ফিরে দেখা নন্দীগ্রাম: লক্ষ্মণ শেঠের নোটিসে রাতারাতি বদলে গেল দেহাতি মানুষগুলো…তারপর

বিশ্লেষকদের একটা বড় অংশ এই বিষয়ে সহমত পোষণ করেন যে মসনদে মমতা বসার পিছনে সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামের অবদান অনেক।

ফিরে দেখা নন্দীগ্রাম: লক্ষ্মণ শেঠের নোটিসে রাতারাতি বদলে গেল দেহাতি মানুষগুলো...তারপর
গ্রাফিক্স- অভীক দেবনাথ
Follow Us:
| Updated on: May 26, 2021 | 10:49 AM

নন্দীগ্রাম: তেখালি, রেয়াপাড়া, ভাঙাবেড়া, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য (Buddhadeb Bhattacharjee), মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee), সালেম গোষ্ঠী, শুভেন্দু অধিকারী (Suvendu Adhikary)। এলোমেলো বেশ কয়েকটা শব্দ। কিন্তু এই নামগুলির রাজনৈতিক তাৎপর্য অনেক। কারণ ১৪ বছর আগে এই নামগুলি জুড়েই সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছিল নন্দীগ্রাম। ২০০৭ সালের ১৪ মার্চের সেই ঘটনাকে কেউ বলেন নন্দীগ্রাম গণহত্যা (Nandigram Violence), কেউ বলেন সংঘর্ষ আবার কেউ বলেন নন্দীগ্রাম গণ আন্দোলন। তবে বিশ্লেষকদের একটা বড় অংশ এই বিষয়ে সহমত পোষণ করেন যে মসনদে মমতা বসার পিছনে সিঙ্গুর (Singur) আর নন্দীগ্রামের (Nandigram) অবদান অনেক।

২০২১ সালের ১৪ মার্চ, নন্দীগ্রামের (Nandigram) ঘটনার পর কেটে গিয়েছে এক দশকেরও বেশি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) পায়ে প্লাস্টার। ‘নন্দীগ্রাম দিবসে’ ভাঙা পায়েই পথে নামলেন মমতা। সঙ্গী হুইল চেয়ার। পথে নেমে তৃণমূল সুপ্রিমোর হুঙ্কার, “মনে রাখবেন নিহত বাঘের থেকে আহত বাঘ বেশি ভয়ঙ্কর।” শুভেন্দু-মমতার লড়াইয়ে কার্যত গোটা বাংলার মূল ফোকাসে নন্দীগ্রাম। আর নন্দীগ্রাম দিবসে পথে নামার আগে টুইটে ১৪ বছর আগের সেই ইতিহাস ফের ফিরিয়ে আনলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টুইটে তৃণমূল নেত্রী (Mamata Banerjee) লিখেছেন, “২০০৭ সালে এই দিনেই নিরপরাধ গ্রামবাসীদের ওপর গুলি চলেছিল। কত দেহের এখনও খোঁজ মেলেনি। এটা রাজ্যের ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়।”

সিবিআই চার্জশিট পেশ করলেও সেই কালো অধ্যায়ের জট নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিভিন্ন মত। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা যে রিপোর্ট পেশ করেছিল, তাতে ক্লিনচিট পেয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য (Buddhadeb Bhattacharjee)। তবে বারবার নন্দীগ্রামের সেই ঘটনায় লাল শিবিরকেই দুষেছে ঘাসফুল (TMC)। কেউ কেউ বলেন, নন্দীগ্রাম আন্দোলনের ব্যাকবোন মমতা হলেও সেনাপতিত্ব করেছেন শুভেন্দুই। রাজনীতির মোড়ে আজ যখন শুভেন্দু অধিকারী মমতার প্রতিপক্ষ, তখন প্রশ্ন উঠছে নন্দীগ্রাম আন্দোলন আসলে কার?

সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ফিরে যেতে হবে ১৪ বছর আগে আজকের দিনেই। ১৪ মার্চ, ২০০৭, কাঁদানে গ্যাস, রবার বুলেটের পর গ্রামবাসীর উদ্দেশে গুলি চালায় পুলিশ। মৃত্যু হয় কমপক্ষে ১৪ জনের। নিখোঁজ আর আহতের সংখ্যা আরও বেশি। তবে ১৪ মার্চের প্লট তৈরি হয়েছিল লক্ষ্মণ শেঠের একটি নোটিসে। সালটা ২০০৬, তারিখ ২৮ ডিসেম্বর।

লক্ষ্মণ শেঠের নোটিস:

