দুর্গাপুর: সন্তানকে শিকলের বন্ধনে বেঁধে রাখতে বুকের ভিতরটা ফেটে যায় মা-বাবার। তাঁদের দাবি, বিকল্প পথ খুঁজে না পেয়েই মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেকে এই শিকল পরিয়ে রাখেন দিনরাত। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরনো সংসারে ছেলেকে চিকিৎসা করাতে পারি না, তাই এ ভাবেই রাখি যাতে কোনও বিপদ না ঘটে’, চিকচিকে চোখে বলছিলেন বছর চব্বিশের শঙ্কর সরকারের মা ফুলমালা সরকার।
কাঁকসার অজয়পল্লির বাসিন্দা শঙ্কর সরকার। এই ছেলে যখন একেবারে একরত্তি, তখনই মা-বাবা লক্ষ্য করেন শঙ্কর যেন কেমন অন্যরকম। আপন খেয়ালে থাকে। একটু বড় হতেই দেখেন, ছেলে এদিক ওদিক চলে যায় খালি। মাঝে মধ্যে এমনও হয়েছে, কোথাও খোঁজ নেই শঙ্করের। তারপর কোনও প্রতিবেশী এসে ধরে বেধে ছেলেকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল। এ নিয়ে বহু চিকিৎসা হয়েছে। তবে তাতে লাভ হয়নি কিছুই। এরপরই ছেলে যাতে কোনও বড় বিপদে না পড়ে, সে কারণে শিকল বেঁধে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় পরিবার।
বেশ কয়েকবার বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা হয়েছে শঙ্করের। কিন্তু কোনও সুফল মেলেনি। বরং উল্টে বাঁ চোখটাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে জানালেন বাড়ির লোকজন। দিনমজুর পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তাই বড় কোনও চিকিৎসকের কাছেও তাঁকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
কাঁকসার অজয়পল্লির বাসিন্দা শঙ্করের বাবা অন্যের জমিতে চাষ করেন। সঙ্গে ভ্যান চালিয়ে কোনওরকমে দিন গুজরান। তাই বড় নামকরা চিকৎসকের কাছে যাওয়াটা এই গরীব পরিবারের কাছে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে রাজা হওয়ার স্বপ্ন দেখার মতো। আর্থিক অনটনের সংসারে এখন শঙ্করকে বন্দী থাকতে হচ্ছে এই লোহার শিকলে। যে শিকল শুধু একটা মানুষকেই বেঁধে রাখেনি, তাঁর ভাগ্যটাকেও কেমন যেন আষ্টেস্পৃষ্টে বেঁধে রেখেছে।
মায়ের স্নেহের বাঁধন ছেড়ে এই আপনভোলা শঙ্কর যেন বেরিয়ে না যেতে পারে তাই মা কখনও ঘরে চেন দিয়ে বেঁধে রাখেন, আবার কখনও বা পায়ে সেই চেন পরিয়ে রাখেন। মা ফুলমালা সরকার জানান, ছেলেকে এ ভাবে দেখতে তাঁরও বুকের ভিতরটা ভেঙে যায়। তবু ভয় হয়, পাছে ছেলেকে যদি একেবারে হারিয়ে ফেলেন। তখনই বুকে পাথর চাপা দিয়ে ছেলের পায়ে বেড়ি পরান হতভাগ্য মা!
ফুলমালা সরকার বলেন, “ছেলেটা জন্ম থেকেই এরকম। চিকিৎসার জন্য কয়েক জায়গায় নিয়ে গিয়েছি। তখন বলছে এগুলো ভাল হবে না। শিকল দিয়ে এখন বেঁধে রাখি। না হলে ও চলে যায়। কতবার যে চলে গিয়েছে। খুঁজে সেই বারো তেরো দিন পর ধরে এনেছি। হেঁটে হেঁটে খুঁজে বেড়াই ছেলেকে। খুবই অবস্থা খারাপ। পঞ্চায়েতও কোনও চিকিৎসার জন্য সাহায্য করে না। আমাদের তো জমিজমা নেই। এর ওর জমিতে কাজ। সঙ্গে ভ্যান চালিয়ে সংসার চলে। ছেলের চিকিৎসা করাব কী করে! ”
কাঁকসা পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ প্রবোধ মুখোপাধ্যায় এ বিষয়ে বলেন, “দেখি আমরা সমিতিগত ভাবে কতটা সাহায্য করতে পারি। খুব তাড়াতাড়ি এর ব্যবস্থা নেব। এমন ঘটনা তো কখনওই বাঞ্ছনীয় নয়।”
আরও পড়ুন: Priyanka Tibrewal: ‘হেরেছি ঠিকই, দায়িত্ব কমেনি’, হিংসা রুখতে প্রিয়াঙ্কার আরও বড় পদক্ষেপ