বাংলায় যাঁরা আছেন, একজন মানুষ খুঁজে এনে দেখাতে পারেন, যিনি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান শোনেননি, কিংবা তাঁকে চেনেন না। এরকম একজন মানুষকেও পাওয়া যাবে না। উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেনের নাম জানলে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের নাম জানতে হয়। ভোলা যায় না কিছুতেই। ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’, ‘ওগো সিঁদুর রাঙা মেঘ’… এই গানগুলো কেউ ভুলবে! প্রতিদিন অনুরোধের আসরে যাঁর গান আমাদের পাগল করত, তিনি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ই তো।
আমার গুরুবোন ছিলেন। আমরা একসঙ্গে গান শিখতাম। ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খানের পুত্র ওস্তাদ মুনাওয়ার আলি খানের কাছে আমরা দু’জনেই গান শিখতাম। সন্ধ্যাবেলায় গান শিখতে আসতেন সন্ধ্যাদি। কখনও তানপুরা বাজাতেন, কখনও আমি হারমোনিয়াম বাজাতাম। রাতেরবেলায় বিরিয়ানি খেয়ে বাড়ি ফেরা হত। সন্ধ্যাদি বিরিয়ানি খেতে খুব ভালবাসতেন। ওস্তাদজিকে বলতেন ভাইয়া। ওস্তাদজিও তো ওঁর গুরুভাই। কেননা বড়ে গুলাম আলি খানের কাছে সন্ধ্যাদিও গান শিখেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরই ওস্তাদ মুনাওয়ার আলির কাছে গান শিখতে শুরু করেছিলেন।
সন্ধ্যাদি খেয়াল গান গাওয়া শিখেছিলেন। পুরোদমে খেয়াল গাইতেন। ঠুমরি গাইতেন। লতাজি যেমন ফিল্মে গান করেছেন, সব ধরনের গান গেয়েছেন, সন্ধ্যাদি খেয়াল গানের অনুষ্ঠান করতেন। বহু ঠুমরি গানের অনুষ্ঠানও করেছেন। লখনউ, হায়দরাবাদ, দিল্লি, কানপুর.. নানা জায়গায়। রাগ সঙ্গীতের পাশাপাশি তিনি ছায়াছবির গানও গাইতেন। সেই জন্যই গত দু’বছর আগে যখন কোভিড শুরু হয়নি, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধে সমস্ত অনুষ্ঠানে আসতেন। সঙ্গীতের সম্মান দেওয়া হত যেখানে, সেখানে আমারও নিমন্ত্রণ থাকত, সন্ধ্যাদি সেখানে গাইতেন। দু’লাইন চার-লাইনও যখন গাইতেন, সবটা সুরে গাইতেন। সুরের বিচ্যুতি ঘটেনি কোনওদিন। বাংলার কোকিল, বাংলার সঙ্গীতের সরস্বতী ছিলেন। ওঁর শরীর চলে গিয়েছে। কারণ যমরাজ নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু যমরাজ ওঁর গানকে কোনওদিনও নিয়ে যেতে পারবেন না।
এখনও আমাদের বাড়িতে রবিবার কিংবা ছুটির দিনে ছায়াছবি হিসেবে উত্তম-সুচিত্রাকে দেখতে ইচ্ছে করে। তখন সন্ধ্যাদিকেই শোনা যায়। ওঁর আত্মাকে প্রণাম জানাই, ভালবাসা জানাই.. একসঙ্গে ছায়াছবিতে গানও করেছি। সন্ধ্যাদির আত্মা সবসময়ই গানের মধ্যে থাকবে। সরল মানুষ ছিলেন। শিশুদের মতো জিজ্ঞেস করতেন, ‘গান সুরে লাগবে তো, ঠিক গাইলাম তো!’ সাচ্চা মানুষ। সঙ্গীত নিবেদিত প্রাণকে হারালাম।
আরও পড়ুন: Sandhya Mukhopadhyay Obituary: তীর বেঁধা পাখি আর গাইবে না গান