সম্ভব হলে প্রিয়জনের শেষকৃত্যের নিয়ম পুরুষ, মহিলা নির্বিশেষে প্রত্যেকের পালন করা উচিত: সুজিত সরখেল
Mandira Bedi: রাজের মৃত্যুর পর শেষযাত্রায় সঙ্গী ছিলেন মন্দিরা। আক্ষরিক অর্থেই জীবনসঙ্গীর দেহ বহন করে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে শ্মশানের যাবতীয় নিয়ম পালন করেছেন মন্দিরাই। এর মনস্তাত্ত্বিক ব্যখ্যা কী হতে পারে?
মাত্র ৪৯ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হলেন বলিউডের পরিচালক তথা প্রযোজক রাজ কুশল। ব্যক্তিগত সম্পর্কে যিনি ছিলেন অভিনেত্রী তথা সঞ্চালিকা মন্দিরা বেদীর স্বামী। রাজের মৃত্যুর পর শেষযাত্রায় সঙ্গী ছিলেন মন্দিরা। আক্ষরিক অর্থেই জীবনসঙ্গীর দেহ বহন করে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে শ্মশানের যাবতীয় নিয়ম পালন করেছেন মন্দিরাই। আমাদের সামাজিক কাঠামোয় প্রিয়জনের মৃত্যুর পর শ্মশানযাত্রা এবং নিয়মপালন সাধারণত পুরুষদের করতেই দেখা যায়। রাজ-মন্দিরার ছেলে নাবালক। সে এই কাজ করেনি। ফলে মন্দিরার এই কাজ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। সাধারণ ঘটনার থেকে আলাদা বলেই কি এই আলোচনা? নাকি একজন সেলেবের এই আচরণ দৃশ্যত বহু প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে সমাজকে? এর মনস্তাত্ত্বিক ব্যখ্যা কী হতে পারে? লিখছেন এসএসকেএম হাসপাতালের সাইক্রিয়াটি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর-চিকিৎসক সুজিত সরখেল।
রাজ কুশলের মৃত্যুর পর স্বামীর শেষযাত্রার যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম স্ত্রী হিসেবে মন্দিরার পালন করার ঘটনা আলাদা নয়, অন্যরকম। এর দু’টো দিক আছে। প্রথম হচ্ছে, মন্দিরা সেলিব্রিটি। তাঁর জীবনের ছোট ঘটনাও মিডিয়ার কল্যাণে বা অন্যান্য হাইপের জন্য সাধারণ মানুষ আলোচনা করবেন। এটা স্বাভাবিক ট্রেন্ড, যেটা গোটা বিশ্বে হয়। এতে নতুনত্বের কিছু নেই।
দ্বিতীয়ত, যেটা নতুন, তা হল মন্দিরা স্বামীর মৃত্যুর পর যে কাজটা করছেন। যে নিয়ম মহিলা হিসেবে পালন করেছেন, সেটা অন্যরকম। এখনও দেখবেন, কোনও মহিলা গাড়ি চালাচ্ছেন দেখলে, সাধারণত একবার ঘুরে তাঁকে দেখা হয়। মহিলা গাড়ি চালাচ্ছেন, বিষয়টা অ্যাপ্রিশিয়েবল। কিন্তু এখনও যেন বিষয়টা অন্যরকম। ঠিক তেমনই অন্য অনেক কিছুর মতোই রিচুয়ালের জায়গাটা এখনও অনেকটাই পুরুষ নিয়ন্ত্রিত। অনেক নিয়ম মেয়েদের করার কথা নয়, এ সব নিয়ম অনেক আগে থেকে চলে আসছে। সেখানে মহিলা হিসেবে এগিয়ে এসে এই কাজ করার মধ্যে সাহসিকতা রয়েছে। বহু মহিলার কাছে অনুপ্রেরণা হতে পারেন মন্দিরা। নিজের প্রিয়জনের শেষকৃত্য করতে পারব না শুধু নিয়মের জন্য, মহিলাদের ক্ষেত্রে এই ধারণাকে ভেঙেছেন তিনি। হয়তো ভেবেছেন, এই কাজটা থেকে আমি কেন বাদ পড়ব? কী ভেবে এই কাজ করেছেন, তা হয়তো মন্দিরা পরে কখনও বলবেন। অথবা আলাদা কিছু ভেবে এ কাজ করেননি। কিন্তু যেটা করেছেন, সেটা অত্যন্ত পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখছি।
