Medicine Banned: ওষুধ খাচ্ছেন না বিষ! খাওয়ার আগে এই খবরটি পড়ে নিন
Medicine Banned: কেন বারবার গুণগুত মানে ফেল করছে বিবিধ জীবনদায়ী ওষুধগুলি? কোন কোন ক্ষেত্রে একটি ওষুধকে ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়? কেন বারবার মানুষের জীবন নিয়ে এইভাবে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে?
কথায় বলে ‘যেমন রোগ তার তেমন দাওয়াই।’ অর্থাৎ সোজা কথায় বললে, যেমন অসুখ সেই অনুসারে ওষুধ প্রয়োজন। শরীরে অসুখ হলে, তা সারাতে সঠিক ওষুধ একমাত্র পথ। কিন্তু কঠিন রোগে সঠিক ওষুধ দিয়েও যদি কাজ না হয়, তখন? ধরুন আপনার খুব জ্বর হয়েছে। এমন জ্বর যা প্যারাসিটামল, অ্যান্টি বায়োটিক খেয়েও কমছে না। এদিকে ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া বা সম্ভাব্য অসুখের জন্য অনান্য সব টেস্ট করেও কোনও কিছুই ধরা পড়ছে না। এমন কিছু ঘটলেই আমরা ভাবি বোধহয় জ্বরের ভাইরাস বেশি শক্তিশালী। হয়তো কোনও জটিল রোগ হয়েছে, যা চিকিৎসকও ধরতে পারেছন না। এই ভেবেই অন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেন। এমন নয় যে চিকিৎসকেরা সব সময়ই সঠিক চিকিৎসা করেন।
তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যে বিষয়টিতে চিকিৎসকের দোষ থাকে না এই ব্যাপারটিও সত্যি। আপনি বলবেন ‘ডাক্তার বাবু ওষুধ দিচ্ছেন, যে কোম্পানির, যে ওষুধ খাওয়াতে বলছেন তাই খাওয়ানো হচ্ছে। কম দামি নয়, বেশি দাম দিয়েই বাজার চলতি দামি ওষুধ কিনে এনে খাওয়ানোর পরেও রোগী সুস্থ না হলে দায়টা কার? ডাক্তার বাবু ভুল চিকিৎসা করছেন না তো কী?’ কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন এই দায়টা হতে পারে সেই ওষুধেরও। আর যে সংস্থা সেই ওষুধ প্রস্তুত করছে তার। সঙ্গে খানিকটা হলেও আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং সরকারেরও।
এই খবরটিও পড়ুন
শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। কিছুদিন আগের ঘটনা, রানাঘাট মহকুমা হাসপাতালে রোগীকে রিঙ্গার ল্যাকটোজ স্যালাইন দেওয়া হয়। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে রোগীর অবস্থার উন্নতির বদলে তাঁদের কাঁপুনি শুরু হয়। দেখা যায় যাঁদের কাঁপুনি হয়েছিল তাঁদের নির্দিষ্ট দুটি ব্যাচ থেকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছিল। এর পরেই ড্রাগ কন্ট্রোল বিভাগ ওই ব্যাচের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য নিয়ে যায়।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর গুণমান পরীক্ষায় ফেল করেছে প্রতিদিন খাওয়ার মতো কিছু ওষুধ। সেই তালিকায় রয়েছে বদহজমের ওষুধ ‘প্যান ডি’, ক্যালসিয়াম সাপলিমেন্ট ‘শেলক্যাল’, অ্যান্টি-ডায়াবিটিক ওষুধ ‘গ্লিমেপিরাইড’, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রক ‘টেলমিসারটান’ ও আরও বেশি কিছু নামজাদা ওষুধ। গুণগত মানে ফেল করা এই সব ওষুধগুলির প্রস্তুতকারক সংস্থার মধ্যে রয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক ওষুধ নির্মাণকারী সংস্থাও।
গত ২৬ অক্টোবর সেন্ট্রাল ড্রাগ্ররেগুলেটারি অথোরিটি ‘বিষাক্ত’ বলে ঘোষণা করেছে ৪টি ওষুধকে। গুণগত মানে ফেল করেছে ১৮টি ওষুধ। আতস কাচের তলায় এসেছে ৪৯টি ওষুধ।
