বোলপুর : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ভাবনা, আদর্শর সুতো দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন বলেই বিশ্বভারতী (Visva Bharati) আর পাঁচটা শিক্ষালয়ের মতো নয়। সেই ভাবনা, সেই আদর্শের ঐতিহ্যকে ধরে রাখাই ছিল আগামীর গুরুদায়িত্ব। সাত দশক পেরিয়ে আজ বিশ্বভারতীকে দেখলে সত্যিই কি রবিঠাকুরের আদর্শ-ভাবনা অটুট রয়েছে শিক্ষাঙ্গনে? এই প্রশ্নের উত্তর সহজ। না। রাজনীতি, বিক্ষোভ, ঘেরাও, বিতর্কিত মন্তব্যে জর্জরিত আজকের বিশ্বভারতী। এবার নতুন সংযোজন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের বয়কট। সোমবার থেকে বিশ্বভারতীতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পড়ুয়াদের একাংশের আন্দোলনের চাপে আর পরীক্ষা বয়কটের ঠেলায় পিছু হঠতে হল বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষকে। শুরুই করা গেল না উচ্চ মাধ্যমিক! বিশ্বভারতীকে নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁরা মনে করতে পারছেন না এমন ঘটনা বিশ্বভারতীতে আদৌ হয়েছে কি না! কার্যত নজিরবিহীন বলে মনে করছেন তাঁরা। কিন্তু আজ কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হল যে পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে চাইলেন না। কর্তৃপক্ষের কোন গাফলতির জন্য এই ঘটনার শিকার হলেন ইচ্ছুক পরীক্ষার্থীরা? মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা অন্যান্য বোর্ডের থেকে বিশ্বভারতীতে কতটা আলাদা? জেনে নেওয়া যাক।
গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি সম্পূর্ণ আলাদা শিক্ষা জগৎ তৈরি করেছিলেন বিশ্বভারতীতে। পরবর্তী সময়ে ১৯৫১ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার বিশ্বভারতীকে নিজেদের অধীনে নিয়ে আসে। ফলে বিশ্বভারতী ইউজিসির অধীনে চলে আসে। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে আশ্রম ব্যবস্থার ভাবনা এনেছিলেন, তারই পরিবর্তিত ও আধুনিক রূপ হল পাঠভবন ও শিক্ষাসত্র।
১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে চলে যাওয়ার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি কমিশন (UGC) ও শিক্ষা মন্ত্রক (তৎকালীন মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক)-এর হস্তক্ষেপ চলে আসে। ফলে ইউজিসির নিয়মবিধি মেনেই বিশ্বভারতীকে চলতে হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটি জটিলতা তৈরি হয়। বিশ্বভারতীর দুই বিদ্যালয় – পাঠভবন ও শিক্ষাসত্র কীভাবে ইউজিসির অধীনে চলবে, তা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। সেই সময় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তারা পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রকে পৃথক ভবন হিসেবে গণ্য করবে। যেহেতু, স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান, তাই এই দুই বিদ্যালয়ের পরীক্ষার বিষয়ে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষই। পশ্চিমবঙ্গের উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ বা কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়গুলির নিয়ম মতো চলে না বিশ্বভারতী। ফলে অন্যান্য পরীক্ষার সঙ্গে এর কোনও সময়ের মিল থাকে না, বিশ্বভারতী নিজেই সব কিছু ঠিক করে। সেই মতো সোমবার সকাল থেকে বিশ্বভারতীর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা ছিল।
বিশ্বভারতীর প্রতিটি ভবনের জন্য একটি করে বোর্ড অব স্টাডিজ় রয়েছে। ঠিক তেমন ভাবেই পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রের জন্যও একটি করে বোর্ড অব স্টাডিজ রয়েছে। বোর্ড অব স্টাডিজ়ের উপরে রয়েছে অ্য়াকাডেমিক ইনস্টিটিউট। এই দুটি অঙ্গই পাঠভবন ও শিক্ষা সত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। উচ্চ মাধ্যমিক বা মাধ্যমিক পরীক্ষা কীভাবে হবে, তার গোটা বিষয়টাই দেখে এই দুটি অঙ্গ।
