TV9 বাংলা ডিজিটাল: পরীক্ষিত না হলেও জনশ্রুতি, তৃণমূলে একমাত্র তিনিই নেত্রীর ছবি ছাড়া ভোটে জিততে পারেন, ক্ষেত্রে বিশেষে নাকি জেতাতেও পারেন। তিনি নন্দীগ্রামের নায়ক শুভেন্দু অধিকারী (Suvendu Adhikari) । কিন্তু সম্প্রতি তৃণমূল ও শুভেন্দুর(Suvendu Adhikari) সম্পর্কে ছন্দপতন ঘটেছে। পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে শুভেন্দুর তৃণমূল ত্যাগ এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা বলে মনে করছেন একাংশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। একের পর এক দলীয় ও সরকারি অনুষ্ঠানে অনুপস্থিতি এবং নাম না করে দল এবং দলনেত্রীকে বার্তা দানের মাধ্যমে শুভেন্দুই (Suvendu Adhikari) এখন নির্বাচনমুখী বাংলায় হট টপিক। নয়নের মণি থেকে চোখের বালিতে রূপান্তরিত হওয়া এই সম্পর্ক বিগত কয়েক মাসে কোন চড়াই উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে গেল তা দেখে নেওয়া যাক-
কয়েক মাস ধরেই জল্পনাটা চলছিল। হুল দিবসের সরকারি অনুষ্ঠানে চিত্রটা আবছা ছিল। কিন্তু তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে আদিবাসী দিবসে রাজ্যস্তরের সরকারি অনুষ্ঠানে। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু অত্যন্ত নৈপূণ্যের সঙ্গে তা এড়িয়ে গিয়েছিলেন শুভেন্দু। শহরের অদূরে নেদাবহড়া অঞ্চলের পিয়ালগেড়িয়া ফুটবল মাঠে তাঁর অনুগামীদের আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে শুভেন্দু যোগ দেন। সেখানে হালকা ভাবে ছুঁয়ে যান ঝাড়গ্রামের অনুষ্ঠানের কথা। তমলুকে আরও একটি কর্মসূচিতে যোগ দিতে হবে বলে ক্ষমা চেয়ে নেন তিনি। আর এদিকে বিতর্ক ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন পার্থ। বলেছিলেন, “শুভেন্দু এলে ভালো লাগত। তবে ওঁর অন্য কাজ আছে। এই নিয়ে কোনও বিতর্ক চাই না।”
এসবের পরও বিতর্ক কিন্তু থামেনি। কারণ, শুভেন্দু (Suvendu Adhikari) অনেক কিছু না বলেই দলের বিরুদ্ধে অনেক বার্তা দিয়েছেন। একটা ছোট্ট দৃষ্টান্ত- আদিবাসীদের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার কী করছেন এবং আগামী দিনে কী কী পরিষেবা মিলতে পারে সরকারি অনুষ্ঠানে তা সবিস্তারে বলেছেন পার্থ। আর পাশের সভায় দাঁড়িয়ে ঠিক তখনই শুভেন্দু ছুঁয়ে গিয়েছেন আদিবাসীদের জন্য তিনি নিজে কী কী করেছেন সেই বৃত্তান্ত। ত্রাণ পৌঁছনো থেকে চাকরির ব্যবস্থা করা— সবই বলেছেন, তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামটি একটিবারের জন্যও উচ্চারণ করেননি। একুশের নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই মন্ত্রীই আদিবাসীদের মন ছোঁয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ভিন্ন ভাবে!
