কাবুল: বৃহস্পতিবারের বিকেল। বাকিদিনগুলির মতোই উপচে পড়া ভিড় ছিল কাবুলের হামিদ কারজ়াই বিমানবন্দরের (Hamid Karzai International Airport) বাইরে। সকলের লক্ষ্য একটাই, কোনও উদ্ধারকারী বিমানে চেপে আফগানিস্তান (Afghanistan) থেকে পালানো। কারণ, ২০ বছর আগে তালিবানি শাসনের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাদের, তা আর ফিরে পেতে চান না। তাই আফগান সরকারের পতন হতেই, তালিবান রাজ শুরু হওয়ার আগে পড়িমরি ছুট লাগিয়েছিলেন বিমানবন্দরের দিকে। কিন্তু, সেখানেই যে আরেকটি বিপদ অপেক্ষা করছে, তা মার্কিন, ব্রিটিশ গোয়েন্দা বাহিনী টের পেলেও সাধারণ আফগানবাসী বোঝেননি।
বিকেল ৫টা নাগাদ, যখন মার্কিন সেনা পাসপোর্ট যাচাই করে আফগানবাসীদের ঢুকতে দিচ্ছিল, সেই সময়ই আচমকা বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে হামিদ কারজ়াই বিমানবন্দরের অ্যাবেই গেট। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কয়েক মিনিটের ব্যবধানে দ্বিতীয় বিস্ফোরণটি হয়। এ বারের বিস্ফোরণটি ছিল বিমানবন্দরের উল্টোদিকেই অবস্থিত ব্যারন হোটেলের সামনে। বিস্ফোরণের জের সামলে উঠতেই দেখা যায়, চারিদিকে শুধু ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে মৃতদেহ। কারোর হাত পা নেই, কারোর আবার গোটা দেহটাই ঝলসে গিয়েছে। বিমানবন্দর লাগোয়া যে খালটি ছিল, তার জলের রঙ বদলে গিয়েছে রক্তের রঙে। সেখানেও পড়ে রয়েছে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাওয়া দেহগুলি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কাবুলের বিভিন্ন জায়গায় আরও দুটি থেকে তিনটি বিস্ফোরণ হওয়ার খবর মেলে। সব মিলিয়ে মোট ১০৩ জনের মৃত্য়ুর খবর মেলে। এদের মধ্যে ৯০ জন আফগান নাগরিক, ২৩ জন মার্কিন সেনা।
সন্দেহের তির প্রথমে তালিবানের উপর গেলেও তারা সাফ জানিয়ে দেয়, এই বিস্ফোরণের পিছনে তাদের কোনও হাত নেই। বরং ওই হামলায় তাদের ২৮ জন জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে। এরপরই প্রশ্ন ওঠে, যদি তালিবানরা হামলা না চালায়, তবে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটাল কে বা কারা? জবাবও মিলে যায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। ইসলামিক স্টেট-খোরাসান (Islamic State-Khorasan) বা আইসিস-কে (ISIS-K) ঘটনার দায় স্বীকার করে নেয়। তারা জানায়, মার্কিন বাহিনী প্রধান লক্ষ্য থাকলেও একইসঙ্গে তালিবানকেও ‘সবক’ শেখাতে চেয়েছিলেন তারা এবং সেই কাজে সফলও হয়েছেন।
নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে, ইসলামিক স্টেট বা আইসিস বাহিনীর শাখা সংগঠনই হল আইসিস-কে (ISIS-kK)। ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া (Islsamic State of Iraq and Syria), যা সংক্ষেপে আইসিস (ISIS) নামে পরিচিত, তা চরম ইসলামপন্থী সংগঠন, যারা অ-মুসলিমধর্মীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিল। আইসিস-কে ওই সংগঠনেরই অংশ হলেও তা আফগানিস্তানের খোরাসান (Khorasan) প্রদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল এতদিন। তবে আইসিস-কে-র উৎপত্তি কিন্তু আফগানিস্তানে নয়। প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে তেহরিক-ই তালিবান পাকিস্তানের অধীনেই সশস্ত্র ছাত্র সংগঠন ছিল আইসিসের এই সংগঠন। কিন্তু ঘরের মাঠে সুবিধা করতে না পেরেই সীমান্ত টপকে আফগানিস্তানে চলে আসে তারা। ২০১৪ সালে আইএস প্রধান বাগদাদির কাছে অনুরোধ জানায় তাদের আইসিসের অংশ বানিয়ে নিতে। সেখান থেকেই প্রতিষ্ঠা হয় ইসলামিক স্টেট-খোরাসানের।
