AI Girlfriend: এআই গার্লফ্রেন্ড আপনাকে সত্যিই ভালবাসে?
Artificial Intelligent ChatBot: এখানে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় না, ডিজাইন করা হয়। আসলে ক্লান্তি, অতিরিক্ত কাজের চাপ আর চরম আত্মকেন্দ্রিকতার সুযোগ নিয়ে পুঁজিবাদ এআই গার্লফ্রেন্ড নামক এক অব্যর্থ পণ্য বানিয়েছে। যে প্রযুক্তি সমস্যার জন্য আংশিক দায়ী, সেই প্রযুক্তিই এখন সমাধান বিক্রি করছে। রেপ্লিকার মতো অ্যাপে টাকা দিলে পাওয়া যায় বেশি 'বুদ্ধিমান' সঙ্গী অর্থাৎ, ভালবাসা ও যত্নেরও স্তরভেদ হয়েছে। যার টাকা আছে, তার ঘনিষ্ঠতা বেশি।

আপনার প্রেমিক-প্রেমিকাকে I Love You বলার সময় গিয়েছে, এখন কী বলবেন জানেন? AI Love You! এখন, AI-এর যুগ। আর মানুষ কী চায়? প্রশ্নহীন আনুগত্য। ক্ষমতা। সে যা বলবে, তাই হবে। যা চাই, পাব মুহূর্তের মধ্যে! প্রেমের সম্পর্ক হোক বা যেকোনও মানবিক সম্পর্ক, যা চান―সঙ্গে সঙ্গে তাই পাওয়া যায় কি? এখানেই ফায়দা লুটছে AI। জীবনের রসায়ন বদলে একেবারে গেম-চেঞ্জার হয়ে কীভাবে উপস্থিত হচ্ছে AI? আপনার প্রেমিক বা প্রেমিকা ও এআই সঙ্গীর মধ্যে একটা প্রাথমিক ফারাক আছে। বাস্তব সম্পর্কে সদা ধৈর্য্যশীল সঙ্গীকে পাওয়া খুব মুশকিল। আপনার মানবিক-শারীরিক ডাকে মুহূর্তে সাড়া দেয়, কখনও পাল্টা প্রশ্ন তোলে না, এমন কোনও মানুষকে পাওয়া দুরূহ। কারণ সহজ, মানুষ অনুভূতি দ্বারা চালিত হয় এবং মানুষ চিন্তাশীল। মানুষের এই আপাত খামতিকেই পূরণ করে দিচ্ছে AI!
আসলে বর্তমানে AI এমন এক কাণ্ড করছে, যাকে অনেকে বলছেন Digital Violence, অনেকে বলছেন একাকীত্ব কাটানোর প্যারাসিটামল। আপনার প্রেমিকা নেই? সমস্যা নেই! আপনি নিজেই বানিয়ে নিতে পারেন। আলাপ করুন ‘উর্বশী’-র সঙ্গে—এটি আসলে একটি ভারতীয় এআই গার্লফ্রেন্ড অ্যাপ, যা আপনার শারীরিক ও আবেগগত চাহিদা অনুযায়ী ‘বাস্তব প্রেমিকার অভিজ্ঞতা’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। বেছে নেওয়ার জন্য রয়েছে ১৫ জন এআই মেয়ে। এঁরা ১০-এর বেশি ভাষায় ফ্লার্ট করতে পারে, আপনার সব কথায় সম্মতি দেয় এবং সবচেয়ে বড় কথা, কখনও রেগে যান না।
গুগল প্লে স্টোরে ইতিমধ্যেই ১ লক্ষের বেশিবার ডাউনলোড হয়েছে এই অ্যাপ। আর প্লেস্টোরে এই অ্যাপের কমেন্ট বক্স দেখলেই বুঝবেন যে উর্বশী ইতিমধ্যেই ভারতের নানা প্রান্তের পুরুষদের মন জয় করেছে। AI এনে দিচ্ছে ড্রিম গার্ল, ফ্যান্টাসি পূরণ করছে নিমেষে—কিন্তু প্রশ্ন হল, যখন ভালোবাসা অ্যালগরিদমে পরিণত হয়, তখন কী ঘটে?