নন্দীগ্রাম। মাঝখানে নদী। আবার ওপারে উন্নত শিল্পাঞ্চল হলদিয়া (Haldia)। সেখানে পেট্রোক্যামিক্যাল শিল্পের রমরমা। তৎকালীন সরকার ঠিক করেছিল, নদীর এপারেও গড়ে উঠবে উন্নত শিল্পাঞ্চল। তাই প্রয়োজন জমি। নন্দীগ্রামের জমিতেই শিল্প গড়ে তুলবে ইন্দোনেশিয়ার সালেম গোষ্ঠী। সেই মতো ২০০৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর লক্ষ্মণ শেঠের নিয়ন্ত্রণাধীন হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের  তরফে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত একটি নোটিস জারি হয়। যেখানে জানানো হয় নন্দীগ্রামের ২৫টি ও খেজুরির ২টি মৌজা মিলিয়ে মোট ২৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করবে সরকার। আগেই ঘটে গিয়েছে সিঙ্গুর। তাই নন্দীগ্রামে তখন জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠে আগুন। বিরোধীরা দাবি করেন, জোর করে কৃষকের চাষের জমি হাতিয়ে নিতে চাইছে সরকার। পাল্টা জমির দাবি করে সরকার। শুরু হয় চাপানউতর।

History Of Nandigram

ফিরে দেখা নন্দীগ্রাম

৩ জানুয়ারি, ২০০৭ জমির জন্য লড়াই:

অধিগ্রহণ সংক্রান্ত নোটিস জারি হতেই নন্দীগ্রামে (Nandigram) জ্বলে ওঠে আগুন। লক্ষ্মণ শেঠের নোটিসের বিরুদ্ধে জমির দাবি নিয়ে কালীচরণপুর পঞ্চায়েত জমা হন আন্দোলনকারীরা। আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করতে লাঠি চালায় পুলিশ। পাল্টা আগুন জ্বলে পুলিশের জিপে। কারণ হিসেবে উঠে আসে বোমা ফাটা কিংবা দুর্ঘটনার তত্ত্ব। উত্তেজিত জনতা নন্দীগ্রামের একাধিক রাস্তা কেটে দেয়। সংঘর্ষ হয় ওই এলাকার সিপিএম সমর্থকদের সঙ্গে। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, সিপিএম সমর্থকদের আশ্রয় নিতে হয়ে নদীর ওপারে খেজুরিতে।

History of Nandigram

ফিরে দেখা নন্দীগ্রাম

৫ জানুয়ারি, ২০০৭, যাত্রা শুরু বিইউপিসির:

জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। সেই কমিটিতে পূর্ণ সমর্থন জানায় তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট দল এসইউসিআই।

৭ জানুয়ারি, ২০০৭, শঙ্কর সামন্তের বাড়িতে আগুন:

৭ জানুয়ারি ফের গুলি চলে নন্দীগ্রামে। মৃত্যু হয় পাঁচ জনের। গ্রামবাসীদের একাংশের মতে গুলি চলেছিল শঙ্কর সামন্তের বাড়ি থেকে। তারপরই খেজুরির একটি সিপিএম ক্যাম্প ও সিপিএম সমর্থক শঙ্কর সামন্তের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় উত্তেজিত গ্রামবাসী। সেই আগুনেই দগ্ধ হয়ে মারা যান শঙ্কর। এই ঘটনার পর স্থানীয় পুলিশ, বিরোধী ও শাসক দলের মধ্যে একটি শান্তি বৈঠক করে। তবে এই ঘটনায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কাঠগড়ায় তুলেছিলেন জমিয়ত উলেমা-ই-হিন্দ নামে একটি মুসলিম সংগঠন ও বিইউপিসিকে। তা ছাড়া লক্ষ্মণ শেঠের নিয়ন্ত্রণাধীন হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের নোটিসকেও ‘ভুল’ বলে মেনে নেন তিনি।

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭, খেজুরিতে বুদ্ধদেব:

রাতের অন্ধকারে সিপিএম সমর্থকদের সঙ্গে লাগাতার সংঘর্ষ চলতে থাকে বিইউপিসির। বিইউপিসি দাবি করে সিপিএমের ক্যাডাররা নন্দীগ্রামে মানুষের মধ্যে ভয় ছড়াচ্ছে।  শাসক দলের পাল্টা দাবি, নন্দীগ্রামে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে মাওবাদীরা। এর মধ্যেই নন্দীগ্রাম লাগোয়া খেজুরিতে সভা করেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সভায় বুদ্ধবাবু জানান, যাঁরা জমি দিতে চান না তাঁদের কাছ থেকে জমি নেওয়া হবে না।

১৪ মার্চ রক্তাক্ত নন্দীগ্রাম:

১৩ মার্চ তৎকালীন তৃণমূল বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী  চিঠি লিখে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে (Buddhadeb Bhattacharjee) জানান, নন্দীগ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে ত্রাস ছড়াচ্ছে পুলিশ। আর পরদিনই ঘটে যায় নন্দীগ্রামের ভয়াবহ সেই দিন। প্রশাসনের তরফে বলা হয়েছিল নন্দীগ্রামের কাটা রাস্তা মেরামত করতে সেখানে যাচ্ছিল পুলিশ। কিন্তু বিরোধী ও ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির দাবি ছিল, সে দিনই জমি অধিগ্রহণ করতে এসেছিল প্রশাসন। তাই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ঝাঁটা, লাঠি, খুন্তি, কাটারি নিয়ে জড়ো হন নন্দীগ্রামের প্রায় ৫,০০০ সাধারণ গ্রামবাসী, নেতৃত্বে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। দু’ দিক দিয়ে গ্রামে ঢোকার চেষ্টা করে পুলিশ। একদল তেখালি ব্রিজ দিয়ে, অন্য দল ভাঙাবেড়া ব্রিজ দিয়ে। সেখানে খণ্ডযুদ্ধ বাধে পুলিশ ও গ্রামবাসীদের মধ্যে। পুলিশের দাবি একাধিকবার মাইকিং করার পরেও রাস্তা ছাড়েনি গ্রামবাসীরা। কার্যত প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে কাঁদানে গ্যাস, রবার বুলেটের পর গুলি চালায় পুলিশ। যার ফলে মৃত্যু হয় ১৪ জনের। নিখোঁজ হন অনেকে। আহত অগণিত। তবে এই আকস্মিক ঘটনা অন্য মাত্রা পায় যখন প্রকাশ্যে আসে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা। অভিযোগ ওঠে নন্দীগ্রামে আন্দোলনের সময় ধর্ষিত হয়েছেন একাধিক মহিলা। সব ক্ষেত্রেই অভিযোগের আঙুল সিপিএম (CPIM) ক্যাডারদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ ওঠে সে দিন হাজারো পুলিশের সঙ্গে ছদ্মবেশে গ্রামে ঢুকেছিলেন চপ্পলধারী সিপিএম ক্যাডাররা।

History of Nandigram

ফিরে দেখা নন্দীগ্রাম

নন্দীগ্রামের সেই ১৪ জনের মৃত্যুর পরেও একাধিকবার সংঘর্ষের খবর এসেছে। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর নন্দীগ্রামে আন্দোলনের রেশ বাড়িয়েছিলেন শুভেন্দু, তাহের, সুফিয়ানরা। নন্দীগ্রামে একের পর এক লাশ, সেই প্রেক্ষাপটে সরকার বিরোধী আওয়াজ তুলেছিলেন অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো অনেক বুদ্ধিজীবী। ‘নন্দীগ্রাম কসাইখানায় পরিণত হয়েছে’ সেই মর্মে মানবাধিকার কমিশনকে চিঠি লিখেছিলেন মেধা পাটকর। তবে নন্দীগ্রাম সবকিছুর পরেও অনেক প্রশ্নের সূত্রপাতের জায়গা। প্রশ্ন উঠেছিল,সরকার বিরোধী আওয়াজ তোলা নিয়ে। প্রশ্ন উঠেছিল বর্তমান শাসক দলের অনেক নেতাকে নিয়ে। বিশ্লেষক মহলে এখনও আলোচিত হয়, নন্দীগ্রামের আন্দোলন শাসক দলের মস্তিষ্কপ্রসূত একটা আন্দোলন নয় তো? যা ‘লাল শাসন’-এর শেষের কফিনের শেষ পেরেকের ঘা দিয়ছিল। প্রশ্ন ওঠে কে সেই জমি প্রতিরোধের নেতা নারায়ণ কি মাওবাদী? প্রশ্ন  এখনও ওঠে । সিঙ্গুরের মতো নন্দীগ্রামের মাটিতে আজও নিস্ফলা শিল্প, সেই প্রসঙ্গ আজও বর্তমান সরকারকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। বাম সরকারের জমি অধিগ্রহণ নীতি কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।

History of Nandigram

ফিরে দেখা নন্দীগ্রাম

আজকে নন্দীগ্রামের তাৎপর্য:

নন্দীগ্রামের সেই গুলি চালানো ভুল সিদ্ধান্ত বলে পরবর্তীকালে মেনে নিয়েছিলেন বুদ্ধবাবু। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের জোয়ারে ভেসেই লাল জমানার ইতি টেনেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর থেকে প্রত্যেক বছর এই দিনটিকে নন্দীগ্রামের শহিদ দিবস হিসেবে পালন করে তৃণমূল। কিন্তু আজ অন্য প্রসঙ্গে ফের সংবাদ শিরোনামে নন্দীগ্রাম। বিধানসভা নির্বাচনে ‘হটসিট’ নন্দীগ্রাম। বিশ্লেষকদের মতে, কার্যত একে অপরের রাজনৈতিক ভবিষ্যতকে বড় প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে ভোটে লড়ছেন দুই যুযুধান, মমতা-শুভেন্দু। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের কৃতিত্ব নিয়ে আগেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে দুই যুযুধানের মধ্যে। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির ব্যানারেই একই দিনে দু’টি সভা হয়েছে নন্দীগ্রামে। শহিদ দিবসে একদিকে যখন হুইলচেয়ারে মমতা অন্যদিকে নন্দীগ্রামে শুভেন্দু। দুই ‘হেভিওয়েটের’ জোর লড়াই, একদিকে নেত্রী অন্যদিকে নেত্রীর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের প্রাক্তন সেনাপতি।