AQI
Sign In

By signing in or creating an account, you agree with Associated Broadcasting Company's Terms & Conditions and Privacy Policy.

Ad Controversy: ‘সেন্ট অফ আ ওম্যান’… বিজ্ঞাপন, বিতর্ক, ভাবনা

AD Controversy: বিজ্ঞাপনী-বিতর্কে তোলপাড় সোশ্যাল মিডিয়া। টেলিভিশনে বিতর্ক থেকে পাড়ার মোড়ে আড্ডা, সর্বত্র আলোচনা। এ কেমন বিজ্ঞাপন? কিন্তু এ বিজ্ঞাপন কি একেবারে নতুন কিছু?

Ad Controversy: ‘সেন্ট অফ আ ওম্যান’... বিজ্ঞাপন, বিতর্ক, ভাবনা
| Edited By: | Updated on: Jun 08, 2022 | 3:53 PM
Share

পায়েল মজুমদার

বিজ্ঞাপনী-বিতর্কে তোলপাড় সোশ্যাল মিডিয়া। টেলিভিশনে বিতর্ক থেকে পাড়ার মোড়ে আড্ডা, সর্বত্র আলোচনা। এ কেমন বিজ্ঞাপন? কিন্তু এ বিজ্ঞাপন কি একেবারে নতুন কিছু? নারীদেহের অবজেকটিফিকেশন বিজ্ঞাপন-দুনিয়ায় নতুন নয়। কীসের জন্য চলেছে সে সব?

ছিঃ! জঘন্য! এমনও ভাবা যায়? বিজ্ঞাপনের দেশ-দুনিয়ায় সৃজনশীলতার অভাব নাকি? গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় উপচে পড়ছে মতামত, সমালোচনা, কটুকাটব্য,। বিতর্কের কেন্দ্রে একটি সুগন্ধি বা ‘পারফিউম’-র বিজ্ঞাপন। আমজনতা থেকে তারকা, সকলেরই বক্তব্য এক। প্রচারের নামে গণধর্ষণের মতো বিষয় নিয়ে রসিকতা (পড়ুন উসকানি) মোটেও মানা যায় না।

খাঁটি কথা। জনরোষও সঙ্গত। কিন্তু খটকা থাকছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় উত্তেজনা, প্রতিবাদ থেমে গেলে প্রসঙ্গটা হারিয়ে যাবে না তো? কারণ এই মুহূর্তে এই নিয়ে আলোচনা ভীষণ জরুরি। একটা-দু’টো বিজ্ঞাপন নিয়ে হইচই নয়… পিছনের গল্পটাও ঝালিয়ে নেওয়া দরকার।

ad controversy

গল্পের কথা যখন উঠল তখন একটা গল্প বলা যাক। এক মহিলা তাঁর পরিবারের সঙ্গে কোনও একটি রেস্তোরাঁয় নৈশভোজে গিয়েছেন। সেই রেস্তোরাঁরই অন্য একটি টেবিলে নিজেদের মতো আড্ডা দিচ্ছে একদল যুবক। হঠাতই নিজের টেবিল ছেড়ে উঠে গেলেন ওই মহিলা। সটান পৌঁছে গেলেন অচেনা যুবকদের টেবিলে। তার পর… একটি ওয়াইনের গ্লাস তুলে নিয়ে আবার নিজের জায়গায় ফেরত। মাঝখানে শুধু টেবিলের এক যুবকের সঙ্গে চোখাচোখি… রহস্যময় হাসি। এর পর বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন। অবশ্যই সুগন্ধির বিজ্ঞাপন। ও হ্যাঁ, মহিলাটি কিন্তু সুবেশা ও আকর্ষণীয়া।