কাস্টমাইজেশনই মূল আকর্ষণ
আপনাকে বুঝতে হবে, AI আপনাকে কি বিক্রি করছে? উর্বশীর মতো মার্কেটে এমন বহু সঙ্গী অ্যাপ চলে এসেছে। এই অ্যাপগুলোর আসল আকর্ষণ হল তাদের কাস্টমাইজেশন। ‘গ্রাহকই সবসময় ঠিক’—এই ধারণা মেনেই এআই সঙ্গীকে ব্যবহারকারীর কল্পনা অনুযায়ী গড়ে তোলা যায়। চেহারা, কণ্ঠস্বর, এমনকি সম্পর্কের ধরণও বেছে নেওয়া সম্ভব। এই অ্যাপগুলি লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল অর্থাৎ LLM ব্যবহার করে দীর্ঘ কথোপকথন চালায়, ঘনিষ্ঠতার নকল করে এবং ব্যবহারকারীর পছন্দ-অপছন্দ শিখে নেয় নিমেষে। আপনি চাইলে আপনার সঙ্গীকে ফ্লার্টি, শান্ত, অনুগত, আত্মবিশ্বাসী—যেমন খুশি তেমন বানাতে পারেন। বেশিরভাগ অ্যাপই ‘ফ্রিমিয়াম’ মডেলে চলে। এটা কী? সাধারণ চ্যাট বিনামূল্যে, কিন্তু রোম্যান্টিক, স্নেহশীল বা রগরগে যৌন কথোপকথনের জন্য আপনাকে গাঁটের কড়ি খসাতে হবে। প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশনে খুলে যায় ভয়েস কল, রোল-প্লে এবং NSFW কনভারসেশন। ধীরে ধীরে ব্যবহারকারী পেয়ে যান এক ‘আদর্শ সঙ্গী’—যিনি সবসময় উপস্থিত এবং কখনও ক্লান্ত হন না, নিজের কোনও চাহিদা নেই এবং তিনি বিতর্কে অংশ নেন, তখনই যখন আপনি চান! সাম্প্রতিক বেশ কিছু সমীক্ষা বলছে অ্যালগরিদম ও অ্যাপ স্টোরের হাতে সম্পর্কের দায়ভার ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যেই বেশি দেখা যাচ্ছে।
দ্রুত বাড়তে থাকা এআই সঙ্গী বাজার
বাজারে উর্বশী একা নয়। তার ভাই-বোনেরাও বাজার কাঁপাচ্ছে! রেপ্লিকা, ক্যারেক্টার এআই, নোমি—এরকম বহু আন্তর্জাতিক অ্যাপ রয়েছে, যেগুলি ব্যবহারকারীর ইচ্ছা পূরণে সদা প্রস্তুত থাকার জন্য প্রশিক্ষিত। সব মিলিয়ে রোম্যান্টিক চ্যাটবট ১০ কোটিরও বেশি বার গুগল প্লে-তে ডাউনলোড হয়েছে। একটি প্ল্যাটফর্ম ‘AI Girlfriend’ শুধুমাত্র ২০২৫-এর প্রথম কোয়ার্টারেই ৩১০ কোটি ডলার আয় করেছে। ভারতে আগামী পাঁচ বছরে এআই সঙ্গীর বাজার ৪০.৪ শতাংশ হারে বাড়বে বলে অনুমান করছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা।
কেন পুরুষরাই বেশি ঝুঁকছেন?
সব শুনে আপনার মনে হতেই পারে যে ছেলেরাই কি এমন সঙ্গী খোঁজে? নারীদের মধ্যে এমন চাহিদা কি একেবারেই নেই? Companionguide.ai-এর তথ্য অনুযায়ী, সার্চ ইঞ্জিনে বছরে ‘AI chatbot girlfriends’ সার্চ করা হয়েছে ১৬ লক্ষ বার, যেখানে ‘AI boyfriend’ সার্চ হয়েছে মাত্র ২ লক্ষ বার। অনেক ব্যবহারকারী একাকীত্ব ও মানসিক সমর্থনের অভাবকে এআই গার্লফ্রেন্ড নেওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। নিঃসঙ্কোচে সব বলা যায় AI সঙ্গীকে, শারীরিক উপস্থিতি না থাকলেও তার সঙ্গে সব শেয়ার করা যায়, কিন্তু প্রশ্ন হল—এটা কি সুস্থ আবেগঘন সম্পর্ক, নাকি শুধুই বিভ্রম?