যেহেতু বিশ্বভারতী স্বায়ত্তশাসনে রয়েছে, তাই বিশ্বভারতীর অধীনস্ত পাঠভবন বা শিক্ষাসত্রের নিয়ামক সংস্থা হল একমাত্র বিশ্বভারতীই। এ ক্ষেত্রে অ্য়াকাডেমিক ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে পরীক্ষার জন্য নিয়ম তৈরি হয়। তারপর সেটি বোর্ড অব স্টাডিজের মাধ্যমে প্রণয়ন হয়। এদিকে আবার পাঠভবন বা শিক্ষাসত্রের যাঁরা অধ্যক্ষ, তাঁরা বিশ্বভারতীয় এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য। ফলে বিশ্বভারতীতে তাঁদের মতামত পেশ করতে পারেন অধ্যক্ষরা। তবে বোর্ড অব স্টাডিজ বা অ্যাকাডেমিক ইনস্টিটিউট যে সিদ্ধান্তগুলি নেয়, তাতে চূড়ান্ত শিলমোহর দেন বিশ্বভারতীয় উপাচার্যই।
ছাত্র ছাত্রীদের একাংশের অভিযোগ, এখনও পর্যন্ত তাঁরা কোনও বৈধ রেজিস্ট্রেশন নম্বর পাননি। টেস্ট পরীক্ষার মাত্র ১০ দিনের মাথায় ফাইনাল পরীক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করছে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। সেই কারণেই তাঁরা ভাষাভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু করেন। এরই মধ্যে একাংশ পড়ুয়া এমনও রয়েছেন, যাঁরা পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক। ইচ্ছুক পড়ুয়াদের অভিভাবকরা এসে পড়়ুয়াদের সই সংগ্রহ করতে শুরু করেন, যাতে পরীক্ষা হয়। এরই মধ্যে দুই পক্ষের মধ্যে সামান্য বচসাও হয়। বচসায় এক ছাত্র আহত হয়েছেন বলেও জানা গিয়েছে।
সোমবার সকাল ৯ টা থেকে পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। পরীক্ষা চলার কথা ছিল দুপুর ১২ টা পর্যন্ত। কিন্তু পড়ুয়ারা দুপুর সাড়ে ১২ টা পর্যন্ত পরীক্ষা বয়কট করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষকে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন, তাঁদের দাবি দাওয়া না মানা হলেও আগামী দিনের পরীক্ষাগুলিও তাঁরা বয়কট করবেন। তাঁদের বক্তব্য, পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তাঁদের সময় লাগবে। কারণ, ১০০ শতাংশ ক্লাস হয়েছে অনলাইনে। সেই কারণে, অফলাইনে পরীক্ষা দিতে গেলে, তাঁদের প্রস্তুতির জন্য এক মাস সময় দিতে হবে। পড়ুয়াদের বক্তব্য, সিবিএসই হোক বা আইসিএসই হোক, সব বোর্ডই সময় দিয়েছে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে। তাই তাঁদেরও প্রস্তুতির জন্য সময় দরকার।
বিশ্বভারতীর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে যে চর্চা হচ্ছে, তার সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ বা মধ্যশিক্ষা পর্ষদ বা কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় কিংবা সিবিএসই – আইসিএসই , কারও কোনও যোগ নেই। বিশ্বভারতীর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের গোটা বিষয়টাই ঠিক করে বিশ্বভারতী। সেখানে আগে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সংক্ষিপ্ত পাঠক্রমে পরীক্ষা হবে। তারপরে দেখা যায়, উপাচার্যের হস্তক্ষেপে সংক্ষিপ্ত পাঠক্রমের বদলে পূর্ণ পাঠক্রমের উপরেই পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর এখানেই অভিযোগ পড়ুয়াদের। তাঁদের বক্তব্য, পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য কম সময় দেওয়া হয়েছে।
রাজ্যে ২ এপ্রিল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। আপাতভাবে সময়ের ফারাক খুব বেশি দিনের না হলেও, দেখা যাচ্ছে, একটি শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আবার অন্য শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য পূর্ণ সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। আর উভয় ক্ষেত্রেই পরীক্ষার সময় তিন ঘণ্টা। আর এতেই বেঁকে বসেছে পড়ুয়ারা।
বিশ্বভারতী একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। সে ক্ষেত্রে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে উচ্চ মাধ্যমিক বয়কট করা পড়ুয়াদের পুনরায় একবার পরীক্ষায় বসতে দেবে, তাহলে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। তবে এই পরীক্ষা বয়কট করা পড়ুয়াদের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী রয়েছে, তা জানা যাবে বোর্ড অব স্টাডিজ়, অ্যাকাডেমিক ইনস্টিটিউট বা উপাচার্যের মিলিত সিদ্ধান্তে। তবে এখনও পর্যন্ত এই উচ্চ মাধ্যমিক বয়কট প্রসঙ্গে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের থেকে কোনও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন : Kalna Municipality: ক্ষমা চাইলেন তপন পোড়েল, কি রয়েছে কালনার বহিষ্কৃত কাউন্সিলরের ভাগ্যে?