২০১৪-১৫ সালে ইরাক ও সিরিয়ায় যখন আইসিস আধিপত্য বিস্তার করছিল, সেই সময় আফগানিস্তানের পূর্বাংশ খোরাসানের দখল নিচ্ছিল আইসিস-কে। ২০১৫-১৬ সাল থেকেই আফগানিস্তানে যে মার্কিন সেনা মোতায়েন ছিল, তাদের উপর ছোট-বড় হামলা চালাতে শুরু করেছিল আইসিস-কে। সেখান থেকেই তাদের উত্থান হলেও মার্কিন বাহিনীর সামনে বেশিদিন টিকতে পারেনি তারা, তাই নিজেদের অঞ্চলের মধ্যেই শক্তি প্রদর্শন সীমাবদ্ধ রাখে তারা।
আফগানিস্তানে যখন আইসিস-কে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তাদের নেতৃত্ব দিতেন হাফিজ সইদ খান। আইসিস-কে’র আমির (শীর্ষ নেতা) কিন্তু আদতে একজন পাকিস্তানি নাগরিক। উত্থানের সময় থেকেই পাকিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী, এমনকি পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-র সঙ্গেও ভাল সম্পর্ক ছিল তাদের। অন্যদিকে, তালিবানের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন হাফিজ সইদ খান। তাঁর প্রধান সহকারী ছিলেন প্রাক্তন তালিব নেতা আব্দুল রউফ আলিফা। তবে ২০১৫ সালেই মার্কিন বাহিনীর এয়ারস্ট্রাইকে প্রাণ হারান আব্দুল রউফ রাজা। পরের বছরই খতম করা হয় হাফিজ সইদ খানকেও। বর্তমানে এই জঙ্গি সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাহাব আল-মুহাজির।
দেশভাগের পর যারা ভারত থেকে (মূলত বিহার ও উত্তর প্রদেশ) যারা পাকিস্তান বা আফগানিস্তানে যান, তাদেরই মুহাজির বলা হয়। যদিও নিজের নামের শেষে মুহাজির ব্য়বহার করলেও আইসিস-কে শীর্ষ নেতার সঙ্গে ভারতীয় কোনও যোগ জানা যায়নি। আরবের বাসিন্দা সাহাব আল-মুহাজির আইসিস-কে’র দায়িত্বভার নেওয়ার আগে আল কায়েদার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। হাক্কানি নেটওয়ার্কেও তিনি কিছু সময় কম্যান্ডার ছিলেন। সেখান থেকে ২০২০ সালের জুন-জুলাই মাসে তিনি আইসিস-কের দায়িত্ব নেন। তবে গোয়েন্দাদের সন্দেহ মুহাজিরের আসল নাম আবু মোহাম্মদ সইদ খুরাসানি। আইসিস জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত খুরাসানিই আসলে সাহাব আল -মুজাহির।
তালিবানের নতুন ‘শত্রু’ আইসিস-কে! এত তাড়াতাড়ি এই কথাটা হলফ করে না বলা গেলেও, বেশ কিছু সূত্র এমনই আশঙ্কার সংকেত শোনাচ্ছে। যেমন ওয়াশিংটন সূত্রে খবর, ২০১৭-১৮ সালেই আফগান নাগরিকদের উপর কমপক্ষে ১০০টি হামলা চালিয়েছে দ্য ইসলামিক স্টেট খোরাসান বা আইসিস-কে। মার্কিন ও আফগান সেনা বাহিনী এমনকী পাক সেনাবাহিনীর উপরও ২৫০-র বেশি হামলা চালিয়েছে তারা। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে হামলা, আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি ভবনে রকেট হামলা ও ২০২০ সালে হামিদ কারজ়াই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হামলার পিছনেও ছিল আইসিস-কের হাত। তবে অনেক সময় ভুয়ো দায় স্বীকারেরও অভিযোগ রয়েছে এই জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে।