বাস্তব সম্পর্ক থেকে আশ্রয়
এআই সঙ্গী এমন এক প্রতিশ্রুতি দেয়, যা বাস্তব মানুষ দিতে পারে না—অসীম ধৈর্য, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া এবং কোনও প্রতিবাদ নেই। অনেকের ক্ষেত্রে এটি সম্পর্কের চেয়ে বেশি বাস্তব ঘনিষ্ঠতার অস্বস্তি থেকে পালানোর আশ্রয়। এখানে ভালবাসার দাম সাবস্ক্রিপশন।
এআই-তে আরও তীব্র পিতৃতান্ত্রিক কল্পনা
আদর্শ নারী আসলে নারীই নন। তিনি একটি কোড—অনুগত, পোষ্য, নিজের কোনও প্রয়োজন নেই, আর সবসময় সম্মত। আমাদের সমাজে একদিকে প্রযুক্তি সম্পর্কের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে, আর অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিচ্ছিন্নতা ও নিরাপত্তার অভাব। একবিংশ শতাব্দীর সমাজে এখনও পুরুষদের শেখানো হয়, একাকীত্ব বা দুর্বলতা প্রকাশ করা মানেই অক্ষমতা। অনেক সংস্কৃতিতে ডেটিংকে ছোট করে দেখা হয়। এই সব মিলিয়েই পুরুষরা এআই-এর দিকে এগিয়ে চলেছে। যদিও এতে পিতৃতন্ত্র দুর্বল হচ্ছে না, বরং আরও পোক্ত হচ্ছে দিনে দিনে।
নিয়ন্ত্রণের মজা আসলেই উপাদেয়!
Human Communication Research-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় এক ব্যবহারকারী সাফ বলেন যে, রেপ্লিকার উপর আপনি যেভাবে ক্ষমতা ফলাতে পারেন, তা আর কোনও মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে থাকে না। চেহারা, ব্যক্তিত্ব, যৌন কনটেন্ট—সবই নিয়ন্ত্রণযোগ্য। এতে নারীর দেহ ও মনোযোগ ‘অন-ডিমান্ড’ পাওয়া উচিত—এই ধারণা আরও পোক্ত হয়। এখানে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় না, ডিজাইন করা হয়। আসলে ক্লান্তি, অতিরিক্ত কাজের চাপ আর চরম আত্মকেন্দ্রিকতার সুযোগ নিয়ে পুঁজিবাদ এআই গার্লফ্রেন্ড নামক এক অব্যর্থ পণ্য বানিয়েছে। যে প্রযুক্তি সমস্যার জন্য আংশিক দায়ী, সেই প্রযুক্তিই এখন সমাধান বিক্রি করছে। রেপ্লিকার মতো অ্যাপে টাকা দিলে পাওয়া যায় বেশি ‘বুদ্ধিমান’ সঙ্গী অর্থাৎ, ভালবাসা ও যত্নেরও স্তরভেদ হয়েছে। যার টাকা আছে, তার ঘনিষ্ঠতা বেশি। গবেষণা বলছে, এআই চ্যাটবটের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা মানসিক সুস্থতা কমায়।
সহজ কথা, এই অ্যাপগুলির নির্মাতাদের মূল আগ্রহ প্রফিট। আবেগ, যত্ন ও স্বীকৃতিকে তারা ‘ইমোশনাল ক্যাপিটালিজম’-এর আওতায় বিক্রি করে। এইবার বাকিটা আপনার উপর, আপনারা পাশে বসা সঙ্গীটির রাগ-অভিমান আদর করে ভাঙাবেন নাকি AI-বটকে পোষ মানাতে মানাতে নিজেই তার বশবর্তী হয়ে যাবেন? আপনার সকল ডেটা AI-এর হাতে তুলে দিয়ে আপনারই নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছেন, আবার এর জন্য টাকা খরচ করছেন আপনিই! একটু ভেবে দেখুন আর এমন খবর সহজে বুঝতে চোখ রাখুন TV9 বাংলা ডিজিটালে।
