Sleep-Cycle নষ্ট, CORONASOMNIA-র জেরে কতটা নষ্ট আপনার মানসিক স্বাস্থ্য; কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
বিশেষজ্ঞদের মতে, কম্পিউটারের ক্ষেত্রে REBOOTING-এর যা কাজ, আমাদের দেহে ঘুমের গুরুত্বও অনেকটাই সে রকম। গত বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, ব্রিটেন এবং আমেরিকার ২৮৮৪ স্বাস্থ্যকর্মীর উপর একটি সমীক্ষা করা হয়। এঁদের মধ্যে ৫৬৮ জনের করোনা হয়েছিল। সমীক্ষায় দেখা যায়, আক্রান্তদের প্রতি চার জনের মধ্যে এক জনের ঘুমের সমস্যা হচ্ছে।
পায়েল মজুমদার
‘Sleep is like love. You can’t make it happen.’
ভাবছেন কোনও হাই-ফান্ডার দর্শন?মোটেও না। চোখ বন্ধ করে (ঘুমোনোর দরকার নেই) মনে করুন দেখি জোর করে কখনও ঘুমোতে পেরেছেন? পাশবালিশ নিয়ে এ পাশ-ও পাশ, তার পর কুপোকাত্। শেষমেশ ‘ধুত্তেরি ছাই’ বলে ফেসবুক-টুইটার-ইন্সটার নীল-সাদা জগতে ঘুরে বেড়ানো। চেনা ব্যাপার তো? এ বার ধরুন, এই চেনা ব্যাপারটি যদি প্রত্যেক সপ্তাহে তিন-চার দিন হতে থাকে, তা হলে? একেবার অজানা সমস্যা নয় ঠিকই, তবে গত দেড় বছরে ভুক্তভোগীর সংখ্যা বেড়েছে অনেকটাই। বিশেষজ্ঞদের কারও-কারও মতে, করোনা-অতিমারির পর অনিদ্রা-মহামারির মুখোমুখি হওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। সমস্যার গুরুত্ব বিচার করে অনেকে রোগটিকে ডাকছেন নতুন নামে: CORONASOMNIA।
উদাহরণ দেওয়া যাক? নিউ ইয়র্ক শহরে বসে অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষিকা। হঠাত্ আব্দার পড়ুয়াদের। সকালের বদলে রাতে ক্লাস নিন প্লিজ়। কেন? ঝটপট উত্তর, ‘আমাদের তো রাতে ঘুম আসে না। তিনটে-চারটে পর্যন্ত জেগে থাকি। তখনই ক্লাসটা নিয়ে নিন। সকালবেলার দিকটা বরং ঘুমিয়ে নেব।’ হাসির রোল ক্লাসে। বিষয়টি যদিও হাসির নয়, মত বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু কেন এরকম?
আরও পড়ুন: কতটা মন খারাপ হয় মনোবিদদের? কী বলছেন স্বয়ং মনোবিদ-সমাজকর্মীরা?
এক কথায় উত্তর, PANDEMIC। গত দেড় বছরে নাওয়া-খাওয়া-ঘুম, সবটাই বদলে গিয়েছে করোনার ধাক্কায়। তাতে যে সকলের ঘুম চুরি গিয়েছে, এমন নয়। নতুন জীবনের সঙ্গে মানিয়ে-গুছিয়ে দিব্যি ঘুমোচ্ছেন অনেকে। কিন্তু কারও-কারও ক্ষেত্রে ঘুমোনো যেন মাউন্ট এভারেস্টে চড়ার মতো কষ্টকর। কেউ আবার ঘুমিয়ে পড়লেও মাঝরাতে জেগে যাচ্ছেন। তারপর আর দু’চোখের পাতা এক হচ্ছে না কিছুতেই। অন্যদের ক্ষেত্রে ঘুম হলেও ক্লান্তি কাটছে না। অর্থাত্ QUALITY OF SLEEP-এ গণ্ডগোল। এই সমস্যাগুলি সম্পূর্ণ নতুন নয়। তবে করোনাকালে বেড়েছে অনেকটাই, মত বিশেষজ্ঞদের। ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রির চিকিৎসক-অধ্যাপক সুজিত সরখেলের অভিজ্ঞতায়, অতিমারির আগে এই ধরনের সমস্যা নিয়ে যত মানুষ তাঁর কাছে আসতেন, এখন অন্তত তার দ্বিগুণ আসেন। প্রায় একমত দক্ষিণ কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালের নিউরো-মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অনিমেষ করও। জানালেন, আগের তুলনায় INSOMNIA-র সমস্যা নিয়ে এখন নিদেনপক্ষে ৩০-৪০ শতাংশ বেশি মানুষ আসছেন।
