ধূ ধূ প্রান্তর। চারিদিকে শুকনো পাহাড় ছাড়া কিছু নেই। মাঝখান দিয়ে গিয়েছে একটা রেলপথ। ঠিক সিনেমার মতো সাজানো দৃশ্য। সেখানেই চলছিল ধুন্ধুমার অ্যাকশন। সুড়ঙ্গে ট্রেন ঢুকতেই একটা বিস্ফোরণ। সামনের রেললাইনও উড়িয়ে দিল জঙ্গিরা। ট্রেনের আর যাওয়ার পথ নেই। অগ্যতা দাঁড়াতেই হল। আর ট্রেন দাঁড়াতেই নিমেষে ঘিরে ফেলল ওরা, সবার হাতে বন্দুক। মাথায় বাঁধা কাপড়। হাইজ্যাক হয়ে গেল আস্ত একটা ট্রেন। বন্দি ৪৫০ যাত্রী। বালোচ ছাড়া অন্য প্রদেশের যাত্রীদের দেখলেই গুলি চালাচ্ছিল জঙ্গিরা। সেনাকর্মী দেখলে তো কথাই নেই। ওই মুহূর্তেই মৃত্যু নিশ্চিত। পাকিস্তানে ট্রেন হাইজ্যাক নিয়ে হইচই বিশ্বজুড়ে। ৩০ ঘণ্টার অভিযান চালিয়ে বন্দিদের মুক্ত করেছে পাকিস্তান নিরাপত্তা বাহিনী। নিকেশ করা হয়েছে ২৭ জঙ্গিকে। পাক নিরাপত্তা বাহিনীর ৩০ জন জওয়ানেরও মৃত্য়ু হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ কেন ট্রেন হাইজ্যাক হল? কারাই বা করল এই হাইজ্যাক? কী দাবি তাদের?
পাহাড়ের কোলে অপহৃত আস্ত একটা ট্রেন।
এরা হল বালোচিস্তান লিবারেশন আর্মি। ১১ মার্চ কোয়েটা থেকে পেশোয়ারের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল জাফর এক্সপ্রেস। ট্রেনটি যখন সিবির ব্যালন পাহাড়ের একটি সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন অতর্কিতভাবে হামলা করে বালুচ জঙ্গিরা। তাদের দাবি ছিল, বালুচ রাজনৈতিক নেতাদের জেল থেকে মুক্তি। সেই দাবি পূরণ হয়নি, তবে পাকিস্তানকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে এই ঘটনা। আরও একবার রাষ্ট্রনেতাদের ভাবতে বাধ্য করেছে যে তারা আদৌ বালোচিস্তানকে নিজেদের দেশের সঙ্গে জুড়ে রাখতে পারবে কি না।
গোটা বিশ্বের কাছে যেখানে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের আখাড়া হিসাবে পরিচিত, সেখানে পাকিস্তানের চিন্তার কারণ বালোচিস্তান। খনিজ ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ এই প্রদেশে বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী ক্রমাগত স্বাধীনতা লাভের জন্য লড়াই চালাচ্ছে। বালোচিস্তান লিবারেশন আর্মি তাদেরই অন্যতম। ইরান-আফগানিস্তান সীমান্তে সক্রিয় এই সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী। এছাড়াও বালোচিস্তান লিবারেশন ফ্রন্টও রয়েছে। এদের সবার লক্ষ্য একটাই। পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভ। এদিকে পাকিস্তান স্বাধীনতা দিতে নারাজ।
বিদ্রোহের আগুন নতুন নয়। ভারত-পাকিস্তান যখন ভেঙে দুই খণ্ড হয়েছিল, সেই সময় থেকে। আর নেপথ্যে ছিল পাকিস্তানের রূপকার মহম্মদ আলি জিন্নাহের বিশ্বাসঘাতকতা। তবে এই আলোচনায় যাওয়ার আগে জানা প্রয়োজন বালোচিস্তান এত গুরুত্বপূর্ণ কেন পাকিস্তানের কাছে?
পাকিস্তানের অন্য়তম বড় প্রদেশ বালোচিস্তান। তবে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এখানে বাসিন্দার সংখ্যা অনেক কম। বালোচিস্তানে খনিজ সম্পদ ভরপুর। ছাগি জেলার রেকো দিক, সাইনডাকে বিপুল পরিমাণ সোনা ও তামা মজুত রয়েছে। এছাড়া লোহা, জিঙ্ক, কয়লা, সিসা মজুত রয়েছে এই প্রদেশে। স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান তাদের ‘টাকার খনি’ হাতছাড়া করতে চায় না। এদিকে, বালোচিস্তানের বাসিন্দাদের দাবি, সরকার এই খনিজ সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। বালোচিস্তানের বাসিন্দাদের বঞ্চিত করছে। তবে এই শোষণ শুরু হয়েছিল সেই ব্রিটিশ শাসনকাল থেকে।
যখন ব্রিটিশরা অখণ্ড ভারতকে শাসন-শোষণ করছিল, তখন রাশিয়ার মতো শক্তির কাছ থেকে বালোচিস্তানকে লুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু লাগাতার বিক্ষোভের মুখে পড়ে উনিশ শতকে এক নীতি গ্রহণ করে ব্রিটিশ শাসকরা। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বালোচিস্তানে নাক গলানো হবে না। কিন্তু ছবিটা বদলে যায় দেশ ভাগের সময়।
বালোচিস্তানের স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতার। আর সেই স্বপ্নের সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন মহম্মদ আলি জিন্নাহ। ১৯৪৭ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হয়, তখন স্বাধীন ঘোষণা করা হয়েছিল বালোচিস্তানকেও। চারটি মূল প্রদেশ বা প্রিন্সলি স্টেট ছিল তাতে, খারান, মাকারান, লাস বেলা ও কালাত। দেশভাগের আগে ব্রিটিশ শাসকরা বালোচিস্তানের নেতাদের সামনে তিনটি প্রস্তাব রেখেছিলেন। হয় ভারত বা পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে যাওয়া। নাহলে তৃতীয় অপশন, স্বাধীন দেশ হওয়া। বাকি তিন প্রদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে যাওয়ার প্রস্তাবে রাজি হলেও, কালাতের খান- খান মীর আহমেদ ইয়ার জান জানিয়েছিলেন, কালাত স্বাধীন থাকতে চায়।
