মেঘা মণ্ডল
‘স্কুল বাসে চেনা এক মুখ/ কাঁধে ব্যাগ হাতে হিস্ট্রি বুক’—ঘুম কেড়ে নেওয়া সেই আগন্তুকের সঙ্গেই আজ অনেক জেন জ়ি (GEN Z)-র প্রথম ভ্যালেন্টাইন্স ডে। প্রায় এক মাস ধরে নেট সার্ফ করে সবচেয়ে ‘ইউনিক’ গিফট অর্ডার করা হয়েছে ‘পার্টনার’-এর জন্য। ডিনার ডেটের প্ল্যানও রেডি। তাই মায়ের যে শাড়িটা তার সবচেয়ে প্রিয়, সেটা পরে আয়নার সামনে নিজেকে বারবার দেখেছে ক্লাস ইলেভেনের মেয়েটা। শর্টস, বডিকোন ছেড়ে জেন জ়ি ডেটে শাড়িতে? আরে, আজ যে সরস্বতী পুজো। বাঙালির ভ্যালেন্টাইন্স ডে। ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’ বলতে দিনক্ষণ লাগে না। প্রেমের উদযাপন করতেও বাঙালিকে পাঁজি হাতে নিয়ে বসতে হয় না। কিন্তু সরস্বতী পুজোটা আসে মাঘ মাসের শুক্লা পক্ষের পঞ্চমী তিথিতেই। আজও তা-ই এল। আর বাগদেবী সঙ্গে নিয়ে এলেন ভ্যালেন্টাইন্স ডে-কে। এই একটা দিন পড়াশোনার ছুটি। বান্ধবীদের সঙ্গে শাড়ি পরে স্কুলে ভোগ খেতে যাওয়ার দিন। আবার প্রেমিকার হাত ধরে বেড়াতেও যাওয়া যায়। বাড়িতে কোনও ‘কেস’ নেই। সরস্বতী পুজোর আগে কুল না-খাওয়া ছাড়া আর কোনও নিয়ম মানতে হয় না। প্রেমেরও হাতেখড়ি হয় এ দিন। রাস্তায় বেরোলে চোখ ধাঁধিয়ে যায় শাড়ি-পাঞ্জাবিতে। স্কুল পড়ুয়াদের কাছে বরাবরই সরস্বতী পুজোর কদর বেশি। তবে, ফেলনা নয় ‘ওয়েস্টার্ন কালচার’-এর ভ্যালেন্টাইন্স ডে। কিন্তু জেন জ়ি কী ভাবছে, এটাই হল মোদ্দা কথা।
হঠাৎ করে জেন জ়ি কেন (১৯৯৭ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে যে সব মানুষ জন্ম গ্রহণ করেছেন, তাঁরাই জেন জ়েড)? আপনিও ভাবছেন তো! এ বছর স্কুলের সরস্বতী পুজোর দায়িত্বে থাকা ক্লাস নবম-দশমের ছাত্রছাত্রীরা জেন জ়েড। এই প্রজন্মেরই কেউ-কেউ আবার Date Mate খোঁজে টিন্ডার (Tinder), বাম্বল (Bumble)-এ। ২-৩ মাস সম্পর্কে থাকার পর এদের ‘স্পেস’ দরকার পড়ে। আবার যখন প্রেমে পড়ে, ভিড় মেট্রোতেও ভালবাসা জাহির করতে পিছপা হয় না। অর্থাৎ, স্কুলের গেট থেকে ওয়ো (Oyo)—মোটামুটি এই প্রজন্মের নখদর্পণে। দাঁড়ান, জেন জ়ি মানে শুধুমাত্র সদ্য যৌবনে পা দেওয়া কিংবা স্কুলের গেট টপকানো ছেলেটা বা মেয়েটা নয়। আরেক দল জেন জ়ি রয়েছে, যারা আজ সরস্বতী পুজোর দিন পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে অফিস করতে গিয়েছে। খুব বেশি হলে হাফ ডে নেবে আর রাতে যাবে পার্টনারের সঙ্গে ডিনার সারতে। এই জেন জ়ি-ও কিন্তু একসময়ে সরস্বতী পুজোর দিন শাড়ি-পাঞ্জাবিতেই প্রেম করেছে। আর ভ্যালেন্টাইন্স ডে আসায় লুকিয়ে আর্চিজ় গিফট করেছে।
