হাওড়া: ফের টিকাকেন্দ্রে (COVID Vaccination Camp) বিশৃঙ্খলা। কোভিড টিকা নিতে কার্যত ধাক্কাধাক্কি এমনকি টিকাকেন্দ্রের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি লাগিয়ে দেন প্রাপকরা। হাওড়ার একটি টিকাকেন্দ্রে ফের টিকা নিয়ে হুড়োহুড়ির ছবি সামনে এল। যদিও, কেন এই হুড়োহুড়ি? তা নিয়ে যদিও পঞ্চায়েত কর্মীরা মুখে কুলুপ এঁটেছেন।
ঠিক কী হয় এই টিকাকেন্দ্রে? মঙ্গলবার, দেখা যায় পাঁচলা বেলডুবি হাই স্কুলের টিকাকেন্দ্রে দীর্ঘ লাইন। কিন্তু, যত বেলা বাড়তে থাকে দেখা যায় সেই লাইন কেবল ভেঙে গিয়েছে তা নয়, ক্রমশই বাড়ছে ভিড়। অবশেষে, দেখা যায় টিকা নিতে লাইন ভেঙে কার্যত দৌড়াদৌড়ি ধাক্কাধাক্কি করছেন প্রাপকরা। পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠলে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছয় পুলিশ।
টিকা নিতে আসা এক প্রাপকের কথায়, “আমাদের কাল বাড়ি বাড়ি গিয়ে আশাকর্মীরা জানিয়ে এসেছে টিকা দেওয়া হবে। আমরা সেই মতো রাত থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে। তারপর শুনছি কিছুজন নাকি কুপন পেয়েছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কুপন বিলি করা হয়েছে। অথচ আমরা কুপনের কথা কিছুই জানি না। এখন, যারা কুপন পেয়েছে তারা বলছে আগে টিকা দিতে হবে। তাহলে আমরা যারা কুপন পাইনি, আমাদের কী হবে? আমরা কি টিকা পাব না!”
অন্য আরেক টিকা নিতে আসা প্রৌঢ় বলেন, “কাটমানি নিয়ে কুপন বিলি করেছে। নয়ত কিছুজন কুপন পেল বাকিরা পেল না কেন! আমরা জানিও না যে টিকার কুপন দেওয়া হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে কুপন না থাকলে ভ্যাকসিন পাব না। তাহলে এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখল কেন?” গ্রামবাসীদের আরও অভিযোগ, পঞ্চায়েত প্রধান ও সদস্যরা নিজেদের ইচ্ছামতো রাত ১১ টার পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে কুপন বিলি করেছেন। শুধু তাই নয়, গ্রামপঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে স্বজনপোষণেরও অভিযোগ তুলেছেন অনেকে।
প্রশ্ন উঠছে, যেখানে টিকা নিয়ে বারবার বিশৃঙ্খলার ছবি সামনে এসেছে সেখানে কী করে ফের একই ধরনের ছবি সামনে আসে? প্রশ্ন রয়েছে আরও। কতজনকে টিকা দেওয়া হবে, টিকার কোন ডোজ দেওয়া হবে এসব কিছু কেন প্রাপকদের আগে থেকে জানানো হয়নি? কেনই বা গভীর রাতে বিলি হচ্ছে কুপন? যদিও, এ প্রশ্নের সদুত্তর দিত্ পারেনি ব্লক প্রশাসন। মুখে কুুলুপ এঁটেছে পঞ্চায়েতও।
প্রসঙ্গত, রাজ্যে পর্যাপ্ত করোনা টিকা রয়েছে এমন কথা আগেই ঘোষণা করেছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। টিকার আকাল সেই অর্থে আপাতত মিটলেও বারবার উঠে এসেছে টিকাকরণে বেনিয়মের ছবি। সম্প্রতি, ধূপগুড়ি স্বাস্থ্য়কেন্দ্রে টিকা নিতে গিয়ে পদপিষ্ট হওয়ার ছবি সামনে এসেছে। টিকা লাইনে হুড়োহুড়ি ভিড়ের ছবি দেখা গিয়েছে সোনারপুরেও।
প্রশ্ন উঠছে কেন টিকা নিতে এইভাবে মানুষের ঢল? কেনই বা টিকার জন্য পদপিষ্ট হচ্ছেন অনেকে? রক্তারক্তি কাণ্ডের সাক্ষী থাকছে বাংলা? পর্যাপ্ত টিকার জোগান থাকা সত্ত্বেও বারবার কেন দেখা যাচ্ছে এই অনিয়ম? গাফিলতি কোথায়?
সর্বত্রই একটি সাধারণ সমস্যার কথা সামনে এসেছে, তা হল পরিকাঠামো ও যোগাযোগের অভাব। তবে, এই যোগাযোগের অপ্রতুলতা কি পরিস্থিতির দরুন নাকি এর নেপথ্যে কাজ করছে অন্য কোনও ‘ম্য়ান-মেড’ অবস্থা, যার ফল ভোগ করছেন সাধারণ মানুষ? কোভিড টিকাকরণ নিয়ে রাজ্য স্বাস্থ্য় দফতরের স্পষ্ট নির্দেশিকা রয়েছে। নির্দেশিকা রয়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকেরও।
কী বলা হচ্ছে নির্দেশিকায়?
