#দিদি-এবার-পিএম-হবে! ভ্যাকসিন-যুদ্ধে জোট বাঁধছেন বিরোধীরা, মধ্যমণি মমতা

অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও আঞ্চলিক দলগুলির সুপ্রিমোদের যে ভাবে পাশে পাচ্ছেন মমতা (Mamata Banerjee), তাতে মোদী-শাহদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।

#দিদি-এবার-পিএম-হবে! ভ্যাকসিন-যুদ্ধে জোট বাঁধছেন বিরোধীরা, মধ্যমণি মমতা
অলংকরণ: অভীক দেবনাথ
Follow Us:
| Updated on: Jun 03, 2021 | 6:29 PM

ভোট আবহে বাংলায় কান পাতলেই শোনা যাচ্ছিল ‘খেলা হবে।’ আর গত কয়েক দিন ধরে সোশ্যালে চোখ রাখলে নজরে পড়ছে ‘দিদি-এবার-পিএম-হবে।’ বাংলার মসনদে হ্যাটট্রিক করেছেন তৃণমূল (TMC) সুপ্রিমো। দিল্লি থেকে ছুটে এসেও বাংলা দখল করা হল না নরেন্দ্র মোদীর (Narendra Modi)। সব চ্যালেঞ্জ তুড়িতে ওড়ালেন মমতা (Mamata Banerjee)। এবার কি তবে মোদীর সামনে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবেন নেত্রী? ১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখে ফেডেরাল ফ্রন্ট গঠনের লড়াই সামনে এলেও তেমন কোনও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়নি মোদী-শাহদের সামনে। তবে বাংলায় যে ভাবে কার্যত মোদীর মুখোমুখি লড়াই করে জয় এনেছেন মমতা, তাতে সেই লড়াই আরও কিছুটা অক্সিজেন পাবে বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। সম্প্রতি ভ্যাকসিন নিয়ে মমতা যে ভাবে অন্যান্য মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হচ্ছেন, তাতে সেই ধারনাই আরও জোরালো হচ্ছে।

বিক্ষিপ্ত কিছু বিরোধিতা তৈরি হলেও ২০১৯-এ ক্ষমতায় আসতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি নরেন্দ্র মোদীকে। সাম্প্রতিককালে কংগ্রেসও খুব একটা মাথাব্যাথার কারণ হয়ে ওঠেনি শাহ-নাড্ডাদের। কিন্তু বাংলা নিয়ে কেন এত তৎপরতা পদ্ম শিবিরের? চৈত্রের রোদ মথায় নিয়ে কেন প্রত্যেকদিন পথে নামলেন বিজেপির তাবড় নেতা-নেত্রীরা? রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করে, শুধু বাংলায় নয়, কেন্দ্রেও মোদী বিরোধী রাজনীতিক হিসেবে উঠে আসার ক্ষমতা রাখেন মমতা, আর সেটাই সম্ভবত বিজেপির ভয়ের কারণ। আর মমতা বাংলার মসনদে বসেও বারবার ইঙ্গিত দিয়েছেন, মোদী-কে গদিচ্যূত করাই তাঁর লক্ষ্য।

ভ্যাকসিন-যুদ্ধ:

এই মুহূর্তে দেশের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ভ্যাকসিন। প্রথম ডোজ পেয়ে দ্বিতীয় ডোজ পাওয়ার লড়াই, আবার কখনও প্রথম ডোজ পাওয়ার লড়াইও প্রকট হচ্ছে দেশ জুড়ে। রাত থেকে লম্বা লাইন দিয়েও হয়রান হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ভোটের আগে থেকেই তাই ভ্যাকসিন ইস্যু নিয়ে সরব হয়েছেন মমতা। কেন বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে না দেশবাসীকে? কেন বাংলায় আসছে না পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন? এ সব প্রশ্ন বারবার তুলেছেন তিনি। কাউকে সঙ্গে না নিয়ে একাই চিঠি দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদীকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মেলেনি জবাব, তবু ছাড়ার পাত্রী নন তিনি। হিসেব কষে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন কত টাকা খরচ করলে দেশের সব মানুষকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে, আর কেন্দ্রের পক্ষে সেটা সম্ভব কিনা। আর এ বার তিনি একে একে পাশে পাচ্ছেন অন্যান্য মুখ্যমন্ত্রীদের। ইতিমধ্যেই মমতার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কের। দেশের সব মুখ্যমন্ত্রীদের এই ইস্যুতেই চিঠি লিখেছেন, নবীন পট্টনায়ক। আবার, বিজেপি বিরোধী মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি দিয়ে এই ইস্যুতে একজোট হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন। মমতার সঙ্গে কথা হয়েছে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালেরও। এ সবের আগেই বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার দাবি জানিয়ে মোদীকে যে ১৩ জন নেতা চিঠি লিখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সোনিয়া গান্ধী, সীতারাম ইয়েচুরিদের সঙ্গে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মোদীকে কোণঠাসা করতে একজোট হওয়ার এই প্রবণতা অবশ্য প্রথম নয়। বিভিন্ন ইস্যুতে বারে বারে অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের পাশে পেয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। ভ্যাকসিনের জন্য মমতার লড়াইতে মমতা কী সব বিরোধী নেতাদের পাশে পাবেন? সেই উত্তর ভবিষ্যতই বলবে। তবে আবারও একটা ইস্যুতে মমতা যে বিরোধিতার মুখ্য চরিত্র হয়ে উঠছে, সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট।

বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা:

গত ১০ বছর ধরে তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তবে তার থেকেও বেশি সময় ধরে তাঁকে বিরোধী নেত্রী হিসেবে দেখেছে রাজ্য। ৩৪ বছর শাসন চালানো দলকে তিনি যে ভাবে ধরাশায়ী করেছিলেন, তা কার্যত দেশের রাজনীতিতে এক নজির। আর কেন্দ্রের ক্ষেত্রেও তাঁর সেই বিরোধী সত্ত্বা ক্রমশ উন্মোচিত হচ্ছে বলে মনে করেন তাবড় রাজনীতিকরাও। শুধু ভ্যাকসিন নয়, সেই বিরোধী সত্ত্বার লড়াই সামনে এসেছে আগেও। নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলনে তিনি যে ভাবে কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন, তা যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। তাঁর ‘ক্যা…ক্যা…ছিঃ! ছিঃ!’ স্লোগান নিয়ে যতই মস্করা হোক, প্রতিবাদের মঞ্চে যে তিনি নজর কেড়েছিলেন, এ কথা অনস্বীকার্য। অন্য কোনও মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে একজোট হয়ে নয়, মমতা গলার জোরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি একাই এক’শ।

শুধু নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নয়, ক্ষমতায় এসে মোদী সরকার যে সব নীতি নিয়েছে, তার সবকটিতেই আপত্তি জানিয়ে তীব্র বিরোধিতা করেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। একেবারে শুরুর দিকে ‘নোটবন্দি’ ইস্যুতে সরব হন মমতা। ‘নোটবন্দি করে ওরা সম্পত্তি বাড়িয়েছে’, এমন দাবি সবার আগে সামনে আনেন তিনিই। কেজরিওয়ালও নোটবন্দিতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন। সে বারও অবশ্য একজোট হয়ে লড়াই হয়নি। এরপর গত বছর আসে ‘লকডাউন।’ দেশ জুড়ে কড়া বিধি নিষেধ জারি হয় কোভিড নিয়ন্ত্রণে। আর সে ক্ষেত্রে দিন আনা দিন খাওয়া শ্রমিকদের যে সমস্যা পড়তে হয়েছিল তা নিয়েও সরব হন মমতা। কেন্দ্রের জারি করা লকডাউনের তীব্র বিরোধিতা করেন তিনি।

সাম্প্রতিক কালে সবথেকে বড় ইস্যু ছিল কৃষি আইন। সেখানেও দেশ ব্যাপী আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন তিনি। ফেসবুক পোস্টে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘কৃষকদের নিয়ে আমি খুবই উদ্বিগ্ন। কৃষক বিরোধী বিলগুলো প্রত্যাহার করুক কেন্দ্র। যদি তারা তা না করে, তাহলে আমরা রাজ্য ও দেশ জুড়ে অবিলম্বে আন্দোলনে নামব। প্রথম থেকেই আমরা এই কৃষক বিরোধী বিলগুলির বিরোধিতা করে আসছি।’ কে তার পাশে থাকবে সেই অপেক্ষা করেন না মমতা। অনায়াসে দেশ ব্যাপী আন্দোলনের কথা বলেন তিনি।

আলাপন ইস্যু:

