AQI
Sign In

By signing in or creating an account, you agree with Associated Broadcasting Company's Terms & Conditions and Privacy Policy.

কিউবাকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ তকমা ট্রাম্পের, নেপথ্যে ভেনেজুয়েলা সঙ্কট!

সোমবার মাইক পম্পেও জানিয়েছেন, ভেনেজুয়েলার (Venezuela) নেতা নিকোলাস মাদুরোকে সাহায্য তথা একাধিক কারণে ফের 'স্পনসর অব স্টেট টেররিজ়মের' তালিকায় আনা হল কিউবাকে। কেন ভেনেজুয়েলাকে সাহায্য করার জন্য 'সন্ত্রাসবাদী' তকমা পেতে হল কিউবাকে। কী পরিস্থিতি ভেনেজুয়েলার...

কিউবাকে 'সন্ত্রাসবাদী' তকমা ট্রাম্পের, নেপথ্যে ভেনেজুয়েলা সঙ্কট!
ফাইল চিত্র
| Updated on: Jan 12, 2021 | 6:18 PM
Share

কারাকাস: বিদায়কালে ফিদেল কাস্ত্রোর দেশ কিউবাকে (Cuba) ‘সন্ত্রাসবাদী’ তকমা দিয়ে গেলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump)। সোমবার মাইক পম্পেও জানিয়েছেন, ভেনেজুয়েলার (Venezuela) নেতা নিকোলাস মাদুরোকে সাহায্য তথা একাধিক কারণে ফের ‘স্পনসর অব স্টেট টেররিজ়মের’ তালিকায় আনা হল কিউবাকে। কেন ভেনেজুয়েলাকে সাহায্য করার জন্য ‘সন্ত্রাসবাদী’ তকমা পেতে হল কিউবাকে। কী পরিস্থিতি ভেনেজুয়েলার…

তরল সোনায় মোড়া দেশের দুর্বিষহ পরিণতি:

ভারতে ১০ কিলোমিটার ট্যাক্সি চড়লে সর্বোচ্চ খরচ পড়ে ১৬০ টাকা। ভেনেজুয়েলায় সেই খরচ প্রায় ১০ গুণ, ১,৬৬০ টাকা। দুজনের একবেলা খাবার খেতে ভারতে যদি ৩৪০ টাকা খরচ হয়, সে দেশে তার খরচ ১৫০০ টাকা। অর্থাৎ আন্দাজ করা যাচ্ছে কী বিপুল টাকা প্রয়োজন ভেনেজুয়েলায় বসবাস করতে। কিন্তু সে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে মানুষের কাছে পেট ভরে দুবেলা খাওয়া তো দূরের কথা সামান্য একটি ডিম কেনার পয়সাও নেই। আর পয়সা থাকলেও খাবার নেই।

৫-৬ ঘন্টা লাইন দিয়ে খাবার সংগ্রহ করতে গেলেও মেলে না খাবার। যাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য কম, তাঁরা প্রায় ২-৩ দিন আধপেটা খেয়ে থাকেন। এই তলানিতে থাকা অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়েছে করোনাভাইরাস। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে ক্ষুধা মেটাতে গবাদি পশুর রক্ত খেতেও দ্বিধা করছেন না ভেনেজুয়েলাবাসী। কিন্তু কেন সবচেয়ে বেশি তেলের সম্ভার-যুক্ত দেশের এমন শোচনীয় হাল? নষ্টের গোড়া অনেক গভীরে।

ছবি- টুইটার

ভেনেজুয়েলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:

১৯২২ সালে প্রথম তেলের সন্ধান মেলে ভেনেজুয়েলায়। তার আগে অবশ্য সেখানকার আদিবাসীরা এই তেল খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু ব্যবহার করতেন ভিন্ন ভাবে। ১৯২২ সালের মাত্র ৬ বছর পর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল রফতানিকারক দেশ হিসাবে নাম উঠে আসে ভেনেজুয়েলার। এরপর ১৯৪১ সালে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল তখন তরতরিয়ে বাড়ল তেলের দাম। তখন দিনে ১০ লক্ষ ব্যারেল তেল উৎপাদন করত ভেনেজুয়েলা।

অর্থাৎ তেলের বাজারে একছত্র রাজা হিসাবে মুনাফা লুটেছিল সেই দেশ। হু হু করে দাম বাড়ছিল ভেনেজুয়েলার মুদ্রা বলিভারের। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইরান, ইরাক, সৌদি আরবের মতো দেশ তেলের বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল। অর্থাৎ ভেনেজুয়েলার উৎপাদন থাকলেও চাহিদা ছিল না তেলের বাজারে। ফলে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয় তেল রফতানিকারক সব দেশকেই। তখন উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে তেলের দাম বাড়ানোর জন্য ওপেক চুক্তি সই করে ভেনেজুয়েলা, রাশিয়া, ইরান, ইরাক ও সৌদি আরব। তারপর বাজার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও তেমন আমূল কোনও পরিবর্তন আসেনি তেলের দামে।