কয়েক মাস আগেও ২০২৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গাইনাইজেশন’ বা সিডিএসসিও প্রায় ৫৬টি রোজকার ব্যবহারের ওষুধকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে, কেবল গুণগত মান খারাপ হওয়ার কারণে।
বিষয়টি যা দাঁড়াচ্ছে, তা হল বাইরে থেকে নামীদামি আন্তর্জাতিক বহু সংস্থার ওষুধ দাম দিয়ে কিনলেও তার গুণগত মান নিয়ে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু প্রশ্ন হল যে কেন বারবার গুণগুত মানে ফেল করছে বিবিধ জীবনদায়ী ওষুধগুলি? কোন কোন ক্ষেত্রে একটি ওষুধকে ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়? কেন বারবার মানুষের জীবন নিয়ে এইভাবে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে? সঠিক দাম দিয়ে ওষুধ কিনলেও সেই ওষুধে কেন ভেজাল থাকছে? সরকারি জায়গা থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন জেনেরিক ওষুধগুলিকেই বা ভরসা করা যায় না কেন? কোথায় গলদ রয়েছে?
এই উত্তর খুঁজতেই টিভি৯ বাংলা ডিজিটাল যোগাযোগ করে স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ আধিকারিকের সঙ্গে। কথা বলে মেডিসিন চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাস, শিশুরোগ চিকিৎসক প্রভাস প্রসুন গিরির সঙ্গেও।
চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাস বলেন, “ওষুধের মান কমে যাচ্ছে, এই বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এর ফলে আগে টাইফয়েডের মতো যে অসুখ সারতে ৫ দিন সময় লাগত, সেখানে আরও বেশিদিন সময় লাগবে। তার থেকেও বড় কথা সুগার বা প্রেশারের মতো ওষুধের মান কমে গেলে শরীরে সেই সব ওষুধের একটা করে রেসিট্যান্ট বা প্রতিরোধ তৈরি হয়ে যায়। ফলে পরবর্তী কালে বেশি পাওয়ারের ওষুধ কেন এই সব রোগে ওষুধ কাজ করাই বন্ধ করে দেবে। আর যদি সুগার বা প্রেশার কন্ট্রোল করা না যায়, আরও বড় রোগ দানা বাঁধবে শরীরে। হার্টের অসুখ, কিডনির অসুখ ও আরও নানা বড় অসুখের ঝুঁকিও অনেকাংশে বেড়ে যাবে। বেশি পরিমাণে ওষুধ খেলে তারও একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শরীরে দেখা যাবে।”
কিন্তু কেন এমন ঘটছে?
অরিন্দমবাবু জানান, ভারতবর্ষে বিভিন্ন ওষুধ বাজারে বিক্রির অনুমতি দিলেও কোয়ালিটি কন্ট্রোলের বিষয়টি ভালভাবে প্রচার হয়নি। তিনি বলেন, “প্রত্যেক বছর ওষুধের কোয়ালিটি কন্ট্রোল হওয়া উচিত। অথচ আমরা কেউ জানি না ভারতে ঠিক কত বছর অন্তর অন্তর ওষুধের কোয়ালিটি কন্ট্রোল হয়।”
শিশুরোগ চিকিৎসক প্রভাসবাবু বলেন, “ভারতে এত রকম ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি আছে তা আর অন্য কোনও দেশে নেই। হয়তো একই জেনেরিক ওষুধ বা অ্যান্টিবায়োটিক ১০০টা কোম্পানি নানা ব্র্যান্ড দিয়ে, নাম দিয়ে তৈরি করছে। কিন্তু ছোট কোম্পানি বা বড় কোম্পানি কারও কোনও রকম কোয়ালিটি কন্ট্রোল হয়না। এমনকি কোয়ালিটি কন্ট্রোল বা রেগুলার ল্যাব টেস্টিং করার জন্য যে ধরনের পরিকাঠামো প্রয়োজন তাও নেই। তাই কোম্পানিগুলো কতটা ওষুধ দিচ্ছে আর কতটা কী দিচ্ছে কেউ জানে না। এ ক্ষেত্রে যেহেতু ছোট সংস্থার রেপুটেশনের চিন্তা কম, তাই তাদের তৈরি ওষুধে ঝুঁকি বেশি।”
ভারতবর্ষের জেনেরিক ওষুধের মান কেমন?
