
বর্ধমান: তিনি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত মাওবাদী নেতা। ঠিকানা বর্ধমান কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার। তার মধ্যেই বর্তমানে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন অর্ণব দাম। হাজার প্রতিবন্ধকতাকে পেরিয়ে গবেষণার কাজে অনুমতি পেয়েছেন। কিন্তু গবেষণা করলেও তার জন্য মিলছে না স্কলারশিপ। সেই স্কলারশিপের দাবিতে জেলেই অনশন আন্দোলন শুরু করেছেন অর্ণব। মাওবাদী এই নেতার অভিযোগ, তাঁর মেধাকে গুরুত্ব দিতে চাইছে না সরকার। এমনকী বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ নিয়ে স্বজনপোষণেরও অভিযোগ উঠেছে। এই ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকেও চিঠি লিখেছেন অর্ণব। তাতেও কোনও কাজ হয়নি বলে দাবি তার। অর্ণব দামের পাশে দাঁড়িয়েছে মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর ( APDR)।
স্কলারশিপের দাবিতে গতকাল(শুক্রবার) থেকে অনশন শুরু করেছেন অর্ণব। এই নিয়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শঙ্কর কুমার নাথ টেলিফোনে জানান, “স্কলারশিপ দেওয়ার এক্তিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। এটা রাজ্য সরকারের ব্যাপার। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনও স্কলারশিপ হয় না। সুতরাং আমরা শুধুমাত্র নাম পাঠাতে পারি। তবে ইতিমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমরা আমাদের মত করে সাহায্য করছি। অর্ণবকে প্রথমে লাইব্রেরি থেকে বই দেওয়া হচ্ছিল না। আমি সেটা বলে দিয়েছি। তিনি এখন বই পাচ্ছেন।”
উপাচার্য আরও বলেন, “অর্ণবের ১০ হাজার টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি আমরা মকুব করে দিয়েছি। বইপত্র, খাতা, পেন দিয়ে তাঁকে আমরা সাহায্য করছি। থিসিস পেপার জমা দেওয়ার সময় একটা ফি জমা দিতে হয়। সেটাও আমরা মকুব করে দেব। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যনির্বাহী বৈঠকে আমরা অর্ণবকে একটি ল্যাপটপ দেওয়ার বিষয়টি অনুমোদন করে নেব। আমরা কাউকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতে পারি না। তবে ফি কমাতে পারি।” অর্ণবকে মেধাবী ছাত্র বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ও গবেষণাটা কমপ্লিট করুক। মেইন স্ট্রিমে আসার চেষ্টা করছে। সেই স্বপ্ন যাতে পূরণ হয়, সেটা দেখার দায়িত্ব সবার।”
এই প্রসঙ্গেই সমাজমাধ্যমে এপিডিআরের সাধারণ সম্পাদক রঞ্জিত শূর লেখেন, “বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের জন্য দুই ধরনের স্কলারশিপ রয়েছে। একটি নন-নেট বিবেকানন্দ স্কলারশিপ। অন্যটি, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব স্কলারশিপ। কিন্তু অর্ণবকে কোনওটিই দেওয়া হচ্ছে না। অথচ সব পরীক্ষায় প্রথম অর্ণবেরই স্কলারশিপ পাওয়ার কথা।”
APDR-র সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, “অর্ণব এই প্রতিবাদ অনশনের কথা বিশ্ববিদ্যালয়কেও জানিয়ে দিয়েছে। অনেকেই জানেন রাজনৈতিক বন্দি অর্ণব দাম জেলবন্দি অবস্থায় ইতিহাসে ৭০-৭৫ শতাংশ নম্বর সহ বিএ, এমএ পাশ করেছেন। ‘সেট’ পাশ করেছেন। পুলিশ যেতে দেয়নি বলে ‘নেট’ পরীক্ষায় বসতে পারেননি। বর্তমানে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন। পিএইচডি-র অ্যাডমিশন টেস্টে ফার্স্ট হয়েছিলেন। সম্প্রতি প্রথম সেমেস্টার কোর্স ওয়ার্ক পরীক্ষায়ও অর্ণব ফার্স্ট হয়েছেন।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক তানভীর নাসরিন জানান, “অর্ণব পড়াশোনায় খুব ভাল। ভাল রেজাল্টও করেছে। গতকাল বর্ধমান জেলা সংশোধনাগারের সুপারিন্টেন্ডেন্ট আমাকে ইমেল করে অর্ণবের অনশনের বিষয়টি জানিয়েছেন।” জেল সুপারের সঙ্গে এই নিয়ে যোগাযোগ করা যায়নি।
উল্লেখ্য, খড়গপুর আইআইটির মেধাবী ছাত্র তথা মাওবাদী নেতা অর্ণব পড়াশোনা ছেড়ে সিপিআই (মাওবাদী) দলের রাজনৈতিক মতবাদে আকৃষ্ট হয়ে সেই সংগঠনে যোগ দিয়েছিলেন। তারপর থেকেই হিংসার রাস্তা বেছে নিয়েছিলেন তিনি। পশ্চিম মেদিনীপুরের শিলদা ইএফআর ক্যাম্পে হামলার ঘটনায় পুলিশ অর্ণব দামকে গ্রেফতার করে। তখন থেকেই জেলবন্দি তিনি। ২০১০ সালে শিলদা ইএফআর ক্যাম্পে হামলায় ২৪ জন জওয়ান শহিদ হন। অর্ণব এই হামলার নেতৃত্ব দেন বলে অভিযোগ। এছাড়াও ৩১টি গুরুতর মামলা ছিল অর্ণবের বিরুদ্ধে। ২০১২ সালে আসানসোলে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তিনি। তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়। অন্যদিকে এই বন্দি অবস্থাতেই ইতিহাস নিয়ে পিএইচডি করতে চাইলে আদালত তাঁকে অনুমতি দেয়। তখন থেকে জেলেই পড়াশোনায় মন দিয়েছিলেন অর্ণব দাম। তারপর মেদিনীপুর সংশোধনাগার থেকে প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে এসে ইগনু থেকে তিনি ইতিহাসে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন। দু’টিতেই ফার্স্ট ক্লাস পান এই মাওবাদী নেতা। ২০১৮ সালে স্টেট লেভেল এলিজিবিলিটি টেস্টও পাশ করেন। এখন তিনি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করছেন। গত বছর ২৬ জুন পুলিশের পাহারায় ইন্টারভিউ দিতে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে যান অর্ণব। আর গত বছরের ৫ জুলাই মেধাতালিকা প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়। আর ইন্টারভিউয়ে ২৪৯ জনকে পিছনে ফেলে প্রথম হন অর্ণব দাম। শুরু হয় পিএইচডি পড়াশোনা।