Explained: এই রোকো পৃথিবীর গাড়িটা থামাও…সুনীতা উঠবেন
Explained: ৫ জুন ২০২৪ একটি বিশেষ মিশন নিয়ে মহাকাশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন সুনীতা উইলিয়ামস এবং বুচ উইলমোরে। মাত্র ৮ দিন পরেই তাঁদের ফিরে আসার কথা ছিল। স্টারলাইনের যে বোয়িং স্টারশিপে করে মহাকাশে গিয়েছিলেন ফেরার কথা ছিল তাতেই।

কথা ছিল মাত্র ৮ দিনের, কিন্তু কপালে লিখন খন্ডাবে কে? ৮ দিনের জন্য গিয়ে ৯ মাস মহাকাশেই থেকে যেত হল সুনীতা উইলিয়ামসকে। অবশেষে বাড়ি ফেরার পথে তিনি। কেমন ছিল তাঁর এই দীর্ঘ ৯ মাসের সফর? কেন হঠাৎ আটকে পড়তে হয়েছিল সুনীতা উলিয়ামস এবং বুচ উইলমোরেকে? কবে ফিরবেন তিনি? এখন কেমন আছেন? রইল বিস্তারিত!
৫ জুন ২০২৪ একটি বিশেষ মিশন নিয়ে মহাকাশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন সুনীতা উইলিয়ামস এবং বুচ উইলমোরে। মাত্র ৮ দিন পরেই তাঁদের ফিরে আসার কথা ছিল। স্টারলাইনের যে বোয়িং স্টারশিপে করে মহাকাশে গিয়েছিলেন ফেরার কথা ছিল তাতেই। কিন্তু ফেরার আগেই কিছু যান্ত্রিক গোলযোগ ধরা পড়ে ওই ক্যাপসুলে। তাই নাসা সুনীতাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওই মহাকাশযানে ফেরার অনুমতি দেয়নি। আটকে পড়েন ওঁরা।
জানুয়ারি মাসে মসনদে বসে সুনীতাদের ফেরানোর বিষয়ে জোর দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তারপরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মার্চ মাসে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে সুনীতাদের।
কবে ফিরবেন?
নাসা জানায়, ইলন মাস্কের সংস্থা স্পেসএক্স নির্মিত মহাকাশযান ক্রিউ-১০ করে ফিরবেন তাঁরা। ফ্যালকন ৯ রকেটে করে মহাকাশে পাঠানো হয় ক্রিউ-১০কে। শুক্রবার ১৪ মার্চ ভারতীয় সময় অনুসারে শনিবার ভোরে ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল রকেট।
ভারতীয় সময় অনুসারে রবিবার সকাল ৯টা ৩৫মিনিটে মহাকাশে গিয়ে ইন্টারন্যাশানাল স্পেস স্টেশনে ডক করে ক্রিউ-১০। প্রটোকল মেনে ১ ঘন্টা পরে খোলে দরজা। ক্রিউ-১০ করে মহাকাশে পাড়ি দিয়েছেন ৪ মহাকাশচারীও। তার মধ্যে আছেন নাসার অ্যান ম্যাক্লেন, নিকোল আইয়ার্স, জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা জাক্সার প্রতিনিধি টাকুয়া ওনিশি এবং রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা রসকসমসের প্রতিনিধি কিরিল পেসকভ।
সুনীতা এবং বুচের সঙ্গে পৃথিবীতে ফিরবেন নাসার আরেক নভশ্চর নিক হগ এবং রাশিয়ান নভশ্চর আলেকজান্ডার গর্বুনভ। কিছুদিন আগে ড্রাগন যানে চড়ে মহাকাশে গিয়েছিলেন তাঁরা।
নাসা জানিয়েছে মঙ্গলবার বিকেলে পৃথিবীতে ফিরে আসবেন সুনীতা উইলিয়ামস ও বুচ উইলমোরেরা। মার্কিন সময় অনুসারে মঙ্গলবার বিকেল ৫টা ৫৭ মিনিটে পৃথিবীর বুকে অবতরণ করবে মহাকাশযান।
তবে পৃথিবীতে ফিরে আসার এই যাত্রা আরামদায়ক হবে না। ফ্লোরিডার উপকূলে সমুদ্রের মধ্যে ছিটকে পড়বে মহাকাশযানের অংশ। তারপর সেই ক্য়াপসুল থেকে বেরিয়ে আসবেন সুনীতারা। তবে সমুদ্রের মাঝে ছিটকে পড়লেও, এতে সুনীতা উইলিয়ামস বা তাঁর সহযাত্রীদের কোনও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই ক্যাপসুল এমনভাবেই তৈরি যে কোনওভাবে ভিতরে জল ঢুকবে না। সমুদ্রে আছড়ে পড়ার সময়ও তীব্র ঝাঁকুনিতে কোনও ক্ষতিও হবে না। প্রত্যেক মহাকাশচারীর শরীরের আকৃতি অনুসারে বিশেষ ভাবে ডিজাইন করা এই যান। শুধু তাই নয় সোমবার সন্ধে থেকেই সুনীতা উইলিয়ামসদের ঘরে ফেরার লাইভ ব্রডকাস্ট শুরু হবে। মহাকাশযানের দরজা বা হ্যাচ বন্ধ হওয়ার প্রস্তুতি থেকে পৃথিবীতে ফেরা-পুরোটাই দেখতে পারবেন আপনিও!