কপোত-কপোতিদের কাছে সরস্বতী পুজো আর দুর্গা অষ্টমী কিছুটা একই। কিন্তু সদ্য মাধ্যমিক-দেওয়া মেয়েটার কাছে সরস্বতী পুজো হল ‘লাইসেন্স’। স্বাধীনতার সংজ্ঞা ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন হলেও, সরস্বতী পুজো হল কিশোর-কিশোরীদের কাছে মুক্তির স্বাদ। সারাবছর বাবা-মায়ের কাছে ‘মাধ্যমিকের বাধ্য মেয়ে’ হয়ে থাকলেও এই দিন লাইসেন্স পাওয়া যায় বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর। যে ছেলেটা সারাবছর ‘বিকেল ছুটির স্কুল’-এর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, সরস্বতী পুজোর দিন গার্লস স্কুলে ঢোকার লাইসেন্স পায় সে। সামনে উচ্চ-মাধ্যমিক। হোয়াটসঅ্যাপে স্টিকার-ইমোজিতে ‘ভালবাসি’ বললেও, আজ ‘সগর্বে’ (ইংরেজিতে flaunt করে) জীবনের প্রথম প্রেমের হাত ধরে ঘুরে বেড়ানোর লাইসেন্স রয়েছে। শাড়ি-পাঞ্জাবিতে প্রেম শুরু হওয়ার লাইসেন্স সরস্বতী পুজোর দিন। তাছাড়া পড়াশোনার তো ছুটি। বই তো দেবীর পায়ের কাছে—রাজহাঁসের কোল ঘেঁষে দেওয়া আছে। এই লাইসেন্সকে কখনও কি টেক্কা দিতে পারে ভ্যালেন্টাইন্স ডে? টেক্কা কতটা দিতে পারে, হয়তো বলা কঠিন। কিন্তু এ বছরে একটা ‘লাভ’ (পড়ুন Love) রয়েছে। ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য আলাদা করে ছাড়পত্র জোগাড় করতে হয়নি ক্লাস ইলেভেনের মেয়েটাকে।
জেন জ়ি-এর একদল সরস্বতী পুজো কাটাচ্ছে অফিসে, বসের উপর রাগ দেখিয়ে। আরেকদল জেন জ়ি-এর সরস্বতী পুজোর দিনটা, যাকে বলে, পুরো sorted। ওই যে, এ বছর তারা ‘লাইসেন্স’ পেয়েছে। তবে, বয়স বেড়ে চলা জেন জ়ি-রা আজও নস্ট্যালজিক হয়ে পড়ে স্কুলের সরস্বতী পুজোর কথা ভেবে। ঠিক যেমনটা হলেন অভিনেতা ঋতব্রত মুখোপ্যাধায়। জেন জ়ি-এর প্রথমে দলে থাকা ঋতব্রতর এ বছরের সরস্বতী পুজো কাটবে কাজের মধ্যে দিয়েই। তবে, প্রতি মুহূর্ত তিনি মিস করবেন স্কুলের ভোগ, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, অনুষ্ঠান ইত্যাদি। ক্যাজুয়াল ডেটিং, ফ্রেন্ডজ় উইথ বেনিফিটস, ওয়ান নাইট স্ট্যান্ডের মাঝে বাঙালি জেন জ়ি-দের কাছে আজও প্রাধান্য পায় সরস্বতী পুজোই। তা বলে আজ যে ভ্যালেন্টাইন্স ডে, সেটা ভুলে গেল নাকি এই প্রজন্ম? একদম নয়। বরং, ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে সরস্বতী পুজো পড়ে যাওয়ায় একটু ক্ষতিই হয়েছে বলে মনে করছেন ‘সদা সিঙ্গল অগ্নি’। আরজে অগ্নির মতে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে ও সরস্বতী পুজো আলাদা-আলাদা দিনে পড়লে ভালবাসাকে উদযাপন করার দু’টো দিন পাওয়া যেত।
