Subho Noboborsho: ই-কার্ড ফরওয়ার্ডের মাঝে নববর্ষের হাতে বানানো কার্ড কি আজ শুধুই অতীত?
Subho Noboborsho Wishes: নিজের হাতে কোনও কিছু বানিয়ে কাউকে দেওয়ার মধ্যে যে আনন্দ তা আজকালকার বাচ্চারা অনুভবই করতে পারে না...
সে এক দিন ছিল। যখন স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরেই বাচ্চারা বসে পড়ত খাতা-পেন্সিল-রং নিয়ে। অঙ্কের খাতার ঠিক মধ্যিখান থেকে পাতা ছিঁড়ে চলত শুভ নববর্ষের কার্ড বানানো। কিংবা কখনো জুটে যেত একটুকরো আর্ট পেপার। সব সময় যে হাতে আঁকা হত এমনটা কিন্তু নয়। পুরনো বইয়ের পাতা থেকে ফল-ফুল-পাখির ছবি কিংবা পুরনো সংবাদপত্র থেকে সূর্যোদয়ের ছবি খুঁজে কোনওটা গোল বা কোনওটা চৌকো করে কেটে নিয়ে কার্ডের মধ্যে বসানো হত। নতুন বছর আসার দিন দশেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত সেই প্রস্তুতি। তখন কিন্তু সবার জন্য কার্ড বানানো হত। এখনকার মতো একটা ডিজিটাল কার্ড নয়। স্কুলের বন্ধু আর পাড়ার বন্ধুদের মিলিয়ে তৈরি হত লম্বা তালিকা। এবার যে ভাল বন্ধু তার জন্য বরাদ্দ হত একখানা ভাল ছবির কার্ড, অন্যজনেরটা একটু সাধারণ মানের- এই ভাবেই চলত কার্ড নির্বাচন। আর কার্ডের ভেতরে সুন্দর হস্তাক্ষরে নিজেরাই লিখত নানা ছড়া-
‘আম মিষ্টি, জাম মিষ্টি তেঁতুল ভারি টক তোমার সঙ্গে বন্ধু হতে আমার বড় শখ’। শুভ নববর্ষ…
এবার এই কার্ড নিয়ে স্কুলে বন্ধুদের মধ্যে বিলি করা হত। এখানেও থাকও বেশ মজার কিছু স্মৃতি। যে বন্ধু ভাল কার্ড দিত, তাকে সবচাইতে ভাল ছবির কার্ডটা দেওয়া হত। আর যে বন্ধুর সঙ্গে সেদিন ঝগড়া হত, তার জন্য বাছাই চলত সবচেয়ে খারাপটা। কিন্তু দু’দিন পর যখন ঝগড়া মিটে যেত, তখন ওই বেঁচে থাকা কার্ড থেকে একটা ভাল কার্ডই দেওয়া হত বন্ধুকে। এই কার্ড পর্ব যে স্কুলেই সমাপ্ত হয়ে যেত এমন নয়, খেলার মাঠেও কিন্তু চলত কার্ড বিতরণ। প্রত্যেকের বইয়ের ভাঁজে উঁকি মারত বাহারি কার্ড। দিনের শেষে গোনা হত কে কটা কার্ড পেল। আর তা নিয়ে চলত ঠাণ্ডা লড়াই। এই কার্ড আদান-প্রদানে কিন্তু কেনা কার্ডের কোনও চল ছিল না। বরং আলুর ছাপ, পাতার ছাপ, সুতোকে রঙের মধ্যে চুবিয়ে তাই দিয়ে কার্ড, কাগজ কেটে কার্ড, স্টেনসিল- নিজেদের ভাবনাই ফুটে উঠত সেই কার্ডে। তৈরি হত নানা ছবি।
কিন্তু সময় আর প্রতিযোগিতা কেড়ে নিয়েছে শিশুমনের সেই সব ভাবনাকে। ঠাণ্ডা লড়াই এখন কার্ড টপকে চলে গিয়েছে স্কুলের রিপোর্ট কার্ডে। কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়তে রাজি নয়। হাতে কার্ড আঁকার সময় কোথায়! হোয়্যাটসঅ্যাপের ই-কার্ডই এখন ভরসা। মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই শুভেচ্ছা বার্তা পৌঁচ্ছে যাচ্ছে প্রিয়জনদের কাছে। নববর্ষের থেকে বরং অনেক বেশি মাতামাতি চলে ইংরেজি বছর নিয়ে। বর্ষবরণ থেকে রাতভর পার্টি, খানাপিনা-সবাই মজে আনন্দে। নববর্ষে হালখাতার চল এখনও থাকলেও মিষ্টির প্যাকেটর স্থানপূরণ করেছে ধনতেরাস। তবুও নতুন বছর মানে কিন্তু বাঙালি বাড়িতে মিষ্টি আসবেই। আর এই হাতে বানানো নববর্ষের কার্ডের সঙ্গে কোথাও গিয়ে হারিয়ে গিয়েছে নতুন বছরের চিঠিও।
