কোন অপমানে অভিনয় ছেড়েছিলেন কমল মিত্র, জানলে অবাক হবেন?
জানা যায়, যখন সেই অভিনেতা নিজেই কলম ধরেন নিজের জীবনের গল্প বলার জন্য। সেই কলমের কালিতে বয়ে যায়, তা উজ্জ্বল দিনের আলো থেকে অন্ধকার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। বাংলা চলচ্চিত্রের এমনই এক কিংবদন্তি অভিনেতা কমল মিত্র।

গ্ল্যামার জগতের আলোর ঝলকানির নেপথ্যের অন্ধকারের গল্প আমরা কজনই বা জানি। পর্দায় নায়ক-নায়িকারা যে চরিত্রে এসে দাঁড়ান, তাতেই বিশ্বাস করে নেন অনুরাগীরা। কিন্তু তারকাদেরও যে জীবনের অধ্য়ায়ে লুকিয়ে থাকে নানান বেদনার গল্প, তার খোঁজ কজন রাখে! কেন এক প্রতিভাবান অভিনেতা আচমকা অভিনয় ছেড়ে হতাশায় ডুবে যান? কেন দুর্দশায় কাটে তাঁর শেষ জীবন? সে খবর সত্য়িই জানা যায়? হ্য়াঁ, জানা যায়, যখন সেই অভিনেতা নিজেই কলম ধরেন নিজের জীবনের গল্প বলার জন্য। সেই কলমের কালিতে বয়ে যায়, তা উজ্জ্বল দিনের আলো থেকে অন্ধকার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। বাংলা চলচ্চিত্রের এমনই এক কিংবদন্তি অভিনেতা কমল মিত্র। যিনি কিনা উত্তম কুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, পাহাড়ি সান্ন্যালের সঙ্গে দাপিয়ে অভিনয় করতেন সিনেপর্দায়। তবে শুধুই সিনেমা নয়, মঞ্চেও চলত তাঁর অভিনয়ের দাপট। ছবি হিটের সংখ্য়াও প্রচুর। সম্মান, পুরস্কারও ছিল ঝুলি ভরা। সেই জাত অভিনেতাই হঠাৎ একদিন অনুভব করেন, তাঁর দিন শেষ। স্টুডিও পাড়ায় এমন এক ঘটনার সম্মুখীন হন কমল মিত্র, যে রাতারাতি সিদ্ধান্ত নেন, অভিনয় জীবনকে বিদায় দেওয়ার।
‘নীলাঙ্গুরীয়’ ছবিতে একটি ছোট চরিত্রে কাজ করার প্রথম সুযোগ পান কমল মিত্র । চরিত্রটি ছিল নায়কের বন্ধুর। ছিল একটি মাত্র সংলাপ। জানা যায়, এর জন্য কোনও পারিশ্রমিকও পাননি তিনি। পেয়েছিলেন শুধুই একটা সুযোগ। কমল মিত্র প্রথম পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন দেবকী বসুর হিন্দি ‘রামানুজ’ ছবিতে একজন সৈনিকের ভুমিকায় অভিনয় করে। এই ছবিতে তাঁকে হিন্দিতে সংলাপ বলতে হয়েছিল। ‘মুঝে মাফ কিজিয়ে মহারাজ। ম্যায় নেহি জানতা।’ সংলাপ বলতে-বলতে তাঁকে মহারাজের হাতে চাবুক খেতে হয়েছিল। এই দৃশ্যে অভিনয় করে জীবনে প্রথম টালিগঞ্জ স্টুডিওর লাঞ্চ খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল কমল মিত্রর। বলা যায়, এখান থেকেই তাঁর অভিনয় জীবনের শুরু।
কমল মিত্র অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে ‘কংস’, ‘বিদ্যাসাগর’, ‘দেয়ানেয়া’, ‘আনন্দমঠ’, ‘জিঘাংসা’, ‘সব্যসাচী’, ‘লৌহকপাট’, ‘আশিতে আসিও না’, ‘সবার উপরে’, ‘বন্ধু’, ভানু পেল লটারী’, ‘শেষ অঙ্ক’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘তিন ভুবনের পারে’, ‘হারমোনিয়াম’, ‘পিতাপুত্র’, ‘থানা থেকে আসছি’, ‘বর্ণালী’র মতো কালজয়ী ছবি। কিন্তু সেই প্রবাদ প্রতীম অভিনেতাই পরে কাজ হারিয়ে ক্রমশ একা হয়ে পড়েছিলেন। বলতেন, “প্রায় সব সহশিল্পী চলে গেল। এমনকী যারা বয়সে আমার ছোট তারাও রইল না। ছবি, পাহাড়ি, জহর (গাঙ্গুলি), অসিতবরণ, বিকাশের সঙ্গে অনেক বছর ধরে কাজ করেছি। সেটে আর তাঁরা নেই, এই কথা যখন ভাবি তখন নিজেকে বড় একা লাগে। এমনকী উত্তম, ভানু, জহরও চলে গেল।
কিন্তু সতীর্থদের চলে যাওয়াটাও মেনে নিয়েছিলেন কমল মিত্র। কিন্তু স্টুডিও পাড়ার একটি ঘটনাই তাঁকে চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। যে অভিনয়ের জন্য এতদিন প্রাণপাত করেছেন কমল মিত্র। তাঁকেই দিলেন বিদায়।
কমল মিত্রর সঙ্গে কী ঘটেছিল?
এক ব্যক্তিগত কাজে স্টুডিওপাড়ায় গিয়েছিলেন কমল মিত্র। ফ্লোরের বাইরে যখন দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন হঠাৎ দেখেন পরিচালক অজয় কর স্টুডিও পাড়ায় ঢুকছেন। তাঁকে দেখেই ফিল্ম ইউনিটের এক ব্যক্তি বলে উঠল, লোকটা কে? স্টুডিও পাড়ায় ঢুকছে কেন? যুবকের কথাটি শুনে যেন বজ্রপাত হল কমল মিত্রর হৃদয়ে। অজয় করের মতো পরিচালককে মানুষ চিনতে পারছে না! সঙ্গে সঙ্গেই কমল মিত্র ভেবে নিলাম, এবার তাঁরও যাওয়ার সময় হয়েছে। স্টুডিও পাড়ায় কেউ তাঁকে চিনতে পারছে না, এটা শোনা ও বোঝার আগেই অভিনয় ছেড়ে দেওয়াটই ঠিক বলে মনে হল তাঁর। আর যেমন ভাবা তেমনই কাজ। সেদিনটিই ছিল স্টুডিও পাড়ায় তাঁর শেষ পা রাখা।
কাউকে টের পেতে দেননি। চুপচাপ সরে দাঁড়িয়েছিলেন অভিনয় জগৎ থেকে। বাংলা চলচ্চিত্রের ‘প্রচণ্ড রাগী পিতা’ কমল মিত্র, বড় অভিমানে ক্যামেরার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ছেলেমেয়েদের বলে ছিলেন তিনি অসুস্থ হলে যেন তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো না হয়। ১৯৯৩ সালের ২ আগস্ট মাসে মৃত্যু হয় তাঁর। বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। জানা যায়, তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়ার সমস্ত খরচা তিনি আগে থেকেই পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
তথ্য সূত্র- ফ্ল্যাশব্যাক, কমল মিত্র