২৪ বছরের ঋতব্রতর কাজ ছাড়া আজকের বিশেষ কোনও প্ল্যান নেই। জ়িলেনিয়াল অগ্নিরও দিনটা শুরু হয়েছে রেডিয়ো স্টেশনের স্টুডিওর মাইক্রোফেনের সামনে। কিন্তু ১৭ বছরের অভিনেত্রী মোহনা মাইতি দারুণ উত্তেজিত। সামনে পরীক্ষা থাকলেও ‘গৌরী’ সরস্বতী পুজোর অঞ্জলিটা শাড়ি পরেই দেবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন। তবে, একইদিনে পড়া ভ্যালেন্টাইন্স ডে নিয়ে খুব বেশি মাথাব্যথা নেই তাঁর। বরং, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, ভোগ আর সেলফিতেই তিনি দারুণ মজা করছেন। এমনকি বন্ধুদের শাড়ি-পাঞ্জাবিতে জোড়ায়-জোড়ায় দেখে তিনি খুশি। বহরমপুরে বেড়ে ওঠা মোহনা একটু মন খারাপ করেই বললেন, “ক্লাস নাইনে পড়ার সময় খুব উত্তেজিত থাকতাম স্কুলের পুজো নিয়ে। বন্ধুরা মিলে পুজোর সব আয়োজন করতাম। জুনিয়রদের উপর দিদিগিরি ফলাতাম, আর সিনিয়রদের সঙ্গে হাতে-হাত মিলিয়ে কাজ করতাম। বন্ধুরা মিলে আগে ঠিক করে রাখতাম কে, কোন শাড়িটা পরব। রং মিলিয়ে শাড়ি পরতাম আমরা। আগে বাবার হাত ধরে পুজোর দিন শহরের সব স্কুলের ঠাকুরগুলো দেখতাম।” স্কুল জীবনের প্রেম জিনিসটা ঠিক এখনও বুঝে উঠতে পারেননি মোহনা। প্রেমের প্রস্তাব পেলেও মন দেননি এখনও কাউকে। বন্ধুদের জোড়ায়-জোড়ায় দেখেও ভ্যালেন্টাইন্স ডে নিয়ে একটুও মন খারাপ নেই তাঁর। এই যে সরস্বতী পুজোর দিনে ভ্যালেন্টাইন্স ডে পড়েছে, সেখানে “বাবা-ই আমার ভ্যালেন্টাইন,” বললেন মোহনা।
সরস্বতী পুজোকে ‘বাঙালির ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ বললেও শাড়ি-পাঞ্জাবি আর একসঙ্গে অঞ্জলি দেওয়ার ব্যাপারটা জাস্ট অসম্ভব। আর এই দু’টো বিষয় ছাড়া খুব বেশি অদল-বদল হয় না প্রেম দিবস উদযাপনে। শপিং মল থেকে প্রিয় ক্যাফেতে বসে একসঙ্গে কিছুটা সময় কাটানো, সেলফি-রিলসে মোবাইলের গ্যালারি ভর্তি হয়ে যাওয়া—এভাবেই জেন জ়ি আজ সরস্বতী পুজো ও ভ্যালেন্টাইন্স ডে কাটাচ্ছে। দেখতে গেলে, বেশ ধুমধাম করে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-ও সেলিব্রেট করে এই প্রজন্ম। অগ্নি বলেন, “এখন ভীষণ ভাবে বেড়ে গিয়েছে প্রেমের দিন উদযাপন করা। সরস্বতী পুজো হোক ভ্যালেন্টাইন্স ডে, শহরের রেস্তোরাঁ, ক্যাফে, শপিংমলগুলোতে যুগলদের ভিড়। তাছাড়া আমি মনেও করি, ভালবাসাকে উদযাপন করাই উচিত। আর সেটা কে কীভাবে করবে, তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার।” সহমত ঋতব্রতও।
