উত্তর ২৪ পরগনা: খাতায়-কলমে তাঁর পোশাকি নাম ফিরোজ কামাল গাজী। বাংলার রাজনীতিতে তাঁর পরিচয় ‘বাবু মাস্টার’ (Babu Master) নামে। সিপিএম (CPIM) তৃণমূল (TMC) হয়ে অবশেষে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। নির্বাচনী আবহে মিনাখাঁয় দুষ্কৃতীদের বোমাবাজির জেরে গুরুতর আহত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, একুশের নির্বাচনে পদ্মের ভরাডুবির পর আর যে তিনি দলে থাকবেন না এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন আগেই। এ বার, স্পষ্টই জানালেন আর বিজেপি (BJP) করবেন না তিনি। পাশাপাশি তৃণমূলে যোগদানের ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন এই দাপুটে নেতা।
বুধবার সংবাদমাধ্যমকে বাবু মাস্টার বলেন, “আমি বিজেপিতে যোগদানের পরেই অনুভব করেছি যে আমি ভুল জায়গায় এসে পড়েছি। বিভাজন দিয়ে রাজনীতি হয় না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বভারতীয় নেত্রী। তাঁর মতো আর নেত্রী হয় না। কেন তৃণমূল ছেড়েছিলাম সে প্রসঙ্গে নিশ্চই দিদি আমার কাছে জানতে চাইবেন। তখন সেটুকু তাঁকেই বলব। তার আগে আমি একটি কথাও বলব না। তবে এটা পুরোপুরি সত্যি যে আমি বিজেপি ছাড়ছি। আর বিজেপি করব না। ”
যদিও বাবু মাস্টারের এই সিদ্ধান্তের পেছনে তৃণমূলের ‘সন্ত্রাস’ কাজ করছে বলেই অভিযোগ গেরুয়া শিবিরের। ব্যারাকপুরের বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং দাবি করেন, তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা বাবু মাস্টারকে ভয় দেখিয়ে জোর করে লুঠপাট চালিয়ে দল ছাড়াতে বাধ্য করেছে। যদিও, এই ঘটনায় তৃণমূলের তরফে কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
নির্বাচনী আবহে ফেব্রুয়ারি মাসে মিনাখাঁয় ‘আক্রান্ত’ হয়েছিলেন বাবু মাস্টার। তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি, বোমা ছোড়া হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। কলকাতার একটি হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। শরীরে একাধিক জায়গায় বোমার স্প্লিন্টার বিঁধে ছিল বলেই জানা যায়। বাবু মাস্টারকে দেখতে রাতেই হাসপাতালে যান বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী ও শঙ্কুদেব পণ্ডা।
শুভেন্দু অধিকারীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত বাবু মাস্টারের উপর হামলার ঘটনায় তৃণমূলের উপর যে যথেষ্ট ‘বিরূপ’ প্রভাব ফেলবে এমনটাই মনে করেছিলেন শাসক শিবিরেরই একাংশ। বাবু মাস্টারের উপরে হামলা নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রত্যাশিত ভাবেই অভিযোগে সরব হয় রাজ্য বিজেপি। বসিরহাটে বিজেপির শক্তি বাড়াতেই বাবু মাস্টারকে দলে প্রাধান্য দেওয়ার বড় কারণ বলে মনে করেছিলেন পদ্ম নেতারা।
গত লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে বিজেপির তরফে ১৮ জন সাংসদ জয়ী হলেও প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে ১২১টি বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে ছিল তারা। একমাত্র বসিরহাট লোকসভায় একটিও বিধানসভা এলাকায় এগোতে পারেনি গেরুয়া শিবির। পিছিয়ে ছিলেন সায়ন্তন বসু। ২০১৪ সালের উপনির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী শমীক ভট্টাচার্য বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্রে জিতলেও পরে ২০১৬ সালের নির্বাচনে তিনি হেরে যান। ফলে শক্তি বাড়াতে বাবু মাস্টার ও জেলা পরিষদের আরও এক কর্মাধ্যক্ষ রতন ঘোষকে দলে নেয় বিজেপি।
গত ডিসেম্বরে শুভেন্দু অধিকারীর হাত ধরে অমিত শাহের সভায় বিজেপিতে যোগ দেন এই দাপুটে নেতা। তবে হাসনাবাদের বাবুকে দলে নেওয়া নিয়ে কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় বিজেপি। বিজেপি-র আদি নেতাদের বক্তব্য ছিল, সিপিএম এবং তৃণমূলে থাকার সময়ে পদ্ম শিবিরের উপর একাধিক হামলার অভিযোগ রয়েছে বাবু মাস্টারের বিরুদ্ধে। যদিও সেই আপত্তি কাটিয়ে একরকম ‘নব্যদের চাপেই’ বিজেপিতে যোগ দেন বাবু মাস্টার।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে মন্ত্রী গৌতম দেবের ‘স্নেহধন্য’ হিঙ্গলগঞ্জের ‘বেতাজ বাদশা’ ছিলেন পেশায় স্কুল শিক্ষক এই নেতা।সুন্দরবনের হিঙ্গলগঞ্জের যেখানে তাঁর বাড়ি, সেখানেই বছরের বছরের পর বিরোধীদের সামান্য দলীয় প্রচারটুকুও করতে দেননি বাবুও। হাসনাবাদ ও হিঙ্গলগঞ্জে বামেদের ‘ভোট ম্যানেজের’ দায়িত্ব বর্তেছিল তাঁরই উপর। ততদিনে ওই চত্বরের ভেড়ি-জমি-ইঁটভাটাতেও নজর পড়েছিল বাবুর।
২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বাবুর কারসাজিতেই হিঙ্গলগঞ্জে কার্যত প্রচারেই যেতে পারেননি তৃণমূল নেতা নুরুল ইসলাম। তবে, বঙ্গে তখন নির্বাচনের হাওয়া বদলাচ্ছে। নুরুল ইসলামের জয়লাভের পর থেকেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান বাবু। পরে, ২০১০ সালে তৃণমূলে আসেন তিনি। ততদিনে বাম সরকার ক্ষমতায় থেকেও দাপট কমেছে। বঙ্গ রাজনীতিতে ধীরে ধীরে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে তৃণমূল কংগ্রেস।
এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি বাবু মাস্টারকে। তৃণমূলে যোগদানের পর দলের অন্দরের হালহকিকত বুঝে নিতে বিশেষ সময় লাগেনি এই দুঁদে নেতার। ততদিনে ক্ষমতায় তৃণমূল। ধীরে ধীরে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন তিনি। জ্যোতিপ্রিয়র দৌলতেই জেলা পরিষদের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক বিভাগের কর্মাধ্যক্ষ হন বাবু মাস্টার। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে হিঙ্গলগঞ্জ থেকে জেলা পরিষদ আসনে কার্যত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন তিনি। সাংগঠনিক ভাবে হাসনাবাদ ব্লক ও হিঙ্গলগঞ্জ লোকসভার কো-অর্ডিনেটরও নিযুক্ত হন বাবু।
আরও পড়ুন: Mamata Banerjee: ‘অনীত থাপা বন্ধু, ওদের সঙ্গে ঝগড়া নয়’, সভামঞ্চেই সাংসদকে ‘ধমক’ মমতার