ঢাকা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি নিজের জীবন অর্পণ করেছিলেন তিনি। তাঁর অবদানেই পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশ। যে দেশ স্বাধীন করার জন্য এত লড়াই করেছিলেন মুজিবর, তিনি জানতেন না সেই দেশের জন্যই তাঁর প্রাণ যাবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট ঢাকার ধানমন্ডির বাড়িতে নৃশংসভাবে মুজিবর ও তাঁর পরিবারকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাক্রম হয়তো অনেকে জানেন, তবে তার আগে বা হত্যার পরে কী হয়েছিল, সেই তথ্য অনেকেরই অজানা।
আজ ১৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী। মুজিবরের অবদানকে ভুলতে বসেছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে ফিরে দেখা যাক তাঁর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাক্রম।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট। সমস্ত আটঘাট বেধে নেমেছিল বাংলাদেশ সেনা। ভোর পৌনে পাঁচটা থেকে শুরু করেছিল অভিযান। প্রথমে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট দুইজন, শেখ মণির ও আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে হামলা করা হয়। এরপর দুই ট্রাক সেনা এগোতে থাকে ৩২, ধানমন্ডির বাড়ির দিকে। সেনার গাড়ি যখন গেটে পৌঁছে গিয়েছে, তখন বাড়ির পরিচারকরা দৌঁড়ে আসেন বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে সতর্ক করতে। ততক্ষণে সেনা গুলি চালাতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই বঙ্গবন্ধুর কানে এসেছে আবদুর রব সেরনিয়াবাতের হত্যার কথা। তিনি তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহকে ফোন করেন। বলেন যে সেনা গুলি চালাচ্ছে, অবিলম্বে কিছু করতে। সেনাপ্রধান তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি কি বাসভবন থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন?’। বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন বাঁচার পথ নেই।
ঘড়ির কাঁটায় তখন ঠিক ভোর পাঁচটা। দরজা খুলে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন মুজিবের স্ত্রী। পরিচারক রোমাকে জানান, তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে হামলা হয়েছে। এ কথা শুনে রোমা সোজা ছুটে যান বাড়ির সামনের দিকে। দেখেন, কয়েকজন গুলি চালাতে চালাতে এগিয়ে আসছে মুজিবরের বাড়ি লক্ষ্য করে। রোমা ছুটে এসে বাড়ির সব সদস্যদের ঘুম থেকে তুলে জানান তাদের উপরে হামলা হতে চলেছে। শেখ কামাল, জামাল প্রত্যেকে নীচে নেমে আসেন।হঠাৎ গুলির শব্দ, শোনা যায় শেখ কামালের আর্তনাদ।
ছেলের আর্তনাদ শুনেই বঙ্গবন্ধু ছুটে যান নিজের ঘরে। বন্ধ করে দেন দরজা। বন্ধ হয়ে যায় গুলির শব্দ। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন মুজিবর। মুহূর্তের মধ্যে তাঁকে ঘিরে ফেলে আততায়ীরা। বঙ্গবন্ধু তাঁদের বলেন, “তোমরা কী চাও? কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে?”
হিড়হিড় করে তাঁকে টেনে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যায় আততায়ীরা। বঙ্গবন্ধু বুঝে গিয়েছিলেন কী হতে চলেছে এরপর। দু-তিন ধাপ নামার পরেই নীচ থেকে গুলি চালানো হয় বঙ্গবন্ধুকে লক্ষ্য করে। সিঁড়িতেই লুটিয়ে পড়েন রক্তাক্ত মুজিবর। তারপরও অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর পরিবারকে যেন স্পর্শ না করা হয়। কেউ সেই অনুরোধ শোনেনি।
বিবিসি সিনিয়র সাংবাদিক সুভাষ চক্রবর্তীকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, শেখ মুজিবুরকে কেবল হত্যা করা হয়নি, তাঁকে নির্মমভাবে ঘর থেকে টেনে বের করে আনা হয়েছিল। তাঁর দেহ ট্রাকে ফেলে রাখা হয়। পরের দিন, অর্থাৎ ১৬ অগস্ট সকালে বাংলাদেশি সৈন্যরা শেখ মুজিবুরের পরিবারের সদস্যদের মৃতদেহ সংগ্রহ করে সৎকারের জন্য। তিনি ছাড়া বাকি সকল মৃতদেহ বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছিল। শেখ মুজিবুরের মরদেহ হেলিকপ্টারে করে তাঁর গ্রাম টাঙ্গিপাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়।
মুজিবরের শেষকৃত্যে যাতে কেউ অংশ নিতে না পারে, সেই জন্য পুরো গ্রামটি বাংলাদেশ সেনা ঘিরে ফেলেছিল। সেনা জোর দিচ্ছিল যেন মৃতদেহটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কবর দেওয়া হয়। তবে গ্রামের এক মৌলানা বলেছিলেন যে গোসল বা স্নান না করিয়ে, মৃতদেহ কবর দেওয়া যাবে না। হাতের কাছে গোসল করার জন্য সাবান ছিল না। তাই জামাকাপড় কাচার সাবান দিয়ে মুজিবের দেহ স্নান করানো হয়েছিল এবং তাঁর বাবার পাশে সমাহিত করা হয়েছিল।