World War II, Project Pigeon: শান্তির প্রতীক পায়রা ওড়াত মিসাইল-বোমা, ভাবুন তো!
Project Pigeon: এই অবলা প্রাণীদেরই তিনি বোমাবাজি শেখাতে লাগলেন। স্কিনার ইতিমধ্যেই ইঁদুর নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন, আর এতেই প্রমাণিত হয়েছিল যে পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করলে আচরণ বদলানো সম্ভব। তিনি জানতেন, জটিল কাজগুলোকে যদি ছোট ছোট অংশে ভেঙে দেওয়া যায়, সেক্ষেত্রে যথেষ্ট সময় আর খাবার দিলে প্রাণীরা ধাপে ধাপে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। মার্কিন সেনা তখনও বার্তা পৌঁছে দিতে প্রশিক্ষিত পায়রা ব্যবহার করত।

লাইকাকে মনে আছে? সেই যে কুকুরটা, যাকে সোভিয়েত পাঠিয়ে দিয়েছিল মহাকাশে। লাইকার তো নাম দেওয়া হয়েছিল, কতশত নামহীন গিনিপিগকে তো রোজ বলি দেওয়া হয় ল্যাব টেস্টিংয়ের স্বার্থে। এইবার ভাবুন, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ চালাচ্ছে পায়রা! না না, অবাক হবেন না। যে পায়রার পায়ে এককালে রাজা-মহারাজারা বেঁধে দিতেন শান্তিপ্রস্তাব বা কোনও প্রেমপত্র, সেই পায়রা যুদ্ধও করতে পারত। জানেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কী হয়েছিল? জানেন না?
তখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমআইটি রেডিয়েশন ল্যাবরেটরি
১৯৪০-এর দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমআইটি রেডিয়েশন ল্যাবরেটরি ওরফে ‘র্যাড ল্যাব’। এই র্যাড ল্যাবের বিশেষজ্ঞ দল গোপনে মিত্রবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য মাইক্রোওয়েভ রাডার প্রযুক্তি তৈরি করছিল। বিমান-শনাক্তকরণ ব্যবস্থা এবং টার্গেট খুঁজে বোমা আঘাত করা, এই ছিল মোদ্দা উদ্দেশ্য। এরই মাঝে মনোবিজ্ঞানী বি. এফ. স্কিনার এমন এক পরিকল্পনা কর বসলেন, যাতে অনেক হিসাব ওলটপালট হয়ে গেল!
তখন মার্কিন সেনা বার্তা পৌঁছে দিতে পায়রা ব্যবহার করত
চিরাচরিত পথে প্রযুক্তি নির্মাণের পরিবর্তে এমন প্রাণীদের ব্যবহার করার কথা বলা হল, যাদের স্বভাবজাত দিকনির্ণয়ের ক্ষমতা আছে। প্রাণীজগতের কম্পাস খুঁজতে খুঁজতে স্কিনারের স্ক্যানারে ধরা পড়ল পায়রা, এই অবলা প্রাণীদেরই তিনি বোমাবাজি শেখাতে লাগলেন। স্কিনার ইতিমধ্যেই ইঁদুর নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন, আর এতেই প্রমাণিত হয়েছিল যে পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করলে আচরণ বদলানো সম্ভব। তিনি জানতেন, জটিল কাজগুলোকে যদি ছোট ছোট অংশে ভেঙে দেওয়া যায়, সেক্ষেত্রে যথেষ্ট সময় আর খাবার দিলে প্রাণীরা ধাপে ধাপে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। মার্কিন সেনা তখনও বার্তা পৌঁছে দিতে প্রশিক্ষিত পায়রা ব্যবহার করত।
তখন স্কিনার একজোড়া মোজার আঙুল কেটে তাতে পায়রাকে ঢোকালেন
