভাবতে পারে তালিবান আসায় তাদের সুবিধা হবে, কিন্তু তালিবান একচুলও ছাড়বে না। গনি দেশের ভাল চাইতেন। পাকিস্তানের তা সহ্য হয়নি।”
আইনুদ্দিনের সুহৃদ জামাল খানের গলাতেও এক সুর। তাঁর কথায়, “এত তাড়াতাড়ি একটা দেশের সরকার পড়ে যাবে তা ভাবতেই পারি না। কুড়ি বছর ধরে যারা কিছুই করতে পারেনি, আচমকা তারা একটা গোটা দেশ দখল করে নিল। আমরা শান্তি চাই, শিক্ষা চাই, উন্নয়ন চাই। আফগানিস্তানের মাটি শক্ত নয়। অন্য দেশ সাহায্য না করলে এই সন্ত্রাসের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন।” জামালের পরিবার থাকেন আফগান প্রদেশেই। যোগাযোগ হয়নি এই কয়েক দিন। পরিণতি নিয়ে শঙ্কিত জামাল। কতটা নিষ্ঠুর হবে তালিবান! উদ্বেগের বলিরেখা জামালের কপাল জুড়ে। নিদ্রাহীন রাত কাটছে শুধু ফোনকলের অপেক্ষায়। জামালের মতোই আরও এক কাবুলিওয়ালা শুনতে পেয়েছেন ‘গ্রাম পতনের শব্দ’।
সিউড়িতে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে রয়েছেন মহম্মদ শয়রিফ। কাবুল সংলগ্ন পাকতিক এলাকায় রয়ে গিয়েছেন তাঁর পরিজনেরা। ব্যবসার জন্য এদেশে এসেছিলেন। তখনও কাবুল দখল করেনি তালিবানরা। অস্থির বাতাসেও ধিকিধিকি জ্বলছিল আশার শিখা। সেই আশা চুরমার হয়ে গিয়েছে। শয়রিফ বুঝেছেন বদলে গিয়েছে দৃশ্য়পট। যাঁরা রয়ে গেলেন সেই পাকতিকের এক প্রান্তে তাঁদের সঙ্গে কি আর দেখা হবে এই জন্মে? শুধু কয়েকটা পশতু অক্ষর দেখবেন বলে ফোনের ছোট্ট স্ক্রিনে তাকিয়ে রয়েছেন। শুধু একবার ফুটে উঠুক ‘হাম খুশল হ্যা’, এটুকুই চান শয়রিফ। তিনি বলছেন, “ফোন তো যেত না। এসএমএসে কথা হত। চারপাঁচদিন তাও বন্ধ। কোনও কথা হয়নি কারোর সঙ্গে। জানিনা, আদৌ সকলে বেঁচে রয়েছে কি না। তালিবান শাসন আমরা চাই না। এদেশে অনেক বছর থাকলেও তা তো আমার নিজের মাটি নয়। চাই, আবার সুস্থ হয়ে উঠুক আমার দেশ, আফগানিস্তান।” দেশের কাছে যাওয়া হয়নি। শুধু রয়ে গিয়েছে শিকড়ের টান।
সেই শিকড়ের টানেই কয়েকদিন ধরেই নীরবতা গ্রাস করে রয়েছে নয়াবস্তি পাড়া, ধূপগুড়ির ডাকবাংলো পাড়া আর মাজারশরীফের কাবুলিওয়ালাদের বাড়িতে। ধূপগুলির বাসিন্দা খান মহম্মদ, আনোয়ার খান, মামুদ খানেদের বাপ-ঠাকুর্দারা ভারতের স্বাধীনতার পূর্বেই এসেছিলেন এখানে। মামুদদের জন্মও এদেশে। মিলেছে নাগরিকত্বও। তবুও মনের কোণায় এখনও নাড়া দেয় শিকড়টা। এখনও কাবুল প্রদেশে রয়েছেন পরিজনেরা। বছরে একবার হলেও যোগাযোগ হয়। ছিন্নসূত্রে বেঁধে রাখা সেই সংযোগ কি এ বার হারাতে বসবে? ভারতে থাকলেও সেই পাথুরে মাটির টানকে অস্বীকার করবেন কী করে মামুদ-আনোয়াররা? চোখের জল ছাড়া আর অবশিষ্ট কিছু নেই।
বাঁকুড়ার মাচানতলায় এসে ঠাঁই নিয়েছেন ১০ টি আফগানি পরিবার। জায়গা নেই কোথাও। কাবুল প্রদেশে রয়ে গিয়েছেন পরিজনেরা। সব মায়াপাশ ছিন্ন করেই নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে চলেছেন তাঁরা। চোখের সামনে সাক্ষাত্ মৃত্যুকে দেখে আতঙ্কে উদ্বেগে বেছে নিয়েছেন বাংলার মাটি। রানাঘাটের সুপ্রিয় আর সোনু গনসালভেস পেটের দায়ে গিয়েছিলেন আফগানিস্তানে। সেখানকার ইউএস এম্নাসিতে রান্নার কাজে শেফ হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। শান্ত কাবুলপ্রদেশকে চোখের সামনে বদলে যেতে দেখেছেন ওঁরা। বোমা-গুলি-বারুদ আর মৃত্যুগন্ধ ভরা কাবুলের মাটি ছেড়ে দেশের মাটিতে ফিরে আসতে পেরেছেন অবশেষে সুপ্রিয় আর সোনু। প্রার্থনা, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক। তাঁরা জানিয়েছেন, শুধু প্রবাসী ভারতীয়দের জন্য নয়, আফগাননিবাসীদের জন্যেও বিশেষ পদক্ষেপ করুক ভারত সরকার।
তালিবান ত্রাসে কাঁপছে ‘রহমতের দেশ’। সেখানকার ভারতীয়দের দেশে ফেরাতে উদ্যোগী কেন্দ্র সরকার। ইতিমধ্যেই চালু করা হয়েছে ই-ভিসা। যাতে ফাস্ট ট্র্যাকের ভিত্তিতে আটকে পড়া নাগরিকদের ভিসা দ্রুত মঞ্জুর হয়। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের মুখপাত্র জানিয়েছেন, আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির কথা বিচার করেই এই ভিসা চালু করা হয়েছে। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার সাংবাদিক বৈঠক করে জানান, বাংলার অন্তত ২০০ জন মানুষ এখনও আটকে রয়েছেন আফগানিস্তানে। মূলত দার্জিলিং, তরাই এবং কালিম্পঙের বাসিন্দা তাঁরা। রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী একটি চিঠি লিখছেন বিদেশ মন্ত্রকে। আটকে থাকা বঙ্গবাসীদের ফিরিয়ে আনার যাতে দ্রুত বন্দোবস্ত করা হয়, সেই মর্মে এই চিঠি লেখা হয়েছে বলে জানান মমতা। আরও পড়ুন: ‘ওঁর বউ ইনজেকশন দিয়ে শান্ত করায়’, ‘কেষ্টর’ কুমন্তব্য, দিলীপও দিলেন পাল্টা