মেলালেন পিকে মেলালেন, ‘প্রশান্ত সাগরে’ ডুবল গেরুয়া জাহাজ
তৃণমূলের ভিতরেই তাঁকে প্রশান্ত কিশোর (Prashant Kishor) কে নিয়ে এক শ্রেণির নেতার অসন্তোষ ছিল। পিকে বললেন, এখানে বন্ধু পাতাতে আসিনি। কাজ করতে এসেছি। পক্ষের এবং বিপক্ষের শক্তি-দুর্বলতা বুঝে সেই অনুযায়ী ঘুঁটি সাজানোতেই মন দিয়েছিলেন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গ: গত বছর ডিসেম্বর মাস। বাংলাকে পাখির চোখ করে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের বারবার যাতায়াত, স্লোগান তুলছেন এবার বিজেপি দুশো পার। সেই সময় দাঁড়িয়ে তৃণমূলের ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোর (Prashant Kishor)- এর একটি ইংরেজিতে টুইট। বাংলায় বিজেপি ২ অঙ্ক পেরোতে হিমসশিম খাবে। আর দুই অঙ্ক পেরোলে নিজের জায়গা ছেড়ে দেব। অনেকে ভেবেছিলেন মাইক্রো ব্লগিং সাইট ছাড়ার চ্যালেঞ্জ করছেন পিকে। কিন্তু না, তিনি নিজেই পরিষ্কার করে দেন, বিজেপি বাংলায় দুই অঙ্ক পেরলে এই ভোট কুশলী পেশাই ছেড়েই দেবেন।
কাট-টু দুই মে। ভোটের ফলাফল প্রকাশের দিন প্রাথমিক প্রবণতায় বারবার প্রতিফলিত হয় পিকের সেই টুইট বার্তাই। কীভাবে এতটা নিশ্চিত ছিলেন তিনি? নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসেবে তাঁর পুরনো রেকর্ড কী বলছে?
ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোর:
ভারতের ভোট রাজনীতিতে তিনি যেন রাজা মিডাস। কোনও রাজনৈতিক দলে না থেকেও পিকে একটা ফ্যাক্টর হয়েছেন। যেখানে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলেছে। সেই তালিকায় আছে গুজরাট, বিহার, পঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্র প্রদেশ আর তারপর এই বাংলা। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনকে বিজেপিকে রুখে দিয়ে তৃণমূলের তৃতীয় বার জয়ের নেপথ্যে নায়ক তিনিই। সঙ্গে রয়েছে তামিলনাড়ুর ডিএমকে-ও।
কে এই প্রশান্ত কিশোর?
তাঁর সাফল্যের রসায়নই বা কী? জন্ম বিহারের রোহতাস জেলার কোরান গ্রামে। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার চলে যান বিহারেরই বক্সারে। হায়দরাবাদে ইঞ্জিনয়ারিং ডিগ্রি নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের স্বাস্থ্য বিভাগে যোগ দেন প্রশান্ত। কর্মস্থল ছিল আফ্রিকা। সেখানে দীর্ঘ আট বছর চাকরি করেন তিনি। কিন্তু সেই মোটা মাইনের নিশ্চিত চাকরি ছেড়ে ২০১১ সালে ফিরে আসেন দেশে। তৈরি করেন একটা সংস্থা। যার নাম সিটিজেন্স ফর অ্যাকাউন্টেবল গভর্নমেন্ট (সিএজি)। আইআইটি-আইআইএম-এর পেশাদার লোকজনকে নিয়ে এই সংস্থার কাজ। এদিকে পরের বছরই গুজরাটে বিধানসভা।
২০০১ সাল থেকে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে তখন প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া প্রবল। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া থেকে গুজরাটের মাঠ -ময়দান জুড়ে প্রশান্ত কিশোরের বেঁধে দেওয়া ছকেই খুব সহজে ক্ষমতায় আসেন নরেন্দ্র মোদী। গুজরাটের গণ্ডি ছাড়িয়ে মোদীর লক্ষ্য আরও বৃহত্তর হল। কাঁধে দায়িত্ব বাড়ল পিকে-রও।