কোভিড- ১৯ ভ্যাকসিন ইন্টালিজেন্স নেটওয়ার্ক(কো-উইন) ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নাম নথিভুক্তিকরণ ছাড়াও কতজন টিকা নিয়েছেন, কতজন টিকা পাবেন, কতজনকে টিকা দেওয়া বাকি রয়েছে, সমস্ত তথ্য রয়েছে। পাশাপাশি জাতীয়, রাজ্য ও জেলাস্তরে ২৯ হাজার কোল্ডচেইন পয়েন্টে সঠিক তাপমাত্রায় কত ডোজ় মজুত রয়েছে, সে সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য জানা সম্ভবপর হচ্ছে।
** বর্তমানে কোভিড ১৯ টিকাকরণ ক্ষেত্রে ‘ওপেন ভায়াল নীতি’নেই। অর্থাৎ একটি ভায়াল খোলার পর এটি একটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যবহার করতে হবে। টিকাদানকারীকে প্রতিটি ভায়াল খোলার তারিখ, সময় চিহ্নিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এবং ভায়াল খোলার ৪ ঘন্টার মধ্যে সমস্ত খোলা টিকার শিশিগুলি ব্যবহার বা বাতিল করতে হবে।
** সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে, প্রতিটি টিকা পর্বে কমপক্ষে ১০০ জন সুবিধাভোগী যাতে টিকা পান তা সুনিশ্চিত করতে হবে । প্রত্যন্ত ও বিচ্ছিন্ন জনবহুল অঞ্চলের ক্ষেত্রে বেশি সংখ্যক টিকা গ্রহণকারী সুবিধাভোগীদের জন্য টিকাপর্বের আয়োজন করতে বলা হয়েছে । টিকার অপচয় রোধে ছোট ছোট জ়োনে ভাগ করে টিকাপ্রদানে জোর দেওয়া হয়েছে।
** রাজ্য সরকার নির্দেশিত নীতিতে ধাপে ধাপে রাজ্য়ে টিকাকরণ প্রক্রিয়া চলছে। প্রথম ধাপে, সাংবাদিক, পুলিশ, চিকিত্সকদের মতো প্রথম সারির কর্মী বা ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কারদের টিকাকরণ, দ্বিতীয় ধাপে ষাাটোর্ধ্ব ও প্রবীণদের টিকাকরণ, তৃতীয় ধাপে ‘সুপার স্প্রেডার’ হতে পারেন এমন ব্যক্তিবর্গ, চতুর্থ ধাপে ১২ বছর অনুর্ধ্ব শিশুদের মায়েদের টিকাকরণে জোর দিয়েছে রাজ্য।
এখন, এই টিকাকরণ যদি ধাপে ধাপে হয়ে থাকে, নিয়ম মেনে হয়ে থাকে তাহলে সর্বসাধারণের কাছে টিকাকরণের খবর পৌঁছনোর সিংহভাগ দায়িত্ব থাকছে ব্লকস্তরীয় নেতৃত্বের উপর।
কিন্তু, ক্ষেত্রবিশেষে দেখা গিয়েছে, গ্রামের গ্রাম পঞ্চায়েতরা টিকাকরণের খবর কোনও পরিকল্পনা না করেই ছড়িয়ে দেন নিজেদের এলাকায়। জানিয়ে দেওয়া হয়, টিকা এসেছে। টিকাকরণ হবে। তাহলে কি ‘ফার্সট কাম, ফার্স্ট সার্ভ’ নীতিই প্রযোজ্য হচ্ছে গ্রামীণ অঞ্চলে? আমজনতার কাছে অন্তত বার্তা যাচ্ছে খানিকটা এইরকমই। ফলে, দিনের পর দিন লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা না পাওয়ায় এই সংক্রান্ত কোনও নির্দেশ পেলেই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ছেন সকলে। যে-কোনও মূল্যেই আগেভাগে করাতে হবে বিনামূল্যে টিকাকরণ। কোনও কিছু না ভেবেই তাই ছুটছেন মানুষ। তোয়াক্কা করছেন না অপর কোনও নির্দেশের। মঙ্গলবারের ঘটনাটিও এর ব্যতিক্রম নয়। যদিও, সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জেলা নেতৃত্ব।
সূত্রে খবর, অধিকাংশ সময়েই টিকা যে আসছে বা টিকার স্টক ফুরিয়ে গেলে তা পুনরায় সঞ্চয় করা হচ্ছে, সেই খবরই আসছে রাতে। সরকারি নীতি ও নিয়মে টিকার জোগান পূর্তি হলে তারপর কমপক্ষে ১৪-১৫ দিন পর্যন্ত ওই সঞ্চিত টিকা ব্যবহারযোগ্য। তাই টিকা এলেই দিয়ে দিতে হবে এমন তাড়াই মূল এমনটা নয়। আগেভাগে টিকাকরণ করতে হবে এমন চিন্তা যেমন রয়েছে তেমন রয়েছে সঞ্চিত টিকা শেষ করেই দ্রুত টিকা মজুত করা। হিসেবের অঙ্ক মেলাতে গিয়েই এই বিপত্তি। টিকা এসে পৌঁছনোর পরের দিনের মধ্যেই টিকাকরণ কর্মসূচি শেষ করতে যান প্রশাসকেরা। ফলে, স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করা থেকে শুরু করে টিকাকরণের গোটা কর্মসূচিটির নেপথ্যে থাকে প্রশাসকের পরিকল্পনার অভাব। এছাড়া বাড়তি স্বজনপোষণ তো রয়েছেই। যদিও, হাওড়ার এই ঘটনায় এখনও স্পষ্ট করে কোনও মন্তব্য করেননি জেলা প্রশাসন।
আরও পড়ুন: TMC Leader Murder Case: কুরবান শাহ হত্যা মামলায় স্থগিতাদেশ জারি সুপ্রিমকোর্টের, স্বস্তিতে পরিবার
আরও পড়ুন: Kaliachak: ফের ‘কুরুক্ষেত্র’ কালিয়াচক, আচমকা বোমা ফেটে জখম ২ শিশু!