এরপর ঋতুর মতোই বদলাতে শুরু করেছে শুভেন্দুর আচরণ। নভেম্বরে আরও বেশি শুষ্ক, রুক্ষ্ম হয়েছে তাঁর কথা। এক বক্তৃতায় শুভেন্দুর একটা ছোট্ট উচ্চারণ গুরুতর হয়ে উঠে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুরে পঞ্চায়েতের এক সভায় বক্তব্য রাখেন শুভেন্দু। সেখানেই নন্দীগ্রামের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, “আমাকে বললেন নেত্রী, আমি লড়াই করলাম…।”
নীল সাদা শামিয়ানায় থেকেই এবার শুরু হয় এতদিনের নীরবতা ভাঙার খেলা। শুভেন্দু বলতে শুরু করেন। আর রাজনৈতিক ‘পাঞ্চ লাইন’ খুঁজতে শুরু করেন বিশ্লেষকরা। পুজোর পর নন্দীগ্রামের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, “আমরা চলি সমুখপানে কে আমাদের বাঁধবে, রইল যারা পিছুর টানে কাঁদবে তারা কাঁদবে।” ফের ইঙ্গিত। তাঁর ‘সমুখপানে’ নিয়ে শুরু হয় জল্পনা। অনেকে আবার প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করেন, শুভেন্দুর ফিউচার প্ল্যানিং। বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ অবশ্য মুখ খোলেননি।
প্রায় একই সময়ের আরেক সভা থেকে আরও একবার হুঙ্কার, “আমি প্যারাশুটে নামিনি, লিফটেও উঠিনি। সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে উঠেছি।” শোরগোল উঠল আরও একবার। এবার উত্তর দিলেন ফিরহাদ। কটাক্ষের সুরে বলেছিলেন, ‘রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসেন অন্তর্যামী।’ এ দিন কারও নাম না করে শুভেন্দুর মন্তব্য, ‘‘ছোটলোকদের দিয়ে বাজে কথা বলিয়ে ভাবছে আমি উত্তর দেব। আমার লেভেলটা ওই নাকি!’’ সেদিন আরও অনেক বেশি তাচ্ছিল্য ছিল শুভেন্দুর গলায়।
মেদিনীপুরের ভূমিপুত্রের সমর্থনে কাঁথি শহরজুড়ে তখন হোর্ডিং, ফ্লেক্স। সাদা রঙের বিশাল ফ্লেক্সে পরিবহণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর ঢাউস ছবি। তার নীচে লেখা ‘শুভেন্দু অধিকারী জিন্দাবাদ’ ও ‘আমরা দাদার অনুগামী’। ফ্লেক্সের কোথাও তৃণমূল কংগ্রেসের নামগন্ধও নেই! ‘বিদ্রোহ’ তখন আরও জোরদার। শুভেন্দুর ঘনিষ্ঠবৃত্তে কে কে, শাসকশিবিরে এবার শুরু হয় সেই খোঁজ।
পরপরই নন্দীগ্রাম দিবস। গোটা বঙ্গ রাজনৈতিক মহল তখন তাকিয়ে এই মঞ্চে কী বার্তা দেন শুভেন্দু। এবার হয়তো নিজের অবস্থান স্পষ্ট করবেন শিশির-পুত্র। কারণ, ততদিনে যে বিজেপিও ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে। সৌমিত্র খাঁ বলে দিয়েছেন, “শুভেন্দু কাজের লোক। তৃণমূলে থেকে মানুষের হয়ে কাজ করা যায় না। তাই বিদ্রোহ। বিজেপিতে সাদর আমন্ত্রণ ওঁকে।” আর বঙ্গ বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, “যাঁরা মানুষের জন্য কাজ করতে চান, বিজেপি সেই সকলের জন্য দরজা খোলা রেখেছে। ” ইঙ্গিত আরও স্পষ্ট। ফলে মনে হতে থাকে, হয়তো নন্দীগ্রামের মঞ্চ থেকেই নিজের অবস্থান স্পষ্ট করবেন মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র।
না, সক্কলকে ভুল প্রমাণিত করে বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ তা করলেন না। নন্দীগ্রাম দিবসে বললেন না একটিও রাজনৈতিক কথা। বললেন, “কোন রাস্তা দিয়ে এগোলে আমি সামনে এগোতে পারব, তা আমি কোনও রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েই বলব। ‘রাজনীতি করতে গিয়ে কোথায় হোঁচট খাচ্ছি, সব বলব, তবে আজ নয়।” সভার সকালেই নন্দীগ্রামেই শুভেন্দু বলেছেন, ‘‘ভোটের আগে আসছেন। ভোটের পরেও তো আসতে হবে!’’ এই বার্তা অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ।
অধিকারী বাড়িতে পিকে-র আকস্মিক সফর