আরও পড়ুন: ফিদেলের দেশকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ তকমা দিলেন ট্রাম্প

হুগো চাভেজের হাত ধরে ভেনেজুয়েলায় অভ্যুত্থান:

বিশ্বের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের তেল পাওয়া যায় ভেনেজুয়েলায়। কিন্তু তেলের বাজারে আশির গোড়ায় তেমন প্লাবন ছিল না। তাই সেভাবে বড় দেশ হিসাবে সামনে নাম আসেনি ভেনেজুয়েলার। বেকারত্ব, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে সে দেশে ক্ষোভ জন্মেছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে। এমন সময়ে সে দেশে নায়কের মতো উত্থান হুগো চাভেজের। এই সেনা আধিকারিক দাবি করেন তিনি ক্ষমতায় এলে গরিব মানুষের মুখে খাবার আর বেকারদের হাতে চাকরি দেবেন। প্রতিশ্রুতিতে গা ভাসিয়ে ভেনেজুয়েলার মানুষ ভোট দেন হুগো চাভেজকে।

১৯৯৯ সালে ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন হুগো চাভেজ। ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই ভাগ্য খুলে যায় চাভেজের। এক ধাক্বায় আকাশ ছোঁয় তেলের দাম। যা ভেনেজুয়েলার মতো তরল সোনা সমৃদ্ধ দেশের কাছে সোনায় সোহাগা। লাগাতার তেল রফতানি করে কাড়ি কাড়ি টাকা আয় করে ভেনেজুয়েলা সরকার। বাড়তি আয়ের টাকা গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেন হুগো চাভেজ। গড়ে তোলেন একাধিক জনপ্রকল্প। যার জোরে সে দেশের দারিদ্রতা সামান্য কয়েকটা দিনেই ৫০ শতাংশ কমে যায়। গড়ে তোলেন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল। ১৯৯৯ থেকে ২০১৩ ক্রমাগত তেলের বাজার থেকে আসা টাকা সামাজিক প্রকল্পে ব্যয় করে গিয়েছেন হুগো চাভেজ। যার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন বারাক ওবামা থেকে শুরু তৎকালীন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট।

কিন্তু এত উন্নয়নের মাঝেও বেশ কয়েকটি ভুল করে যান হুগো চাভেজ। যার সুদূরপ্রসারী ফল ভেনেজুয়েলার এই সঙ্কটের জন্য অনেকাংশেই দায়ী। হুগো কখনওই বেসরকারিকরণে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর আমলে তেলের উৎপাদন থেকে শুরু করে রফতানি পুরো বিষয়টাই ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ‘পেট্রোলিয়াম অব ভেনেজুয়েলা'(PDVSA) সংস্থার তত্ত্বাবধানে। সেখানে বিপুল কর্মসংস্থান শুরু করেন তিনি। এমন পরিস্থিতিও এসেছিল যে পিডিভিএসএতে বাড়তি কর্মচারীর সংখ্যা এত বেশি হয়ে গিয়েছিল যে কার্যত না কাজ করেই টাকা পেতেন কর্মচারীরা। তেল ছাড়া আর কোনও শিল্প বা কৃষি পরিকাঠামো গড়ে তোলেননি হুগো। অর্থাৎ তেল বাদে বাকি সব পণ্য আমদানি করতে হয় ভেনেজুয়েলাকে। হুগোর এই ভুলটাই ২০১৩ সালের পর কাঁটা হয় ভেনেজুয়েলার।

মাদুরোর হাতে মুদ্রাস্ফীতি:

২০১৩ সালে প্রাণ হারান হুগো চাভেজ। এরপর মসনদে বসেন ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট পার্টির আরেক হুগো অনুসারী নিকোলাস মাদুরো। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন হুগোর কোনও প্রকল্প বন্ধ করবেন না। কিন্তু মাদুরো মসনদে বসার পর থেকেই তেলের বাজারে ঘটে যায় অঘটন। ক্রমাগত দাম পড়তে থাকে তেলের। ফলে বন্ধ হয়ে যায় ভেনেজুয়েলার একমাত্র আয়ের রাস্তা। আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমাগত দাম পড়তে থাকে বলিভারের। ফলে দেশের অন্দরে দেখা দেয় প্রবল মুদ্রাস্ফীতি।

