Debjani Chatterjee Exclusive: ‘সিরিয়ালে ওই একই গল্প বছরের পর বছর’, বিরতি নিতে চেয়ে কেন একথা বললেন অভিনেত্রী?
Tollywood: এই বয়সের মহিলা মানেই যে শ্বাশুড়ি নয়, এটা টলিউডও আসতে-আসতে বুঝতে পারছে। ইতিমধ্যেই মাঝবয়সী মহিলাদের নিয়ে কয়েকটি ছবিও হয়েছে। 'গুলদস্তা' তারই মধ্যে একটি।
শেষ হয়েছে ‘যমুনা ঢাকি’, একপর…? না, এখনই কোনও ধারাবাহিকে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে নারাজ অভিনেত্রী দেবযানী চট্টোপাধ্যায়। দীর্ঘ ১৮ থেকে ১৯ বছর সাফল্যের সঙ্গে টিভি দুনিয়ায় দাপটের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি, তবে আজও মন জুড়ে উঁকি মারে একাধিক আক্ষেপ। শিল্পী হিসেবে নিজেকে কতটা ভেঙে গড়লেন তিনি? তাই খানিক বিরতি নিয়ে পেতে চান অভিনয়ের অন্য স্বাদ… TV9 বাংলার সঙ্গে কথা বললেন দেবযানী চট্টোপাধ্যায়।
টিভি থেকে বিরতি
মেগা থেকে, ধারাবাহিক থেকে কয়েকদিন একটু বিরতি নিতে চাইছি। কারণ একই জিনিস করে চলেছি তো দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে, শিল্পী হিসেবে এবার একটা একঘেয়েমি কাজ করছে। তাই কয়েক মাসের বিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দেখা যাক, তারপর আবার শুরু করা যাবে…।
নজরে ওটিটি-সিনেমায় কাজ
সিরিয়াল থেকে আমি ওটিটি-তে কাজ করা বা ছবিতে কাজ করাকে বর্তমানে বেশি প্রাধান্য দেব। তেমনই পরিকল্পনা করেছি। দেখা যাক কী হয়! সত্যি বলতে আমি চাইলেই তো আর আমার কাছে কাজ চলে আসবে না। তবে চেষ্টা করতে ক্ষতি কী!
দর্শকের পরিবারের একজন দেবযানী
সেই ইমেজটা থেকেই তো আমি এবার একটু বেরোতে চাই। সত্যি কথা বলতে তেমনভাবে ছবি আমি করিনি, বা বিশেষ তেমন কোনও প্রস্তাবও আসেনি। আবার আসে না বলাটাও পুরোপুরি ভুল, কারণ আমি টিভি নিয়েই ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম। সেই কারণেই আমার একটা কমফোর্ট জ়োন তৈরি হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ ১৮-১৯ বছর সত্যি বলতে আমায় তেমন কোনও স্ট্রাগল করতে হয়নি। কোনওদিন কাজের জন্য বসেই থাকতে হয়নি। এটা ভগবানের আশীর্বাদ, আমার বাবা-মায়ের আশীর্বাদ, দর্শকের ভালবাসা যা-ই বল না কেন… অপেক্ষা আমায় সত্যিই কখনও করতে হয়নি। কী হয় জানো তো! একটা সময়ের পর একটা স্বস্তি চলে আসে, এই তো এত কাজ আছে, টাকা রোজগার করছি। কিন্তু শিল্পী হিসেবে নিজেকে যখন প্রশ্ন করি: আমি কী করেছি, খুব পজিটিভ উত্তর আমি খুঁজে পাই না।
সত্যিই কি আমি তেমন কোনও কাজ করেছি…
নিজেকে একটা সময় পর বারে বারে প্রশ্ন করি, সত্যিই কি আমি তেমন কোনও কাজ করেছি মনে রাখার মত! জনপ্রিয় হয়তো হয়েছি, কিন্তু স্বস্তি, আত্মতুষ্টি পাওয়ার মতো কাজ? সব থেকে বড় কথা আমার মনে হয়েছিল একটা সময়, আমায় বোধহয় টিভি-তে এই একই কাজ করে যেতে হবে। পাশাপাশি ছবিতে যেমন মানুষ আমায় ডাকবে, একটা দু’টো ছবিতে কোনও কাজ দেবে, আমি তা-ই করে যাব।
অতিমারী আমার চোখ খুলে দিয়েছে…