কোন ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন? নাহ্, সঠিক অনুমানে কোনও পুরস্কার নেই। কিন্তু একটা বিষয় লক্ষ্য করলেন? বিজ্ঞাপনের মাঝে কোথাও সুগন্ধির নাম বা তার কোনও বৈশিষ্ট্য কিছুই বলা-কওয়া নেই? কেন? বিপণন-দুনিয়ার চ্যালেঞ্জ এখানেই। আসলে পারফিউম এমন একটা পণ্য, যেটির বৈশিষ্ট্য লিখে বা মুখে বলে বোঝানো কঠিন। আমি-আপনি প্রতিদিন যে ধরনের শব্দ ব্যবহার করি, তা দিয়ে পারফিউমের গুণাগুণ বোঝানো ভীষণ চ্যালেঞ্জিং। আর বোঝাতেই যদি না পারা যায়, তা হলে পণ্যের প্রচার হবে কী ভাবে?

ad controversy

উপায় আছে। যে জিনিস মৌখিক বা লেখ্য ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন, তাকে বোঝানোর জন্য নন-ভার্বাল বা অ-বাচিক রাস্তা বের করলেন বিজ্ঞাপনী দুনিয়ার জাদুকররা। সুগন্ধির মেজাজ তুলে ধরতে মডেলদের নানা ভঙ্গিমায় শুট করল প্রচার দুনিয়া। ‘প্লেজ়েন্ট’, ‘সেনসুয়াল’, ‘ন্যাচারাল’, নানা ভাবে বিজ্ঞাপন তৈরি হল।

কিন্তু এক্ষেত্রে পুরুষ মডেলদের নিরিখে মহিলাদের রমরমা বেশি। অন্তত ইতিহাস তা-ই বলছে। মেয়েদের সুগন্ধির পাশাপাশি ছেলেদের পারফিউমের বিপণনেও মেয়েদের ‘সেনসুয়াল’উপস্থিতি যেন বাধ্যতামূলক। কিন্তু কেন? এর পিছনেও গভীর মনস্তত্ত্ব।

মনোবিদদের একাংশের মতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছেলেদের পারফিউমের বিপণনের টার্গেট গ্রুপ বিষমকামী বা হেটেরোসেক্সুয়াল পুরুষ। বিজ্ঞাপনের বার্তা মূলত একটাই, সুগন্ধি মাখলে লাস্যময়ী মহিলারা আকৃষ্ট হবেন। যৌনতার সঙ্গে সুগন্ধির গুণাগুণ জুড়ে দেওয়া বিজ্ঞাপণের মূল লক্ষ্য। মেয়েদের সুগন্ধির ক্ষেত্রে প্রচারের কৌশল খানিকটা আলাদা। এক্ষেত্রে পারফিউম ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্য পুরুষের চোখে আরও আবেদনময়ী হয়ে ওঠা। দু’টি ক্ষেত্রেই বিষমকামী নারী-পুরুষের স্টিরিওটাইপ মেনে প্রচারকৌশল তৈরি করা হয়। তাই প্রিন্ট অ্যাড হোক বা অডিও-ভিজ্যুয়াল, সর্বত্রই মহিলা মডেলের রমরমা।

ad controversy

‘‘এই ধারা বহু বছরের। শুধু সুগন্ধি নয়। চকোলেট থেকে প্রসাধনী, বহু পণ্যের বিজ্ঞাপনে মহিলাদের যেন একটি নির্দিষ্ট ভাবে তুলে ধরাই দস্তুর’’—বললেন মনোবিদ সুদর্শনা দাশগুপ্ত। কিন্তু তাতে যৌনতার এমন অবাধ বিচরণ কেন? সুদর্শনার মতে, ‘‘যৌনতার মতো এত সহজে অন্য কিছু আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে না। বুদ্ধিদীপ্ত বিজ্ঞাপনের থেকে ডাবল-মিনিং বা দ্ব্যর্থবোধক বিজ্ঞাপন তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি উৎসাহ তৈরি করে। তা ছাড়া এখানে একটা এসকেপ-রুটও থেকে যায়। বিজ্ঞাপননির্মাতা সহজেই বলতে পারেন, দর্শক অন্য রকম ভাবে দেখেছেন। বিজ্ঞাপনের বার্তা অন্য কিছু। ফাঁকতালে প্রচারের কাজ হাসিল হয়ে যায়।’’