টাকা না থাকায় বন্ধ হয়ে যায় খাদ্য় আমদানি। যার জেরে প্রবল খাদ্য সঙ্কটের মুখে পড়তে হয় ভেনেজুয়েলাকে। শুরু হয় খাবার, জামা-কাপড়ের মতো অত্যাবশ্যক পণ্যের কালোবাজারি। খিদে মেটাতে বাজার থেকে পচা মাছ মাংস কিনতেও লাইন দিতে হয় ভেনেজুয়েলাবাসীকে। তারপরেও নেই খাদ্যের সুনিশ্চয়তা। পরিস্থিতি সামাল দিতে চাকরি থেকে অনেককে ছেটে ফেলেন মাদুরাই। ফলে খাদ্যের জন্য বাড়ে অপরাধ। খাদ্য চুরি থেকে শুরু করে খাবারের জন্য মানুষ খুন, চলে সবকিছু। অপরাধ প্রবন শহর হিসাবে বিশ্বে প্রথম স্থানে উঠে আসে ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাসের নাম।

ছবি- টুইটার

ভেনেজুয়েলা সঙ্কট:

১৯৯৯ থেকে  ভেনেজুয়েলায় ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট পার্টি ক্ষমতায়। বিরোধীরা বুঝতে পারে যে ক্ষমতা পরিবর্তনের এটাই মোক্ষম সময়। ফলে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন বিরোধী ডেমোক্র্য়াটিক কলিসন। এর মধ্যেই ২০১৮ সালে নির্বাচন হয় ভেনেজুয়েলায়। যেখানে নির্বাচনে জেতেন নিকোলাস মাদুরো। কিন্তু বিরোধীরা দাবি করে যে ভোটে কারচুপি করেছেন নিকোলাস মাদুরো। বিরোধী সংখ্যা গরিষ্ঠ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি সাফ জানিয়ে দেয় মাদুরো কারচুপি করেছেন, তাঁর মসনদে থাকার অধিকার নেই। কিন্তু এর বিরুদ্ধে রায় দেয় সুপ্রিম ট্রিবুনাল অব জাস্টিস।

যদিও বিরোধীদের দাবি সুপ্রিম কোর্টে অধিকাংশ বিচারপতিই মাদুরো মনোনীত। তাই তাঁরা মাদুরোর পক্ষে রায় দিয়েছেন। ২৩ জানুয়ারি নিজেকে প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা করেন বিরোধী দলনেতা জোয়ান গাইদো। অন্য দিকে দ্বিতীয় দফার শপথ গ্রহণ করেন মাদুরো। এরপর থেকেই শহর ভেদে ভেনেজুয়েলার মানুষের প্রেসিডেন্টও আলাদা। কেউ বিশ্বাস করেন তাঁদের প্রেসিডেন্ট মাদুরো তো কেউ গাইদো। কয়েকটি আদালতের রায় গাইদোর পক্ষে তো কয়েকটির মাদুরোর পক্ষে। অর্থাৎ ভেনেজুয়েলার রাশ কার হাতে থাকবে এ এখনও অনিশ্চিত।

এমনকি আমেরিকা-সহ বিদেশের ৫০ জন রাষ্ট্র প্রধান মনে করেন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট গাইদো। যেখানে রাশিয়া ও চিনের মতে প্রেসিডেন্ট মাদুরো। রাষ্ট্রসঙ্ঘে একাধিকবার সে দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রসঙ্গ উঠলেও স্থায়ী কোনও নিস্পত্তি মেলেনি। যার সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছেন সে দেশের সাধারণ মানুষ। প্রবল দারিদ্র্যর জন্য তাঁদের খাবার খুঁজতে হচ্ছে ডাস্টবিনেও।

পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে একদা তেল রফতানিতে প্রথম এই দেশের নাম প্রথম দশ তেল রফতানিকারক দেশের মধ্যেও নেই এখন। এখন দৈনিক ১২ লক্ষ ব্যারেল তেল উৎপাদিত হয় ভেনেজুয়েলাও। যা দিনদিন আরও কমছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, যদি বাইরের কোনও দেশ ভেনেজুয়েলার সমস্যা সমাধানে না এগিয়ে আসে তাহলে আরও অন্ধকারে ডুবে যাবে ভেনেজুয়েলা। আমেরিকা গাইদোকে সমর্থন করে, কিউবা, রাশিয়া ও চিন মাদুরোকে তবে ভারত কোনও পক্ষের সমর্থনেই নেই। স্বঘোষিত গাইদোকে হোয়াইট হাউস সমর্থন করলেও সে পথে হাঁটেনি ভারত। এই প্রসঙ্গে ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র জানিয়ে ছিলেন ভারত গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। তাই কোনও পক্ষের সমর্থনে না গিয়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী তারা।