শেষ হয়েও শেষ হচ্ছে না আলাপন ইস্যু। মমতার রাজ্যের মুখ্যসচিব মোদীর বৈঠকে উপস্থিত হননি। তার জন্য কেন্দ্র যা ব্যবস্থা নেওয়ার নিয়েছে। দিল্লিতে তলব করা হয়েছে, শোকজও করা হয়েছ অভিজ্ঞ এই আমলাকে। কিন্তু যে ভাবে দেশের প্রথম সারির নেতা-নেত্রীরা আক্রমণ করলেন, রাজনৈতিক মহলের মতে, তাতে ফের একবার বোঝা গেল, তৃণমূল নেত্রীকে মোটেই কম গুরুত্ব দিচ্ছে না তাঁরা। মমতাকে জবাব দিতে ময়দানে নেমে পড়লেন অমিত শাহ, স্মৃতি ইরানি, প্রকাশ জাভড়েকরের মতো রাজনীতিকরা।

#BengaliPrimeMinister

কেন্দ্র যখন আলাপনকে দিল্লিতে তলব করল, তারপরই অবসর নিয়ে নিলেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্ধিত মেয়াদে কাজ করছিলেন তিনি। তাই অবসর আটকাল না। উল্টে মমতা উপদেষ্টা পদে বসালেন অভিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত অফিসারকে। আদতে যে মমতা মোদীর থেকেও বড় চাল দিয়েছেন, তেমনটা মনে করছেন অনেকেই। এ ক্ষেত্রে অন্য দলের নেতাদের সমর্থন পেতে অসুবিধা হয়নি মমতার। পাশে দাঁড়িয়েছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী তথা আপ নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল, সমাজবাদী পার্টিও সমর্থন করেছেন মমতাকে। কংগ্রেসের তরফে বিবৃতি দিয়ে এই ইস্যুতে তৃণমূলের পাশে থাকার বার্তা দেওয়া হয়েছে। আলাপনের প্রশংসা করেছেন অধীর চৌধুরীও। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ, শিব সেনা নেত্রী প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদীর টুইটে স্পষ্ট, আলাপন ইস্যুতে মমতার নৈতিক জয়ে তাঁরা খুশি। আর এরপরই টুইটারে ট্রেন্ডিং #BengaliPrimeMinister, #DidiEbarPMHobe. রাজনৈতিক মহলের ধারণা যদি সত্যি হয়, তাহলে মোদী-শাহদের ভয় কি সত্যি হচ্ছে?

বিরোধী মুখ মমতা?

রাফায়েল দুর্নীতি-সহ একাধিক ইস্যুতে টুকরো টুকরো যে আন্দোলনের কোলাজ তৈরি হচ্ছিল দেশ জুড়ে, সেটাকে যিনি একটা ছবির রূপ দেন তাঁর নাম মমতা। আর সেই ছবি দেখা যায় উনিশের সেই ঐতিহাসিক ব্রিগেডে। যার পোশাকি নাম ‘ইউনাইটেড র‍্যালি।’ হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল, চন্দ্রবাবু নাইডু, দেব গৌড়া, ফারুক আব্দুল্লা, শরদ পাওয়ার, অখিলেশ যাদবরা। সেখানেও মধ্যমণি মমতা। সে দিন জাতীয় রাজনীতিতে এক নতুন নজির গড়ার পুরোধা ছিলেন তৃণমূল নেত্রীই। দিনের পর দিন পথে-প্রান্তরে আন্দোলন করা নেত্রী মমতা এরপর ছুটে গিয়েছিলেন বিভিন্ন রাজ্যে। ব্রিগেডের প্রতিচ্ছবি দেখা গিয়েছিল অন্যান্য রাজ্যেও। তথাকথিত ‘সাবলীল হিন্দি’তে পটু না হলেও, মমতার নেত্রী-সত্ত্বা হোঁচট খায়নি এতটুকু। তবে না, উনিশের নির্বাচনে কোনও প্রভাব পড়েনি। কিন্ত পরবর্তীতে যে ভাবে মমতার সুরে সুর মিলিয়েছেন অখিলেশ-তেজস্বীরা, তাতে এই প্রশ্ন উঠেই যায়, প্রচ্ছন্নভাবে মমতাকেই কি নেত্রী হিসেবে মানতে শুরু করেছেন তাঁরা? মমতার জয়ে যে উচ্ছ্বসিত অভিনন্দনে টুইটার ভরিয়ে দিয়েছেন এই নেতারা।