সত্যি বলতে কি করোনা আমার চোখ খুলে দিয়ে গিয়েছে। আমার কেন, গোটা বিশ্বের কাছেই এই সময়টা ছিল শিক্ষণীয়। ওই সময় আমরা যে পরিমাণ ওটিটি দেখেছি, যে ধরনের কাজ দেখেছি, যে অভ্যাসের মধ্যে চলে গিয়েছি, তা সত্যিই একটা নতুন দিক। নানা রকমের কাজ, নানা রকমের গল্পের ধাঁচ, যা মানুষের স্বাদ বদল ঘটায়। তখনই ঠিক আমার ভেতরের খিদেটা জাগে। আমার বয়সের মহিলাদের নিয়ে তো কত কাজ হচ্ছে। হয়তো বাংলায় হচ্ছে না, তবে অন্যান্য জায়গায় তো হচ্ছে। আশা রাখি বাংলাতেও হয়তো হবে। তাই দেখাই যাক না একটু অন্য স্বাদের কাজের খোঁজ করে। এত বছর তো টিভিতে কাজ করলাম। টিভি থেকে যে বিরতি নিচ্ছি এমনটা নয়, তবে কিছুটা সময়ের জন্য একটা বিরতি নিয়ে দেখা মাত্র, পরিস্থিতি আমায় কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলে।
আমায় কখনও অন্য চরিত্রে ভাবাই হল না…
হতেই পারে দিনের পর দিন সিরিয়াল করার জন্যই হোক বা এক ধাঁচে আমায় দেখতে অভ্যস্থ বলেই হোক, আমায় নিয়ে সেভাবে কেউ কখনও ভাবেনি। এটা আমার বিরাট আক্ষেপ। আমি ক’টা ছবিতে কাজ করেছি? তেমন তো কাজই করিনি। হয়তো আমার দিক থেকেও কোনও খামতি ছিল। আমিই হয়তো কখনও ভাবিনি ছবি নিয়ে। এটাও কিন্তু ঠিক।
সিরিয়ালের সেকাল-একাল
আসলে আমি যখন শুরু করেছিলাম, তখন খিদেটা ছবির প্রতি এই জন্যই ছিল না, কারণ সিরিয়ালে খুব ভাল কাজ হত। এত ধরণের কাজ হত, এত ভাল ভাল-ভাল কাজ হত, সে মেগাই হোক বা সাহিত্য-নির্ভরই হোক… টেলিফিল্ম থেকে শুরু করে নানা কাজ, যা করার আনন্দটাই ছিল আলাদা। অনেক সুযোগ ছিল, নানা ধরনের কাজ আমরা করেছি। শুধু আমি কেন, আমার মত অনেকেই সেই সময় করেছেন। বরং তখন বাংলা ছবি সেভাবে অনেকেই পছন্দ করছিলেন না। তাই আমারও টিভির প্রতি ঝোঁকটা তৈরি হয়েছিল। সত্যি বলতে কি, কাজ করে ভীষণ আনন্দ পেতাম তখন।
গত ১০ বছরের একঘেয়েমি
গত ১০ বছরে সবটা যেন পাল্টে গেল। শাশুড়ি-বউমার বাইরে আমাদের বয়সী মহিলাদের চরিত্র নিয়ে কেউ ভাবতেই পারছেন না। হয় তুমি ভাল, নয় তুমি খারাপ। এর বাইরে তোমার আর তেমন কিছুই করার নেই বর্তমানে মেগা সিরিয়ালে। গল্পেও কোনও বৈচিত্র নেই। সেই একই গল্প ফিরে-ফিরে আসা। ফলে আকর্ষণ, কাজের ইচ্ছেটাই হারিয়ে যাচ্ছে।
সেই সুযোগ খুঁজতেই কি মুম্বই…
মুম্বই ভাবলেই তো আর মুম্বইতে কাজ মেলে না। তবে নিঃসন্দেহে আমি চেষ্টা করব। এইটুকু আমি হলপ করে বলতে পারি। সেখানে পায়ের তলার মাটি শক্ত হোক বা না হোক, ভবিষ্যত আমার জানা নেই, তবে চেষ্টা আমি করব। কলকাতা থেকে অনেক শিল্পী এখন বলিউডে গিয়ে কাজ করছেন। সারা ভারত জুড়ে একযোগে কাজ হচ্ছে। মুম্বই এখন বাংলার শিল্পীদের নিয়ে ভাবছে। সুতরাং সেই জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে আমি একটু চেষ্টা করে দেখতে চাই। আর করব না-ই বা কেন, শিল্পী হিসেবে নিজেকে বারে বারে পরীক্ষামূলক কাজে ফেলাটাই তো আমার কর্তব্য হওয়া উচিত।
তেমন চরিত্র পেলে নিঃসন্দেহে টিভি-তে ফিরব
সত্যি বলতে কি তেমন চরিত্রের খোঁজই তো করছি। একই ফর্মুলাতে চরিত্রগুলোকে দেখতে আর ভাল লাগছে না। টিভি সত্যি খুব পাওয়ারফুল মিডিয়াম। তাই সেখানে থাকতেই তো পছন্দ করব, তবে ওই যে বললাম, চরিত্রে বৈচিত্র আনতে হবে। গতে বাঁধা একই জিনিস হয়ে যাচ্ছে না!