২০১৪ সালেরই লোকসভা ভোট। প্রশান্ত কিশোরের মস্তিষ্কপ্রসূত ‘চায়ে পে চর্চা’, ‘রান ফর ইউনিটি’র মতো কর্মসূচি ব্যাপক ছাপ পেলে জনমানসে। আর সেই সবের হাত ধরেই দেশ জুড়ে বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মোদী। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রীর পদে উত্তরণ হল মোদীর। কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর দলের পিকের সঙ্গে শুরু হল কিছু জায়গায় বিরোধ। সেই সময়ই নিজের সংস্থা সিএজি-র নাম পরিবর্তন করে মার্কিন মুলুকের কানাডার সংস্থা পিএসির অনুকরণে গড়ে তুললেন ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি (আইপিএসি)। মার্কিন মুলুকে যেমন বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের ভোটপ্রচার এবং রণকৌশল তৈরির কাজ করে এই পেশাদার সংস্থা। এ দেশেও সেটাই শুরু করলেন পিকে।
স্ট্রাটেজিস্ট হিসেবে ২০১৫ সালে বিহারে নীতীশ কুমারের দলের কাজ শুরু করলেন। ওই বছরই বিহার বিধানসভার ভোট। জেডেইউ এবং কংগ্রেস মিলে মহাজোট তৈরি করে ভোটে লড়ে। মেলে ব্যাপক সাফল্য। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হলেন নীতীশ কুমার। তার পরও নীতীশের উপদেষ্টা হিসেবে বেশ কিছু জনমুখী পরিকল্পনার রূপায়ন হয় তাঁর হাত ধরেই। সেই সঙ্গে দলের দ্বিতীয় প্রধান হিসেবে যোগ দেন প্রশান্ত কিশোর।
আবার জেডিইউ-এর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ না করেও ভোটকুশলী হিসেবে ২০১৬ সালের পঞ্জাব বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের হয়ে কাজ করেন পিকে। তার আগের দু’টি নির্বাচনে হেরেছে কংগ্রেস। সেখান থেকে তুলে এনে ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং পেলেন নিশ্চিত জয়। কারিগর সেই পিকে।
যদিও পরের বছরই উত্তর প্রদেশ বিধানসভার কেরিয়ারের প্রথম এবং একমাত্র ধাক্কা খান প্রশান্ত কিশোর। কংগ্রেসের রাজনৈতিক কৌশল তৈরি করলেও ফ্লপ হল পিকে-শো। প্রতিপক্ষ শিবিরে তিনশোরও বেশি আসন নিয়ে উত্তর প্রদেশে ক্ষমতায় আসে বিজেপি।
তবে প্রশান্ত কিশোর দমবার পাত্র নন। তাঁর পরের গন্তব্য অন্ধ্র প্রদেশ। নিয়োগকর্তা ওয়াইএসআরসিপি সুপ্রিমো জগন্মোহন রেড্ডি। জগনকেও এনে দিলেন বিপুল সাফল্য। সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী তো হলেনই, ২০১৯- এর লোকসভা ভোটেও ২৫ আসনের মধ্যে ২৩টি দখল করে জগনের দল। এর মাঝে অবশ্য ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে নীতীশের দলেই যোগ দেন প্রশান্ত।
যদিও সেই কেরিয়ার খুব বেশি উজ্জ্বল নয়। তারপর সিএএ, এনআরসি নিয়ে নীতীশ কুমারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হল। নিজেকে সরিয়ে নিলেন পিকে। আর তার মধ্যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তৃতীয়বার বাংলার মসনদে বসানোর গুরু দায়িত্ব পেলেন পিকে। চড়াই-উতরাই, তৃণমূলের ভিতরেই তাঁকে নিয়ে এক শ্রেণির নেতার অসন্তোষ পেরিয়ে পিকে করে গেলেন তাঁর কাজ। বললেন, এখানে বন্ধু পাতাতে আসিনি। কাজ করতে এসেছি। পক্ষের এবং বিপক্ষের শক্তি-দুর্বলতা বুঝে সেই অনুযায়ী ঘুঁটি সাজিয়ে গিয়েছেন।
কাজ যে তিনি করেছেন, তা স্পষ্ট হল ২ মে। আর পিকের সেই টুইটও যেন প্রতিফলিত বাংলায় একুশের হাইভোল্টেজ ম্যাচের ফলাফলে। আর পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল ছাড়াও তামিলনাড়ুতে স্টালিনের ডিএমকে-র হয়ে কাজ করছেন পিকে। সেখানেও চলছে স্টালিন ঝড়।
প্রোজেক্ট পঞ্জাব:
পশ্চিমবঙ্গে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী রণকৌশলে বাজিমাত। এর মধ্যেই নয়া প্রজেক্টে হাত দিয়েছেন পিকে। পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং-এর মুখ্য পরামর্শদাতা হিসেবে নিযুক্ত করা হল তাঁকে। পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী নিজেই টুইট করে জানিয়েছেন, একসঙ্গে কাজ করতে মুখিয়ে আছেন তিনি।