কারণগুলির কয়েকটি এত দিনে আমাদের মুখস্থ। জীবন ও জীবিকা ঘিরে অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ, ভয়, সব মিলিয়ে স্ট্রেসের গ্রাফ উপরের দিকে। কাছের মানুষ, আত্মীয়, বন্ধু প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা নেই অনেক দিন। কখনও দেখা হবে কি না, তা নিয়েও আশঙ্কা ষোলো আনা। অনিমেষবাবুর কথায়, ”বিশেষ করে এই সেকেণ্ড ওয়েভে বহু পরিবার কাউকে না-কাউকে হারিয়েছে। জয়েন্ট বা এক্সেটেন্ডেড ফ্যামিলি ধরলে এমন পরিবারের সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। ফলে প্রিয়জনকে হারানোর আশঙ্কা ও উদ্বেগ এখন আরও বেশি।” কোনও-কোনও ক্ষেত্রে সমস্যাটা আবার আলাদা। যেমন পরিবার বা সম্পর্কে তুমুল অশান্তি সত্ত্বেও সেখান থেকে বেরোনো যাচ্ছে না। কারণ? করোনা ও বিধিনিষেধের গেরো।
CORONASOMNIA-র বাড়বৃদ্ধির পিছনে আরও কয়েকটি কারণ রয়েছে, ধারণা সুজিতবাবুর। বললেন, ”করোনা হলে হাসপাতালে ভর্তি কী করে হব, এটা এখন উদ্বেগের বড় কারণ। বিশেষত রাতবিরেতে অক্সিজেন-স্যাচুরেশন নেমে গেলে কী হবে, সেটা ভেবেও কেউ-কেউ অসম্ভব উদ্বিগ্ন থাকেন। দ্বিতীয়ত, এত দিন পর্যন্ত শারীরিক পরিশ্রম করার যতটুকু সুযোগ ছিল, লকডাউনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় এখন সেটিও বন্ধ। সঙ্গে ওলোট-পালোট হয়ে যাওয়া দৈনিক রুটিন তো রয়েছেই।” কী রকম? রাত পর্যন্ত জেগে থেকে ফিল্ম বা ওয়েব সিরিজ় দেখা, পর দিন অনেক দেরিতে ওঠা বা দিনের যে কোনও সময় ঘুমিয়ে পড়া। অর্থাৎ ঘুমের কোনও নির্দিষ্ট সময় থাকছে না। তাতেই নষ্ট হচ্ছে SLEEP-CYCLE।
সমস্যাটি দীর্ঘদিন চলতে থাকলে বিপদের আশঙ্কা ষোলো আনা। বিশেষজ্ঞদের মতে, কম্পিউটারের ক্ষেত্রে REBOOTING-এর যা কাজ, আমাদের দেহে ঘুমের গুরুত্বও অনেকটাই সে রকম। নতুন স্মৃতির ভাঁড়ার তৈরি থেকে শরীরের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিছু কাজ সুর-তাল-ছন্দ মিলিয়ে যাতে চলে, তার চাবিকাঠি কিন্তু ঘুমের হাতেই। বিশেষত করোনা পরিস্থিতিতে এর গুরুত্ব আরও বেশি, মত বিশেষজ্ঞদের। গত বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, ব্রিটেন এবং আমেরিকার ২৮৮৪ স্বাস্থ্যকর্মীর উপর একটি সমীক্ষা করা হয়। এঁদের মধ্যে ৫৬৮ জনের করোনা হয়েছিল। সমীক্ষায় দেখা যায়, আক্রান্তদের প্রতি চার জনের মধ্যে এক জনের ঘুমের সমস্যা হচ্ছে। আর যাঁরা সংক্রামিত হননি, তাঁদের প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে এক জন ঘুমের অসুবিধার কথা বলছেন। সমীক্ষকদের বিশ্লেষণ, যাঁরা বেশি ঘুমোচ্ছেন তাঁদের সংক্রমণের আশঙ্কা কম। এর মধ্যে কোনও কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে কি না, তা অবশ্য বলতে পারেননি সমীক্ষকরা। তবে ঘুমের সঙ্গে সার্বিক ভাবে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার যোগ প্রমাণিত। অনিমেষবাবুর সংযোজন, ”দীর্ঘদিন ঘুম না হলে তার ধাক্কা বিপজ্জনক হতে পারে। এমনকী স্বল্পমেয়াদেও সুগার, প্রেশারের মতো সমস্যা তৈরি হতে পারে।”
কিন্তু ওই যে! ‘Sleep is like love. You can’t make it happen.’ তা হলে উপায়?