প্রভাসবাবু জানাচ্ছেন, এখানে জেনেরিক বা নন জেনেরিক ওষুধ, কোনওটারই কোয়ালিটি কন্ট্রোল হয়না। তিনি বলেন,”সরকারি জায়গায় যারা ওষুধ সাপ্লাই করে বা জেনেরিক নামে ওষুধ বিক্রি করে তারা খুব একটা নামী কোম্পানি নয়। তাঁরা কী ভাবে ওষুধ তৈরি করে, কী ভাবে প্রসেস করে কেউ জানে না। এই সব কোম্পানির দেশের বাইরেও কোনও অস্তিত্ব নেই। তাই আমরা ধরে নিই, এঁদের ওষুধ খারাপ। তবে কাগজে কলমে এই বিষয়ে কোনও প্রমাণ নেই। তা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট প্রমাণ আমাদের কাছে থাকে না।”
অরিন্দম বিশ্বাসের মত, জেনেরিক ওষুধের মান ভারতে ভাল হলে একটা কথা ছিল। বিশেষ প্রবীণ নাগরিক যাঁরা, চাকরি থেকে অবসর নিয়ে নিয়েছেন, তাঁদের পক্ষে সব সময় দাম দিয়ে ওষুধ কেনা সম্ভব হয় না। তাই বাধ্য হয়েই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে জেনেরিক ওষুধ কিনতে হয়।
বেসরকারি নামীদামি সংস্থার ওষুধও কেন গুণগত মানে মুখ থুবড়ে পড়ছে বারবার?
প্রভাসবাবু বলেন, “এর পিছনে রয়েছে আরও বেশি মুনাফার দিকটি। কিছুদিন আগেই ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্য সামনে আসতে দেখা গিয়েছিল ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলি সরকারকে প্রচুর প্রচুর টাকা চাঁদা দিয়েছে। যা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহ দানা বেঁধেছে। আবার যে ওষুধে ১০০ গ্রাম মলিকিউল প্রয়োজন, সেখানে ১০গ্রাম মলিকিউল দিলে ওষুধ তৈরির খরচ অনেক কমে। তেমনই ওষুধের কার্যক্ষমতা কমলে, যে ওষুধ ১টা খেলে হত সেটাই ৩টে খেতে হচ্ছে। এতেও সংস্থার বিক্রি বাড়ছে।”
আপনি যে ওষুধ পয়সা দিয়ে কিনছেন তা সঠিক গুণমানের কি না, তা কী করে বুঝবেন?
চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাস বলেন, “সাধারণ মানুষ কেন, কোনও ডাক্তারও ওষুধ কিনে আনলে বুঝতে পারবে না তা সঠিক গুনমানের কি না। সরকারের কোয়ালিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের রিপোর্ট ছাড়া এই বিষয়ে আর কোনও উপায় নেই। সেক্ষেত্রে নিরুপায় হয়ে আমরা ভেবে নিই যে বেশি বড় কোম্পানির বেশি দামের ওষুধটাই ভাল।”
প্রভাসবাবু বলেন, “ওষুধটা জাল না, ভালো কোয়ালিটির তা বোঝার কোনও উপায় নেই। আমি নিজে একটা ওষুধ কিনে খেলেও বুঝতে পারব না। এমনকি যে ওষুধ কিনছি সেটা ওই সংস্থা তৈরি করেছে নাকি অন্য কেউ জাল করেছে তাও বোঝার উপায় নেই। এক্সপায়ার করে যাওয়া ওষুধ তারিখ বদলে চালিয়ে দেওয়া হয়।”
কী ভাবে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব?