কাশ্মীর বা হায়দরাবাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ না হওয়ায়, কালাতের উপরে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়নি ভারত বা পাকিস্তান কেউই। ফলে কালাতের স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার কথা ছিল। মহম্মদ আলি জিন্নাহ-ও সেই প্রস্তাব মেনে নেন। কালাতের খানও ভেবেছিলেন জিন্নাহ বন্ধু, সে নিশ্চয়ই কালাতের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। কিন্তু খেলা ঘুরিয়ে দেয় ব্রিটিশরাই। পাকিস্তানের কানে ভরে যে কালাতকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করলে পাকিস্তানেরই বিপদ। তার থেকে বরং পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ করুক কালাতকে।
মহম্মদ আলি জিন্নাহ। Toronto Star Archives/Toronto Star via Getty Images
ব্রিটিশদের ইন্ধনেই জিন্নাহ ইউ টার্ন নেন। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে কালাতকে পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন, কিন্তু খান-রা সেই প্রস্তাব খারিজ করে দেন। এরপর ষড়যন্ত্র শুরু করেন জিন্নাহ। পাক সরকার খানদের বিরুদ্ধেই প্রচার শুরু করে। শক্তিও প্রয়োগ করা হয়। ইতিহাসের বিভিন্ন বইতেও এই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে।
১৯৪৮ সালের ১৮ মার্চ জিন্নাহ খারান, মাকারান ও লাস বেলার অধিগ্রহণ ঘোষণা করেন। মাঝখানে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে পড়ে কালাত, তাও আবার অর্ধেকের বেশি জমি খুইয়ে! আগুনে ঘি ঢালে আরেকটি ভুয়ো খবর। ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে খান-রা আসলে ভারতে সামিল হতে চান, তাই জন্য পাকিস্তানের প্রস্তাবে না করছে। এরপর চাপের মুখে পড়েই কালাতের খানদের মাথা নত করে পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে যেতে হয়।
পাকিস্তানের অংশ হয়ে গেলেও, তা কখনও মন থেকে মানতে পারেনি বালোচিস্তান। ১৯৫৮ সালে কালাতের খান নবাব নৌরাজ খান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, কিন্তু পরের বছরই তাঁকে ধোঁকা দিয়ে ফের কালাতকে পাকিস্তানে জুড়ে দেওয়া হয়। লাহোর জেলে বন্দি বানানো হয় নবাবকে।
এরপর ১৯৬৩ সালে শের মহম্মদ বিরজানি মারির নেতৃত্বে ফের বিদ্রোহ শুরু হয়। পাকিস্তানি সেনা প্রত্যাহার, ওয়ান ইউনিট প্ল্যান বাতিল এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, বালোচিস্তানকে একত্র করে একটি প্রদেশে ঘোষণা করার দাবি জানানো হয়। ১৯৬৯ সালে জেনারেল ইয়াহা খান সরকারের প্রধান হয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন বিদ্রোহীদের সঙ্গে। পরের বছর ওয়ান ইউনিট প্ল্যান বাতিল করা হয়। পঞ্জাব, সিন্ধের পাশাপাশি বালোচিস্তানকেও প্রদেশ ঘোষণা করা হয়।
দাবি পূরণ হলেও, স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা ভোলেনি বালোচিস্তান। আর এই স্বপ্ন পূরণে অনুপ্রেরণা দেয় বাংলাদেশ। ১৯৭০-র দশকে যেভাবে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে বাংলাদেশে পরিণত হয়েছিল, সেভাবেই বালোচিস্তানও স্বায়ত্ত শাসন চায়। কিন্তু জুলফিকর আলি ভুট্টো সেই দাবি খারিজ করে দেন, শুরু হয় প্রবল বিক্ষোভ-আন্দোলন। ১৯৭৩ সালে আকবর খান বুগতির সরকারকে ভেঙে দেন ভুট্টো।
আন্দোলন দমন করতে শক্তি প্রয়োগ করে পাকিস্তান, শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড়, নির্যাতন, প্রকাশ্যে খুন। যা এই আন্দোলনে আরও ঘৃতাহুতি দেয়। শেষে জেনারেল জিয়া-উল হক যখন ক্ষমতায় বসেন, তখন তিনি বালোচিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন এবং বালোচের বিদ্রোহীদের রাজক্ষমা করা হয়।
বারবার রক্তাক্ত হয়েছে বালোচিস্তান। John Moore/Getty Images
বিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ফের পাকিস্তানে বিরুদ্ধে ক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে যখন বালোচিস্তানের এক মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ করে এক সেনাকর্মী। এরপর বারেবারে অশান্তি বেঁধেছে। পাক সেনার উপরে হামলা করেছে বালোচের বিদ্রোহীরা। ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বিভিন্ন পরিকাঠামো। বিশেষ করে চিনের টাকায় তৈরি নানা প্রকল্প, যেমন চিন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর তৈরির কাজে বাধা, প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে বালোচিস্তানের বিদ্রোহীরা। প্রতিবারই তাদের দাবি একটাই ছিল, স্বাধীনতা। যা পাকিস্তান দিতে নারাজ।