আমি মনে করি, প্রিয়জনের মৃত্যুর পর এই আনুষঙ্গিক নিয়ম প্রত্যেকের পালন করা উচিত। এই প্রসেসটার মধ্যে দিয়ে যাওয়া উচিত। এখানে কোনও ধর্মের কথা আলাদা করে উল্লেখ করব না। যিনি যে ধর্মে বিশ্বাসী, তিনি সেই ধর্মের নিয়ম পালন করুন। কারণ মনস্তত্ত্বের ব্যাখ্যায় আমি দেখেছি, কেউ মারা যাওয়ার পরে তাঁর প্রিয়জন যে মানসিক আঘাত পান, এই নিয়মগুলো সেই ধাক্কাটাকে কাটিয়ে উঠতে খুব সাহায্য করে। প্রিয় মানুষের মৃত্যুর পর এই নিয়ম মানার মাধ্যমে গ্রিফ প্রসেসটা সম্পূর্ণ হয়। কাছের মানুষ মারা গেলে, তাকে কেউ ভুলে যান না। কিন্তু কিছুটা হলেও ধাক্কা সামলানো যায় এই নিয়ম পালনের মাধ্যমেই।
মন্দিরার ক্ষেত্রেও আমি বলব, যা করেছেন, সেই কাজ তাঁকে নিজস্ব দুঃখ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। সেজন্যই কাছের লোকেদের শেষকৃত্যে ইনভলভড হওয়া দরকার। অনেকেই হয়তো ভাবেন, এই নিয়ম মানসিকভাবে আরও যন্ত্রণা দিতে পারে। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতিতে আমি দেখেছি, বহু মানুষ প্রিয়জনের শেষকৃত্য করতে পারছেন না। কোনও নিয়ম পালন তো দূরের কথা, হয়তো শেষবারের জন্য দেখতেও পারছেন না। যেটা মনে বড় রকমের দাগ কেটে যাচ্ছে। শোক কিছুটা স্তিমিত হয়ে এলে কিছুতেই নিজেদের ক্ষমা করতে পারছেন না তাঁরা। কোভিডের আতঙ্ক কেটে যাওয়ার পর নিজেকে দোষী মনে করছেন। ভাবছেন, প্রিয়জনের জন্য এটুকুও করতে পারলাম না? সেটা তাঁদের আরও যন্ত্রণা দিচ্ছে। তার থেকে সুযোগ থাকলে, সম্ভব হলে প্রিয়জনের শেষকৃত্যের নিয়ম পুরুষ, মহিলা নির্বিশেষে প্রত্যেকের পালন করা উচিত।
মন্দিরা একটি বোল্ড স্টেপ নিয়েছেন। হয়তো না জেনে, বুঝে এ কাজ করেছেন। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। যা প্রয়োজন এবং উপকারি। ভাবনাটা হল, আমার প্রিয়জন, আমি কেন তাঁর শেষকৃত্যে থাকব না? এখানে আরও একটা বিষয় রয়েছে। মন্দিরা যেটা পেরেছেন, সেটা সকলে পারবেন না। ধরুন, কোনও মধ্যবিত্ত পরিবারে এই ঘটনা ঘটেছে। একান্নবর্তী পরিবার। তখন হয়তো পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাই স্বামীর শেষকৃত্যে স্ত্রীকে অংশ নিতে দিতেন না। মেয়েদের করতে নেই বা করতে হবে না, বলে সেই মহিলার ইচ্ছেকে থামিয়ে দেওয়া হত। মন্দিরাকে তাঁর জায়গা থেকে কেউ বাধা দেননি। অথবা বাধা এলেও সেটা উপেক্ষা করে উনি করতে পেরেছেন। অথবা এই নিয়ম পালন করার মতো আর কেউ ছিলেন না, সে জন্য তিনি করেছেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এই নিয়ম পালনের একটা হিলিং এফেক্ট আছে। দুঃখ, যন্ত্রণা, হারানোর মধ্যে যা মনকে চাঙ্গা করে।
এই প্রসেস থেকে মহিলাদের বাদ দেওয়া ঠিক নয়। প্রত্যেকের ইনভলভড থাকা উচিত। ওভারঅল এই ঘটনাটা আমি পজিটিভ মনে করছি। অবশ্যই, এটা রেগুলার ঘটনা নয়। ভিন্ন ধরনের ঘটনা। কিন্তু মন্দিরার এই ইনভলভমেন্ট, এই ধরনের বোল্ড স্টেপকে যদি আমরা অনুপ্রাণিত করি, তাহলে অনেক মহিলাই এই ধরনের ঘটনায় উদ্বুদ্ধ হবেন। তাঁরাও হয়তো পরবর্তী কালে এই ধরনের কাজ করতে পিছ না হবেন না। তখন আর রেয়ার থাকবে না।
অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস
আরও পড়ুন, মেয়েরা মুখে আগুন দিলে সেটাই সংবাদ হয়: শাশ্বতী ঘোষ