১২ নভেম্বর অধিকারী বাড়িতে যান পিকে। দেড় ঘণ্টা থাকেন। কথা বলেন শিশির অধিকারীর সঙ্গে। কিন্তু শুভেন্দু অধিকারী কর্মসূচির যোগ বাইরে ছিলেন। সূত্রের খবর, শিশিরবাবু শুভেন্দুকে ফোন করেছিলেন পিকে-র সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কথা বলেননি শুভেন্দু।
রামনগরের ‘মেগা শো’
এরপর রামনগরের সমবায়ের মঞ্চ থেকেও সেই একই বার্তা। অবস্থান স্পষ্ট তিনি কোনও রাজনৈতিক মঞ্চেই করবেন! আবারও একই কথা বললেন শুভেন্দু।
এতদিনে কিছুটা হলেও চেপে রাখা অভিমান বেরিয়ে আসতে শুরু করে। সাংগঠনিক বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে বসার রাস্তা প্রশস্ত হয়। মধ্যস্থতায় সৌগত রায়। সূত্রের খবর, কাজের জন্য স্বাধীনতা চেয়ে দলীয় নেতৃত্বের কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন তিনি। তিনি যে সমস্ত জেলার পর্যবেক্ষক ছিলেন, সেই সবকটিই যাতে তাঁকে আবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়, তার জন্য আবেদন করেছিলেন তিনি। কিন্তু নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক ফলপ্রসু হয়নি।
শুভেন্দুকে বার্তা নেত্রীর
সম্প্রতি বাঁকুড়ার সভা থেকে নেত্রী বলেন, “কে কোথায় যাচ্ছে, কে কার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, কে কি করছে, সব আমার কাছে খবর আছে। আপনাদের একটা কথা বলি। ব্যাক্তিগত কারও বিরুদ্ধে আপনাদের রাগ, ক্ষোভ থাকতে পারে। কিন্তু তৃণমূলকে খারাপ ভাববেন না।” সাম্প্রতিক পরিস্থিতির বিচারে রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, শুভেন্দু অধিকারীকেই ইঙ্গিত করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এরপরই সেই বিশেষ দিন। মন্ত্রিত্ব ছাড়লেন শুভেন্দু। শুক্রবারই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি দিয়ে নিজের ইস্তফাপত্র পাঠিয়েছেন শুভেন্দু। রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়কেও মেইল মারফত সে কথা জানিয়েছেন। বৃহস্পতিবারই দলের দেওয়া নিরাপত্তারক্ষীদের ছেড়ে দেন শুভেন্দু অধিকারী। এইচআরবিসির চেয়ারম্যান পদ থেকে তাঁকে অপসারিত করা হয়। সেই পদে বসানো হয় কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিলেন শুভেন্দু।
কলেজের ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট (ছাত্র পরিষদ)
কাঁথি পুরসভা থেকে প্রথম কাউন্সিলর হিসাবে জয়ী
একই সঙ্গে সমবায় আন্দোলন-কন্টাই গ্রামীণ ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান
পশ্চিমবঙ্গ রাজনীতিতে নন্দীগ্রাম পর্ব ও শুভেন্দু উত্থান
ক্রমশ দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠা (২০০৭)
২০০৯ তমলুক লোকসভা কেন্দ্র থেকে জিতে প্রথম সাংসদ নির্বাচিত হন
২০১৪ তমলুক থেকে পুনর্বার জয়ী
২০১৬ সালে লোকসভার সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা
২০১৬ নন্দীগ্রাম বিধানসভা থেকে জয়ী
মমতার মন্ত্রিসভায় শপথগ্রহণ
রাজ্যের পরিবহণ দফতর পরিবেশ
আরও পড়ুন: মন্ত্রিত্ব ছাড়লেন শুভেন্দু, চিঠি মারফত পদত্যাগপত্র পাঠালেন মুখ্যমন্ত্রীকে
যুব তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। এরপর একাধিক জেলার (মালদা, ঝাড়গ্রাম, মুর্শিদাবাদ) পর্যবেক্ষকের পদ থেকেও শুরু দেওয়া হয়। একুশের বিধানসভার আগে তৃণমূলের পুনর্গঠন হয়। কোর কমিটিতে আনা হয় শুভেন্দুকে (এসবের পরেও দলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছিল শুভেন্দুর)।
এরপর ধাপে ধাপে বিচ্ছেদ। এবার কি তবে বিজেপিতে যাওয়া সময়ের অপেক্ষা? আপাতত এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে বঙ্গের রাজনৈতিক মহলের অন্দরে।