এ ব্য়াপারে মোক্ষম কিছু পরামর্শ রয়েছে চিকিৎসকদের। ধরুন, আপনি ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছেন। সেক্ষেত্রে যে ঘরে বা ম্যাট্রেসে রাতে ঘুমোতে যান, দিনের বাকি সময়টা সেখানে না কাটানোই ভালো। করোনার আগে কাজের জায়গা বাইরে কোথাও ছিল নিশ্চয়ই। তাই বাড়ি থেকে কাজ করলেও সেই ধারাটা যতটা সম্ভব একই রাখবেন। দ্বিতীয়ত, ঘুমের সময় নিয়ে কোনও খামখেয়ালিপনা নয়। স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি-চাকরিতে বেরোনোর সময় যখন ঘুম থেকে উঠতেন, এখনও সেই সময়টাই মেনে চলা ভালো। শরীরের নিজস্ব ছন্দ রয়েছে। সেই ঘড়ি বার বার বদলালে SLEEP-CYCLE-এর দফারফা হওয়ার আশঙ্কা ষোলো আনা। তৃতীয়ত, ঘাম ঝরানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি হোক বা যোগব্যায়াম বা ট্রেডমিল, যেটা সম্ভব, নিয়মিত এক্সারসাইজ় জরুরি। কিন্তু মন? তাকে বোঝাব কী করে, ভাবছেন নিশ্চয়ই?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি যে অত্য়ন্ত কঠিন তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। চিন্তা, ভয় ও উদ্বেগ সবটাই আসবে। কিন্তু তা প্রত্যেক দিনের চলাফেরা, কাজকর্মে বাধা দিতে শুরু করলে কয়েকটি জিনিস করে দেখা যেতে পারে।
১) করোনা নিয়ে বাড়িতে বা ফোনে কোনও আলোচনা নয়। ২) তথ্য সংগ্রহ করবেন হু, সিডিসি বা আইসিএমআর-এর মতো বিশ্বাসযোগ্য জায়গা থেকেই। ৩) দিনের যে কোনও নির্দিষ্ট সময়ে করোনার আপডেট নিন। তার আগে বা পরে এ নিয়ে কোনও আলোচনা বা খোঁজখবর নৈব-নৈব চ। ৪) বাকি সময়টা নতুন কিছু শেখার কাজে ব্যবহার করতে পারেন। ৫) নিত্যনতুন স্কিল শেখা জরুরি। কাজের বাইরে মন দিতে পারেন সে দিকেও। বহু প্রশিক্ষণ আজকাল অনলাইনেই হয়। ৬) পরিবারের জন্যও দিনের কিছুটা সময় বরাদ্দ থাকুক না হয়। ৭) উদ্বেগ তৈরি হলে সেটি নিয়ে আবার চিন্তা করবেন না। এই পরিস্থিতিতে কিছুটা চিন্তা স্বাভাবিক। ৮) বাড়াবাড়ি হলে মনোবিশেষজ্ঞ ও মনোচিকিৎসকরা আছেন সব সময়। কোভিড-পরিস্থিতিতে তাঁদের অনেকেই অনলাইনে পরামর্শ দেন। ৯) রাতে শোওয়ার আগে পেশাগত দরকার না পড়লে মোবাইল বা কম্পিউটার স্ক্রিনে নজর নয়। ১০) ঘুমোতে যাওয়ার আগে হালকা গান শুনতে পারেন। ১১) বেশি রাতে চা-কফি না খাওয়াই ভাল।
অর্থাৎ করোনা নিয়ে উদ্বেগ কমানোর পাশাপাশি যতটা সম্ভব স্লিপ হাইজিন মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। সঙ্গে শারীরিক পরিশ্রমের নিদান তো রয়েছেই। তবে তার পরও ঘুম না হলে দু’টি বিষয় মনে রাখা জরুরি। এক, ঘুম কেন আসছে না, এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে যাবেন না। উত্তর তো মিলবেই না, ঘুম পালাবে আরও দূরে। যদি স্বাভাবিক ভাবে ঘুম না আসে, তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কারণ এই সমস্যার সমাধান আছে। চিকিৎসক এবং ওষুধ তো আছেই।