সিঙ্গল হলেও জেন জ়ি ঋতব্রতর ভ্যালেন্টাইন্স ডে-এর স্মৃতি বেশ মজাদার। স্কুলের রঙিন দিনগুলোর কথা মনে করে ঋতব্রত বলেন, “আমার স্কুল লাইফে একটা প্রেম ছিল। আমি ও আমার প্রেমিকা কেউই ভ্যালেন্টাইন্স ডে উদযাপন নিয়ে খুব একটা সিরিয়াস ছিলাম না। তাই আমিও ওর জন্য কিছুই প্ল্যান করিনি। সে দিন পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষা দিয়ে বেরোনোর সময় দেখি ফুল, চকোলেট আর হাতে বানানো কার্ড নিয়ে তিনি স্কুলের গেটে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। অন্যদিকে, আমি কিছুই নিয়ে যাইনি ওর জন্য। খুব বাজে রকম কেস খেয়েছিলাম সে দিন।” ঋতব্রত মনে করেন, ‘কীসের ভালবাসা যদি পাগল-পাগল না লাগে’ (‘দিলখুশ’ ছবির গান ‘সজনী’র লাইন)। আর এই ভালবাসা-প্রেমকে কেন্দ্র করে উন্মাদনাটা উপভোগ করার লাইসেন্স বাঙালির কাছে সরস্বতী পুজো।
আজকের দিনে শাড়ি-পাঞ্জাবি যুগল দেখে একটু মন খারাপ হয় ঋতব্রতর। একটু-আধটু মনে পড়ে প্রথম প্রেমিকার কথা। তবে তার থেকেও বেশি দুঃখ অগ্নির। প্রাক্তন প্রেমিকার কথা ভেবে কিংবা লেট টোয়েন্টিজ়-এ এসে গিয়েছেন বলে নয়। সরস্বতী পুজো ও ভ্যালেন্টাইন্স ডে একসঙ্গে পড়ে যাওয়ায় জেন জ়ি’কে একদিনই প্রেম দিবস উদযাপিত করতে হচ্ছে—এটাই মেনে নিতে পারছেন না ‘সদা সিঙ্গল’। ‘সদা সিঙ্গল’ হলেও অগ্নি হলেন সেই মানুষটা যিনি, ‘প্রেম না নিয়েও কী দারুণ গান’ লিখে দিতে পারেন। শাড়ির কুচি ধরতে তিনি এক্সপার্ট। তবে স্কুল লাইফে প্রেমিকার হাত ধরে সরস্বতী পুজো কাটেনি তাঁর। কলেজের ৬ মাসের প্রেমটাও সরস্বতী পুজোর দিন মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে ভোগ খেতে গিয়ে কেটে গিয়েছিল। এমনকি এ বছরও অফিসেই কাটছে প্রেম দিবস।
পার্টনার খুঁজে নেওয়ার চাপ ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে থাকে না। বয়স বাড়লে আলাদা করে প্রেম দিবসও পালন করা হয়ে ওঠে না। আবার ‘ভালবাসি’ বলার জন্যও কিন্তু দিনক্ষণ দেখতে হয় না। কেউ ছোট-ছোট বিষয়েই প্রেম খুঁজে পান। আবার কেউ গোটা একটা দিন শুধু মনের মানুষকে ঘিরে কাটাতে চায়। এই ছোট্ট সমীক্ষা বলছে, বাঙালির জেন জ়ি সরস্বতী পুজোকেই বেশি ভালবাসে। কিন্তু ভ্যালেন্টাইন্স উইকেও চকোলেট, ব্যাঙ্গালোর রোজ় কেনে তারা। ছাত্রজীবনেই বেশি রঙিন থাকে সরস্বতী পুজোটা। কিছুটা ‘দু’জনেরই নেই নিয়ম ভাঙার বয়স/তবু দু’জনেরই রয়েছে নিয়ম ভাঙার মন’। ভ্যালেন্টাইন্স ডে হোক বা সরস্বতী পুজো, প্রেম দিবস পালনের ক্ষেত্রে বাংলার জেন জ়ি আজও ওল্ড স্কুল টাইপ। ওই যে, শাড়ি-পাঞ্জাবি আর পুষ্পাঞ্জলির বাঙালিয়ানাকে টেক্কা দিতে পারবে না কোনও ‘বিদেশি শক্তি’।