আইসিস বাহিনীর দখলে রয়েছে ইরাক ও সিরিয়া। অন্যদিকে, আইসিস-কের লক্ষ্য় প্রথমে আফগানিস্তান দখল এবং পরে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াতে ইসলামিক স্টেটের প্রতিপত্তি বিস্তার করা। নিজেদের জিহাদি গোষ্ঠী হিসাবে পরিচিত করতেই আগ্রহী আইসিস-কে-র আপাতত লক্ষ্য বিধ্বংসী হামলা চালানো। আফগানিস্তানে যেমন হাজারা ও শিখ গোষ্ঠী এবং সাংবাদিক, সমাজকর্মী, সরকারি ও সেনাবাহিনীর কর্মীদের নিশানা বানিয়েছেন তারা, তেমনই মার্কিন ও তাদের সহযোগী দেশগুলির উপরও হামলা চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
আইসিস-কের অন্যতম শক্তি হল স্থানীয় যোদ্ধা ও কম্যান্ডারদের নিজের দলে টানা। পাকিস্তানের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে আফগানিস্তানে তালিবান সংগঠন থেকেও নিজেদের সংগঠনকে শক্তিশালী করে তুলছে আইসিস কে। ইরাক ও সিরিয়ার আইসিস বাহিনীর কাছ থেকে অর্থ সাহায্যের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দেওয়ারও প্রমাণ মিলেছে।
সূত্রের খবর, বর্তমানে আইসিস-কে র অধীনে প্রায় ১৫০০ থেকে ২০০০ সৈন্য রয়েছে। তবে একাদিক ছোট ছোট জঙ্গি সংগঠন ও গরিলা বাহিনীও তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
শরিয়া আইনে বিশ্বাসী দুই জঙ্গি সংগঠনই। তবুও বিরোধ তালিবান ও আইসিস-কের মধ্যে। দুই সংগঠনই আফগানিস্তানে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য উঠে পড়ে লাগলেও প্রধান বিরোধ কিন্তু শরিয়া আইন ঘিরেই। আইসিসর-কে’র দাবি, তালিবানরা শরিয়া আইনে বিশ্বাসী বলে দাবি করলেও তারা সেই আইনকে কঠোরভাবে প্রয়োগই করেনি কখনও। বর্তমানেও আফগানবাসীর মন জয় করতে তারা শরিয়া আইনের কিছু নিয়মই প্রয়োগ করার কথা ঘোষণা করেছে। কিন্তু আইসিস-কে চায়, ইরাক, সিরিয়ার মতোই আফগানিস্তানেও কঠোরভাবে শরিয়া আইন প্রয়োগ করা হোক। ইসলামিক আইন যাতে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে, তার জন্য শরিয়া আইন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
আইসিস-কে আফগান তালিবানদের ‘জাতীয়তাবাদী’র তকমা দিয়েছে,যারা আফগানিস্তান সীমান্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে চায়। এ দিকে, আইসিস-কের লক্ষ্য আফগানিস্তানের গণ্ডি পার করে গোটা বিশ্বের জড়িয়ে পড়া। আইসিস-কের উত্থানের পর থেকেই তারা তালিবান গোষ্ঠীকে ভাঙিয়েও নিজেদের দল ভারী করার চেষ্টা চালিয়েছে। আফগানিস্তানে তালিবানের যে অবস্থান রয়েছে, তাও দখল করতে চায় আইসিস-কে।
অন্যদিকে, তালিবানের দাবি, ১৫ অগস্ট ক্ষমতায় আসার পরই ইসলামিক স্টেট অব সাউথ এশিয়া বা আইসিস-এসএ-র প্রধান আবু ওমার খোরাসানিকে খতম করেছে তারা। কাবুলের জেলেই বন্দি ছিলেন তিনি। খোরাসানিকে খতম করার বদলা নিতেই আইসিস-কে হামলা চালিয়েছে।
কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে হামলা চালানোর পরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছিলেন, যারা হামলা চালিয়েছে, তাদের কাউকে ক্ষমা করা হবে না। খুঁজে বের করে উচিত শাস্তি দেওয়া হবে। শুক্রবারই ড্রোন হামলাও চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী, যেখানে দুই আইসিস শীর্ষনেতার মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি আমেরিকার। তবে একইসঙ্গে বাইডেন জানিয়েছেন, জঙ্গি হামলা উদ্ধারকার্য থামাতে পারবে না। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই উদ্ধারকার্য শেষ করা হবে।
আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্য়াহারের সময় তালিবানরা যখন ক্ষমতাব প্রদর্শন করা শুরু করেছিল এবং একের পর এক প্রদেশ দখল করছিল, তখন কিন্তু আফগান সেনাকে সাহায্য করেনি মার্কিন বাহিনী। সেই আচরণ থেকেই আন্দাজ করা যায়, উদ্ধারকার্য শেষ হয়ে গেলে আফগানিস্তানে থাকবে না মার্কিন সেনা। বৃহস্পতিবারের হামলায় ২৩ জন মার্কিন সেনার মৃত্যু হওয়ায়, তার বদলা নিতেই পাল্টা হামলা চালিয়েছিল বাইডেন বাহিনী।
তালিবানরা আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই অন্য গোষ্ঠীর হামলা চালানোর ঘটনায় স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, ক্ষমতা বাড়িয়েছে আইসিস-কে। এই পরিস্থিতিতে আফগান সরকার নয়, বরং আইসিস-কের সঙ্গেই তালিবানের সংঘর্ষ শুরু হতে পারে। মার্কিন বাহিনী উদ্ধারকার্য ও সেনা প্রত্যাহারেই আপাতত মনোযোগী। এ দিকে আইসিস-কে যেভাবে হামলা চালিয়েছে, তাতে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে আফগানিস্তান দখলের চেষ্টা করতেই পারে তারা। সেক্ষেত্রে গৃহযুদ্ধ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে আফগান সেনার বিরুদ্ধে যেভাবে বিনা প্রতিরোধেই একের পর এক অঞ্চল দখল করেছিল তালিবানরা, আইসিস-কের জন্য পথ অতটা সুগম হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।
আইসিস-কের উৎপত্তি যেহেতু পাকিস্তানেই, সেই কারণে প্রতিবেশী দেশে অবাধ আনাগোনা রয়েছে তাদের। একইসঙ্গে পাকিস্তানের আদিবাসী ও জনজাতি-উপজাতির মধ্যেও যেভাবে জনপ্রিয় আইসিস-কে, তাতে প্রয়োজনে পাকিস্তানের মন জয় করতে কাশ্মীর দখলেরও চেষ্টা করতে পারে আইসিস-কে। পাকিস্তান সরাসরি স্বীকার না করলেও তারা তালিবানকেই সমর্থন করে এসেছে। এ বার আইসিস-কে ক্ষমতা দখল করলে, পাকিস্তানও দল পাল্টায় কিনা, তার উপরই কাশ্মীরের ভবিতব্য নির্ভর করছে।
আফগানিস্তান দখল করলেও সরকারের স্বীকৃতি জয় করতে আপাতত নরম মনোভাবই দেখাচ্ছে তালিবান। তারা কাশ্মীর বা ভারতের কোনও ইস্যুতে নাক গলাবে না বলেই দাবি করেছে। যদিও পাকিস্তানের সঙ্গে সখ্যতার কারণে ইতিমধ্যেই ভারত-পাক সীমান্তে ও জম্মু-কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। আফগানিস্তানের সঙ্গে আগামিদিনে ভারতের সম্পর্ক কীরকম হবে, তা নিয়েও উদ্বোগে রয়েছে নয়া দিল্লি। এই পরিস্থিতিতে আইসিস-কের মতো চরমপন্থী সংগঠন আরও উদ্বেগ বাড়াবে বলেই মনে করা হচ্ছে। আরও পড়ুন: বিশ্লেষণ: তালিবানকে শক্তিশালী বানাল কারা? নেপথ্যেই বা কে?