প্রায় ৩০০ দিন মহাকাশে আটকে থাকার জন্য অতিরিক্ত বেতন পাবেন সুনীতা। তিনি এখন নাসার সর্বোচ্চ স্তর জিএস-১৫তে রয়েছেন। এই শ্রেণিতে কর্মীদের বার্ষিক বেতন সর্বোচ্চ ১ লক্ষ ৬২ হাজার ৬৭২ ডলার পর্যন্ত হতে পারে। ভারতীয় মুদ্রায় এই অঙ্কটা দাঁড়ায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা। কোনও কারণে অভিযান দীর্ঘায়িত হলে প্রতিদিন মাত্র ৪ ডলার করে দেওয়া হয় মহাকাশচারীদের। সেই হিসাবে ১১৪৮ ডলারের কাছাকাছি পেতে পারেন সুনীতারা।
যদিও ৯ মাস স্পেস স্টেশনে কেটেছে সুনীতাদের, তবে সেখানে খাওয়া দাওয়ার কোনও অসুবিধা হয় না। ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল থেকে শুরু করে গুড়ো দুধ, পিৎজা, শ্রিম্প ককটেল, রোস্টেড চিকেন, টুনা মাছ থাকে সবই। তিন মাসে একবার করে ফ্রেশ শাকসব্জি পাঠানো হয় স্পেস স্টেশনে, যা প্যাকেটজাত করে রাখা হয়। ডিহাইড্রেটেড স্যুপ, স্ট্যু থাকে মেনুতে। রয়েছে ৫৩০ গ্যালনের জলের ট্যাঙ্ক।
শারীরিক সমস্যা –
দীর্ঘদিন মহাকাশে থাকার ফলে নানা শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তাঁরা। পায়ে চাপ দিয়ে না হাঁটার ফলে সুনীতার পায়ের পাতাও বাচ্চাদের মতো হয়ে গিয়েছে। একে ‘বেবি ফিট’ বলে। ফলে পৃথিবীতে এসে হাঁটতে পারাটাই দায় হয়ে ওঠে।
হ্রাস পেয়েছে হাড়ের ঘনত্ব। নাসার মতে, মহাকাশে প্রতি মাসে, নভোচারীদের ওজন বহনকারী হাড়ের ঘনত্ব প্রায় এক শতাংশ কম হয়ে যায় যদি তাঁরা পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন।
মহাকাশে মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে হার্টকে বেশি পাম্প করতে হয় না। ফলে পরিশ্রম কম হয়, শরীরে রক্ত প্রবাহের ধরণও পরিবর্তিত হয়। দৃষ্টি শক্তিতে প্রভাব পড়তে পারে। শরীরে রক্তের পরিমাণ কমে যেতে পারে।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এবং চৌম্বক ক্ষেত্র উচ্চ মাত্রার ক্ষতিকারক রেডিয়শনের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করে। মহাকাশে সেই সব রক্ষা কবচ নেই তাই তা মানবদেহের ক্ষতি করে।
দীর্ঘ সময় সকলের থেকে দূরে থাকার কারণে মানসিক সমস্যাও দেখা যায়। স্ট্রেস, উদ্বেগ, এমনকী ডিপ্রেশনও দেখা দিতে পারে।
প্রথম মহাকাশ যাত্রা –
মহাকাশ নিয়ে সুনীতার পথচলা শুরু ১৯৯৮ সালে। সেই বছর মহাকাশচারী হিসাবে নাসা বেছে নেয় সুনীতাকে। দীর্ঘ ৮ বছরের ট্রেনিং শেষে ২০০৬ সালে প্রথম মহাকাশে পাড়ি দেন তিনি। সেই বারেও ছয় মাসের জন্য মহাকাশে গিয়ে যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে সাত মাস কাটাতে বাধ্য হয়েছিলেন অন্তরীক্ষে।
রেকর্ড –
নিজের দীর্ঘ কেরিয়ারে বহু ছোট বড় রেকর্ড গড়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভুত এই মহাকাশচারী। সুনীতাই হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি পৃথিবীতে নয়, মহাকাশে ম্যারাথন দৌড়ে অংশগ্রহণ করেন। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে ট্রেডমিলে তিনি বোস্টন ম্যারাথন শেষ করেন।
২০১৭ সালে মহিলা হিসাবে সবচেয়ে বেশিদিন স্পেসফ্লাইটে কাটানোর রেকর্ড গড়েন। ১৯৫ দিন অরবিটে কাটিয়েছিলেন সুনীতা।
এর আগেও ৩২২ দিন মহাকাশে আটকে ছিলেন তিনি। একজন মহিলা মহাকাশচারী হিসাবে নজির গড়েছেন।
সাতটি স্পেস ওয়াক সম্পন্ন করেছেন তিনি, ৫০ ঘন্টার বেশি সময় মহাকাশে ভেসে কাটিয়েছেন সুনীতা। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে টানা ৬২ ঘন্টা ৬ মিনিট স্পেস ওয়াক করে নতুন রেকর্ড গড়েছেন তিনি।
২০১২ সালে একটি নতুন ধরনের রেকর্ড গড়েন। সুনীতাই প্রথম ব্যক্তি যিনি মহাকাশে ট্রায়াথলন সম্পন্ন করেন। সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো বা ট্রেডমিলে দৌড়ানোর মতো অনুশীলন করেন। যা মাধ্যাকর্ষণহীন মহাবিশ্বে করাটা কার্যত অসম্ভব।
মহাকাশ গবেষণায় এই অনন্য অবদানের জন্য নৌবাহিনীর প্রশংসা পদক, নাসা স্পেসফ্লাইট পদক পেয়েছেন। ২০০৮ সালে ভারতের মর্যাদাপূর্ণ পদ্মভূষণে সম্মানিত করা হয় তাঁকে। এখন গোটা বিশ্ব তাকিয়ে শুধু সুনীতা উইলিয়ামসদের ঘরে ফেরার দিকে।