স্বাস্থ্য দফতরের একজন শীর্ষ আধিকারিক বলেন, “প্রত্যেক ওষুধ বাজারে আসার আগে তার ল্যাব টেস্ট করা হয়। প্রত্যেক ওষুধের ক্ষেত্রেই গুণমানগত কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। সে ক্ষেত্রে কোনও ওষুধ যদি সেই পরীক্ষায় ফেল করে তাহলে সেই ওষুধকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়।”
তিনি আরও বলেন, “ওষুধের গুণগত মান পরীক্ষার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দিষ্ট বিভাগ এই কাজটি করে থাকে।”
যদিও অরিন্দমবাবু বলেন, “সরকারকে এই বিষয়ে আরও আগুয়ান, দায়িত্বশীল এবং সচেষ্ট ভূমিকা পালন করতে হবে। যা তারা করেনি। সরকারের উচিত একটা ওয়েবসাইট বা অ্যাপ নিয়ে আসা। যেখানে নিয়মিত এই সব ওষুধের কোয়ালিটি চেক করে তার রিপোর্ট দেওয়া থাকবে। যা দেখে আমরাও বুঝতে পারব যে ওষুধ আমরা লিখছি তার গুণগত মান ভাল না খারাপ। কবে শেষ কোয়ালিটি কন্ট্রোল হয়েছিল তাও আমরা জানতে পারব। এখানে মিডিয়ার রোল যথেষ্ট ভাল হলেও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছতে হলে একটা অ্যাপ থাকলে তা আরও বেশি কার্যকরী হবে।”
প্রভাসবাবু বলেন,”যারা ড্রাগ কন্ট্রোলার তাঁরা যদি প্রত্যেক সপ্তাহে সপ্তাহে অ্যাক্টিভ হয়ে স্যাম্পেল নিয়ে তা পরীক্ষা করেন তা হলে একটা ভয় তৈরি হবে। এবং একই সংস্থার একই ওষুধ ব্যাচ নম্বরের হেরফেরে খারাপ ভাল হয়। তাই প্রত্যেকটা কোম্পানির প্রত্যেক ওষুধের প্রত্যেক ব্যাচের ওষুধ ভারতের নানা প্রান্তের নান রাজ্য থেকে সংগ্রহ করে পরীক্ষা করতে হবে। সরকারকে আরও কড়া হতে হবে। জাল ওষুধ ধরা পড়লে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।”
যদিও জাল ওষুধ সম্পর্কে নামীদামি ফার্মা কোম্পানি গুলির সাফাই এই সব নিম্ন মানের ওষুধ তাঁদের তৈরি করা নয়। তাঁদের ওষুধ জাল করা হয়েছে বলেই দায় সেরেছে অ্যালকেম বা সান ফার্মার মতো সংস্থাগুলি। কিন্তু দায় যারই হোক না কেন, তা যে কর প্রাণ ইতিমধ্যেই অকালে কেড়ে নিয়েছে, তা আমরা জানি না কেউই। তা ছাড়া নিম্নমানের ওষুধ বা জাল ওষুধ বিক্রি ব্যতিক্রমী বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বার বার সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা প্রকাশ্যে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, স্যালাইন কিংবা ওষুধের মানে সমস্যা রয়েছে। কিন্তু বারবার অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও অকাট্য প্রমাণের অভাবে ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাকে দোষী সাব্যস্ত করে কঠোর শাস্তি দিতে পারেনি সরকার। দুর্নীতি, অবহেলার এই চক্র প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে জনস্বাস্থ্যকেও। এখনই এই রোগের মোকাবিলা করে তাকে সমূলে উপড়ে না ফেললে ভবিষ্যতে বিপদে পড়তে হবে সকলকেই।