পেশায় স্কুল শিক্ষিকা মৌসুমি মিত্র যেমন বললেন, “আমাদের নববর্ষের আনন্দ ছিল এই হাতে বানানো কার্ড আর নতুন জামায়। সন্ধ্যায় মা-বাবার হাত ধরে দোকানে হালখাতা করতে যাওয়া। কার্ড বানানোর প্রস্তুতি চলত ১০-১২ দিন ধরে। পুরনো বই-সংবাদপত্র-ম্যাগাজিন থেকে ছবি খুঁজে তা সুন্দর করে কাটিং করা হত। আঙুলের ডগায় রং লাগিয়ে ছাপ দিয়ে তৈরি হত কার্ড। রং কী ভাবে ছবির মাত্রা পেতে পারে- এই কার্ড বানানোর মধ্যে দিয়েই প্রত্যেকের ভেতরে থাকা সুপ্ত প্রতিভা প্রকাশ্যে আসত। সব বন্ধুর জন্যই কার্ড বানানো হত। কোনও বিশেষ একজনের জন্য নয়।”
মানুষের হাতে এখন সময়ের বড়ই অভাব। একটা ডিজিটাল কার্ড বানালেই কাজ চলে যাচ্ছে। অনেক কম সময়ে অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁচ্ছে যাচ্ছে শুভেচ্ছা বার্তা। নিজে উপস্থিত না থেকেও নিজের বার্তাটুকু পৌঁছে যাচ্ছে। কিংবা বিদেশে থাকা যে বন্ধুর সঙ্গে ভিডিয়োকলই ভরসা, সেখানে কার্ড পাছানোর ঝক্কি রাখতে চান না অনেকেই। ই-কার্ড হল সবথেকে সহজ মাধ্যম।
এমনটাই মনে করেন শিল্পী মৃণাল মন্ডল। তাঁর কথায়, “ডিজিটাল কার্ড এখন এতটাই সহজ লভ্য হয়েছে যে সেখানে প্রয়োজন পড়ে না আর অন্য কোনও কিছুর। এখান থেকেই কিন্তু বাড়ছে ই-কার্ডের চাহিদা। মামুষ এখন সময় বাঁচাতে সদা তৎপর।”
হাতে আঁকা কার্ড বানানোয় এখন আর বাচ্চাদের মধ্যে কোনও উৎসাহ নেই। নিজের হাতে কোনও কিছু বানিয়ে কাউকে দেওয়ার মধ্যে যে আনন্দ তা আজকালকার বাচ্চারা অনুভবই করতে পারে না- আক্ষেপের সুর শিক্ষিকা এবং শিল্পী মৃন্ময়ী দেবের কথায়। তিনি আরও বলেন, “আঁকার ক্লাসে কোথাও এসে জুড়ে বসেছে সিলেবাসের গুঁতো। স্কুল যা চাইছে সেরকম ভাবেই শিখতে হবে। নিজের আনন্দে নয়, বরং স্কুলের প্রয়োজনেই আঁকার ক্লাসে আসা। আঁকার বিষয়বস্তুও একরকম চাপিয়ে দেওয়া। যেখানে বাচ্চাদের ভাবনার অবকাশের কোনও সুযোগ নেই। তা স্কুল হোক কিংবা কোনও প্রতিযোগিতা। সাদা খাতার চারপাশে কালো রঙের বর্ডার টেনে বলা হয় এর মধ্যে যা কিছু আঁকতে- এই বিষয়টি অত্যন্ত খারাপ।”
নববর্ষে বাংলা কার্ড আমাদের সংস্কৃতিরই অঙ্গ। কিন্তু কোথাও গিয়ে আমরা তা বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। ‘এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে আমাদেরই’- একথা জোর দিয়েই বললেন মৃন্ময়ী, মৌসুমী।
এখনও নিজের হাতে কার্ড বানিয়ে বন্ধু-প্রিয়জনদের উপহার দিতে ভালবাসেন রিসার্চ স্কলার অমৃতা চক্রবর্তী। জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী বা নববর্ষ- সুযোগ পেলেই বসে পড়েন রং-তুলি নিয়ে। লকডাউনের সময়ে যেমন প্রচুর ছবি এঁকেছেন তেমনই কিন্তু কার্ডও বানিয়েছেন। নববর্ষের এই হাতে বানানো কার্ড প্রসঙ্গে অমৃতা যেমন বললেন, “স্কুলের ড্রইং খাতার পাতা ছিঁড়েই কার্ড বানাতাম। ঘটের উপর সবুজ ডাব আর লাল স্কেচপেন দিয়ে লেখা হত শুভ নববর্ষ। এমনকী স্কুলের শেষ দুটো পিরিয়ডে চলত এই কার্ড বানানোর প্রস্তুতি। কার্ড বানাতে শেখানোও হত স্কুলে। কার্ড বানানো সময়সাপেক্ষ কাজ। অনেকের কাছেই ‘Time is money’- তাই রেডিমেড কার্ডের বিক্রিও এখন অনেক কমে গিয়েছে। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও এখন উপহারে হাতে বানানো কার্ডের চেয়ে ‘Gift Card’পছন্দ করে। আমি শেষ হাতে বানানো কার্ড পেয়েছি শিক্ষক দিবসে আর জন্মদিনে।”