সালটা ১৯৩৯। ওয়ারশ-এ হিটলারের বোমাবর্ষণের কয়েক মাস পার হয়েছে। মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্কিনার ভাবতে শুরু করলেন—উঁচু থেকে ফেলা প্রতিরক্ষামূলক ক্ষেপণাস্ত্র কি মাঝ-আকাশে হামলাকারী বিমান নামাতে পারে? ট্রেনে যাত্রার সময় তিনি দেখলেন পাখির ঝাঁক আকাশে নিয়ম করে উড়ছে, তখনই তিনি বুঝলেন―সমাধান তো চোখের সামনেই রয়েছে! এখানে সমস্যা, প্রথমে পাখিদের টার্গেট চিনতে শেখাতে হবে। স্কিনার একজোড়া মোজার আঙুল কেটে তাতে পায়রাকে ঢোকালেন—মাথা বাইরে, শরীর ভেতরে। ডানা বেঁধে দেওয়া, পা জুতোর ফিতে দিয়ে বাঁধা। এরপর পায়রাটিকে কাঠের ব্লকের সঙ্গে বেঁধে এমন যন্ত্রে বসানো হল, যা বৈদ্যুতিক হোইস্টের মাধ্যমে ওপর-নিচে নড়তে পারে এবং ছাদের উপর দিয়ে দেয়ালের নিচ পর্যন্ত যাওয়া ট্র্যাকে চলতে পারে। হালকা রড ঠেলে পায়রাটি যন্ত্রটিকে ওপরে-নিচে বা ডানে-বাঁয়ে চালাতে পারত। স্কিনার ছাদের সঙ্গে ঝোলানো একটি নিশান বসালেন যার মধ্যে খাবারের দানাভর্তি কাপ ছিল। তিনি ধীরে ধীরে যন্ত্রটির শুরুর অবস্থান দূরে সরাতে লাগলেন, ফলে পায়রাকে শিখতে হল কিভাবে নিজেকে সরাসরি নিশানার সামনে এনে মেলাতে হয় যখন যন্ত্রটি ঘরের মধ্য দিয়ে চলছে।
তখন পায়রাকে ঠোকর মারতে হত ‘X’-এ
১৯৪২ সালের শেষ নাগাদ স্কিনার পায়রা-গবেষণার জন্য দুইবার তহবিল চেয়েও প্রত্যাখ্যাত হন। এক সহগবেষক বিষয়টি জেনারেল মিলস কোম্পানিকে জানান, এবং তারা স্কিনারকে ৫,০০০ ডলার ও একটি পুরনো আটা কলের জায়গা দেন যাতে সরকারকে দেখানোর মতো একটি প্রোটোটাইপ বানানো যায়। স্কিনার, তার কয়েক শিক্ষার্থী এবং জেনারেল মিলসের এক ইঞ্জিনিয়ার পায়রাদের কঠোর উড়ান-পরিস্থিতিতে কেমন কাজ করে তা পরীক্ষা শুরু করলেন। তারা দেখলেন—কম খাওয়া পায়রারা তাপমাত্রা, চাপ, শব্দ, কম্পন—সবকিছুর মধ্যেও খাবার ঠিক খুঁজে নেয়। এরপর তাঁরা লক্ষ্য নিখুঁত করার জন্য পায়রার ঠোকরকে বোমা-নির্দেশনার পদ্ধতি হিসাবে কাজে লাগালেন। একসঙ্গে চারটি পায়রা প্রশিক্ষণের জন্য যন্ত্র তৈরি হল। প্রতিটি পায়রা শক্ত করে বাঁধা, সামনে চার ইঞ্চির একটি ফাঁক। সেখানে একটি আধা-স্বচ্ছ প্লেটে বহিঃস্থ লেন্স থেকে টার্গেটের ছবি পড়ত। আলো দিয়ে এক জায়গায় ‘X’ চিহ্ন তৈরি করা হত যেখানে পায়রাকে ঠোকর মারতে হত।
তখন ইলেকট্রনিক গাইডেন্স সিস্টেম এতটা উন্নত হয়নি…
প্রতিবার ঠোকর দিলে শস্য ঝরে পড়ত। ছবিটি সরে গেলে পায়রারা মাথা নেড়ে কেন্দ্র ঠিক রেখে ঠোকর মারত—অর্থাৎ খাবার আসতেই থাকত। দানা পড়বে—এই প্রত্যাশায় তারা স্ক্রিনে টার্গেট দেখলেই ঠোকর দিতে শুরু করত। স্ক্রিনের চার পাশে চারটি এয়ার-ভালভ ছিল। কেন্দ্র থেকে ছবি সরলে বিপরীত পাশে বায়ু চাপ পড়ে সংকেত পাঠাত, এবং বোমার ফিন কোন দিকে ঘুরবে তা নির্ধারণ করত। ভুল ঠেকাতে তিনটির মধ্যে দুই পায়রাকে একই দিকে ঠোকর দিতে হত। ম্যানুয়ালি মানুষকে যে কাজ করতে হত, পায়রা সেক্ষেত্রে ৯৫% পর্যন্ত নিখুঁত ছিল। যদিও ১৯৫৩ সালে ইলেকট্রনিক গাইডেন্স সিস্টেম আরও উন্নত হওয়ায় ‘প্রজেক্ট পিজিয়ন’ স্থায়ীভাবে বাতিল করা হয়। পায়রা-চালিত বোমা কখনও বাস্তবে ওড়েনি, তাও স্কিনার কিন্তু গবেষণা নিয়ে অনুশোচনা করেননি!