এখন যে কেউ টিভির অভিনেতা-অভিনেত্রী হতে পারে
এখনকার চরিত্ররা একই ফর্ম্যাটে বারে বারে কাজ করছে, একটা সময়ের পর তারা হারিয়ে যাচ্ছে, কেন? কারণ অনুশীলন। আমরা যখন শুরু করেছিলাম, তখন ছোট-ছোট চরিত্র দিয়ে অভিনয়ের হাতেখড়ি ঘটত। ভাল কাজ করলে আরও একটু বড় চরিত্র, এরপর ভরসা বাড়লে আরেকটু ভাল, এভাবেই আমরা ধাপে-ধাপে এগিয়েছি। এটাই তো পদ্ধতি হওয়া উচিত। এখন তো যে কেউ টিভি-র অভিনেতা-অভিনেত্রী হতে পারে। এখন তেমনভাবে শেখার কিছুই নেই। যারা কিছুই জানেন না, কথাও বলতে পারেন না, উচ্চারণ স্পষ্ট নয়, অভিনয় কোনওদিন করেননি, তারাও লিড রোল পেয়ে যাচ্ছেন। আর যাঁরা অভিনয় এত বছর ধরে করে আসছেন, কাজটা জানেন, তাঁরা নাকি পিছনে পড়ে থাকছেন। সত্যি বলতে কি টিকে থাকতে চাইলে তোমায় তোমার কাজটা জানতে হবে। রাতারাতি জনপ্রিয় হওয়াই যায়, কিন্তু টিকে থাকা যায় না।
নিজেকে ৫ বছর পর শিল্পী হিসেবেই দেখতে চাই…
আমার অভিনেতা হিসেবে ভাল-ভাল কাজ করা উচিত। আমি শুধু সেটাই করে যেতে চাই। মাধ্যম সেক্ষেত্রে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয় একদমই। বড় কথা হল আমি কী ধরনের কাজ করছি… কত রকমের কাজ করছি।
টলিউডের ছবি পরিণত হচ্ছে
এই বয়সের মহিলা মানেই যে শ্বাশুড়ি নয়, এটা টলিউডও আসতে-আসতে বুঝতে পারছে। ইতিমধ্যেই মাঝবয়সী মহিলাদের নিয়ে কয়েকটি ছবিও হয়েছে। ‘গুলদস্তা’ তারই মধ্যে একটি। তা-ই নতুন তরতাজা ভাবনার প্রয়োজন। নতুন-নতুন ছেলেমেয়েরা আসুক, ভাল কাজ হোক। সকলেরই এটা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার সময় এসেছে। কারণ সমাজও পাল্টাচ্ছে। ফলে আমাদেরও পাল্টে যাওয়া প্রয়োজন।
বদলের ভাবনাটা সিরিয়ালকেও ভাবতে হবে, নয়তো…
ছবি পাল্টাছে। তবে এই বদলের ভাবনাটা টিভিকেও ভাবতে হবে। নয়তো টিভি দর্শক হারাবে, এটা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। কারণ একটা জিনিস বুঝতে হবে যে, মানুষের কাছে এখন সহজেই নানারকমের কন্টেন্ট পৌঁছে যাচ্ছে। কারণ সকলেরই হাতে এখন মোবাইল। প্রত্যেকেই ভীষণ খোলামেলা কাজ করছেন, নতুন-নতুন তথ্যভিত্তিক। দর্শকেরা সারা বিশ্বের কাজ এখন হাতের মুঠোয় পেয়ে গিয়েছে। সুতরাং টিভিকেও ভাবতে হবে যে, যদি দর্শক ধরে রাখতে হয়, দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হয়, তাদেরও চিত্রনাট্যে বদল ঘটাতে হবে। ওই বস্তাপচা একই জিনিস নিয়ে কাজ করা হবে বছরের পর বছর, সেটা কতটা দর্শক ধরে রাখতে সক্ষম, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তা-ই সময় এসেছে বদলের, টিভি সিরিয়াল-নির্মাতাদের এবার ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত। অন্যদের চিন্তা বা যুক্তি আলাদা হতেই পারে। তবে আমার মনে হয় এটাই সত্যি।