তবে যে বিজ্ঞাপন ঘিরে বিতর্ক, তাতে শুধু অবজেক্টিফিকেশন হয়নি। কোথাও মহিলাদের ভিকটিমাইজেশন নিয়েও রসিকতা হয়েছে বলে অভিযোগ। এর সঙ্গে প্রচারের কী যোগ থাকতে পারে? সূত্রটা ধরিয়ে দিলেন মনোবিদ পৌরবী চৌধুরী। বললেন, ‘‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মহিলারা মূলত চাহিদাপূরণে বস্তু। আর পৌরুষ মানেই যেন যৌন আগ্রাসন যা মহিলাদের কাছে শুধু কাঙ্খিত নয়, কামোদ্দীপক বা ‘ইরোটিক’-ও বটে। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রচলিত ধ্যানধারণাকেই তেল-জল দিয়ে পুষ্ট করা হয়। তাতে প্রচারের ফয়দা হতে পারে, কিন্তু আড়ালে নারী-বিরোধী মনোভাব প্রশ্রয় পেয়ে যায়।’’

ad controversy

সেটা কী ভাবে? পৌরবীর ব্যাখ্যা, ‘‘বিতর্কিত বিজ্ঞাপনটির কথাই ধরা যাক। পুরো ভাবনাটার মধ্যে ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক বিষয় নিয়ে রসিকতা রয়েছে। ঠারেঠোরে  বোঝানোর চেষ্টা, এটা আসলে যন্ত্রণা নয়। এ যন্ত্রণা আসলে মজা। গবেষণা বলছে, এটাও নারী-নির্যাতনের মতো বিষয়কে সমাজের চোখে গ্রহণযোগ্য করে তোলার কায়দা। জোরাল প্রচার নয়, বরং রয়েসয়ে সইয়ে নেওয়ার কৌশল।’’

বিরোধিতার গোড়ার কথা এখানেই। বিপণনের জন্য মডেলের প্রয়োজনীয়তা নতুন নয়। কিন্তু প্রচারের জন্য নারীবিরোধী মনোভাবকে প্রশ্রয় দেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত? স্টিরিওটাইপ-ভিত্তিক জেন্ডার-রোল বা লিঙ্গ-ভূমিকা ও তার ভিত্তিতে তৈরি বিজ্ঞাপন কতটা নৈতিক? বিষমকামী পুরুষ বা মহিলা, সুগন্ধির টার্গেট গ্রুপ যে-ই হোক, বিজ্ঞাপনে সেনস্যুয়ালিটি কোশেন্ট বাড়াতে নারীদেহ প্রয়োজন কেন? কেন-ই বা সমকামী, রূপান্তরকামী বা উভকামীদের কথা ভেবে প্রচারের কৌশল ঠিক হয় না? তবে কি তথাকথিত আধুনিকতার আড়ালে এখনও স্টিরিওটাইপ ভাঙতে পারেনি কোটি-কোটি ডলারের বিজ্ঞাপন জগত? তবে একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে এখন বিজ্ঞাপন-দুনিয়ায় ন্যুড ফিমেল মডেলের পাশাপাশি ন্যুড মেল মডেলের শুট অনেকটাই বেড়েছে। কিন্তু আনুপাতিক বিচারে এখনও সেটা অনেক কম। যদিও মূল প্রশ্ন অন্যত্র। যে কোনও পণ্যের বিজ্ঞাপন করতে হলে দেহকে পণ্য করে তোলা কি খুব জরুরি? যেহেতু ইতিহাসগত ভাবে বিজ্ঞাপনে নারীদেহের ব্যবহারই বেশি, তাই প্রশ্নটা এক্ষেত্রে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। উত্তরটা পেলে হয়তো বিজ্ঞাপনে গণধর্ষণের মতো বিষয় নিয়ে রসিকতা করতে নিজেরাই লজ্জা পাব আমরা।