Sperm Donor in Kolkata: কলকাতাতেও ‘ভিকি ডোনার’! কে, কারা, কেমনভাবে?
Sperm Quality: সামগ্রিকভাবে পরিবেশের পরিবর্তন বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণ। প্রাকৃতিক কারণেই জিনের বদল হচ্ছে। বর্তমানে আমরা যে খাবার খাচ্ছি, যে বাতাসে অক্সিন নিচ্ছি, সেগুলিতে মিশে রয়েছে ভেজাল। তার সঙ্গে তাপমাত্রা বাড়ছে, জেনেটিক কসমেটিক ভেরিয়েশন বাড়ছে- এই সবকিছুর প্রভাব পড়ছে শুক্রাণুকে। এটা এমন একটা কোষ, যেটা একবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে ডিএনএ কোনভাবে মেরামত করা যায় না। ফলে শুক্রাণু কোন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার থেকে নিষিক্ত ডিম্বাণুও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার অনেক সময় ডিম্বাণু নিষিক্ত হয় না।
‘বিয়ের এতদিন পরেও মা হতে পারল না শালি! আঁটকুড়ো নাকি কে জানে! জানি না আর এজম্মে নাতি-নাতনির মুখ দেখব কি না!’ বিয়েবাড়িতে সকলের সামনে শাশুড়ির কাছে এভাবেই ঠোনা শুনতে হল সোমাকে। আর শুনবে না-ই বা কেন! বিয়ের পর ৫ বছর কেটে গিয়েছে। এখনও শাশুড়িকে নাতি-নাতনি উপহার দিতে পারেনি। একে মফস্বলে শ্বশুরবাড়ি, তার উপর পুরানো দিনের মানসিকতা শাশুড়ির। কথা তো শুনতে হবেই!
মা হতে না পারার যন্ত্রণায় সোমাও যেন দিন-দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। সেও কম চেষ্টা তো করছে না! ডাক্তার দেখানো থেকে শাশুড়ির বিশ্বাস মেনে ঠাকুরবাড়ি পর্যন্ত গিয়েছে। কিন্তু, সুরাহা কিছুই হয়নি। তাই ভরা বিয়েবাড়িতে শ্বাশুড়ির এরকম ঠোনা শোনার পর কেবলই মাথা নীচু করে খানিক দূরে চলে গেল সোমা। তবে তার বাঁধ ভাঙল দু-দিন পরে, স্বামীর কাছে বিছানায়।
বিয়েবাড়ি পর্ব শেষ। যে যার নিজের বাড়িতে ফিরেছে। তবে এবারে ভরা বিয়েবাড়িতে শাশুড়ির অমন ঠোনা আর মাসি-শাশুড়ির তির্যক চাউনি যেন কিছুতে ভুলতে পারছে না। কেন মা হতে পারছে না সোমা? সব ডাক্তার তো তাকে মা হওয়ার জন্য একেবারে ফিট তকমা দিয়েছে। সোমার স্বামী প্রবীর থেকে শাশুড়ি বীণাদেবীও নিজের কানে সে কথা শুনেছেন। তাহলে কেন হচ্ছে না? হঠাৎ করেই সোমার মনে পড়ল, কলেজের বন্ধু সৌমেন বলেছিল, একবার তোর বরের ডাক্তারি পরীক্ষা করা। সোমা সেকথা স্বামী-শাশুড়িকে জানিয়েছিল। কিন্তু, কেউ সেকথায় গুরুত্ব দেয়নি। উল্টে একথা বলার জন্য শাশুড়ির কাছে তাকেই কথা শুনতে হয়েছিল। ‘হীরের আংটি কখনও বাঁকা হতে পারে না!’ কিন্তু, এবার সহ্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। এবার প্রবীরকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবেই। রাতে প্রবীর ঘরে ঢুকতেই আর আব্দার-অনুরোধ নয়, একেবারে যেন স্ত্রীর অধিকার দেখাতে শুরু করল সোমা। তার এই রূপ আগে কখনও দেখেনি প্রবীর। বেশ হকচকিয়ে যায়। সে তো নিজেকে ফিট বলেই মনে করে। তাহলে ডাক্তারের কাছে যেতে সমস্যা কোথায়? একেবারে বিস্ফোরক হয়ে উঠল সোমা। তারপরই চিৎকার করে কেঁদে উঠল। সোমাকে একেবারে অসহায় লাগছে। মা হওয়ার জন্য যেন সে পাগল হয়ে গিয়েছে। বাবা হওয়ার তাড়না তারও কম নয়। স্ত্রীর এই রূপ দেখে থাকতে না পেরে অবশেষে রাজি হল। মা-কে না জানিয়েই পরদিন সকালে পুরুষ গায়নোকোলজিস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে সোমাকে সঙ্গে নিয়ে গেল প্রবীর। তারপর যা হওয়ার সেটাই হল!
দু-দিন ধরে প্রবীরের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলল। তারপর পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে প্রবীরের মাথায় কার্যত আকাশ ভেঙে পড়ে। আপাতভাবে ফিট হলেও বাবা হওয়ার জন্য ফিট নয় প্রবীর। ডাক্তারের কথা শুনে বছর ৩৫-এর প্রবীরের মুখ দিয়ে আর কোনও শব্দ বেরোল না। কিন্তু, হাল ছাড়ার পাত্রী নয় সোমা। “তাহলে কি কিছুই করার নেই? এখন তো বিজ্ঞান, মেডিক্যাল সায়েন্স অনেক উন্নত, কোন উপায়ই কি নেই?”- ডাক্তারকে একনাগাড়ে প্রশ্ন করে চলে সোমা। ডাক্তার অবশ্য নিরাশ করেননি। জানালেন, স্পার্ম ডোনারের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
কলেজ পাশ করা বছর ৩০-এর সোমার স্পার্ম ডোনার সম্পর্কে হালকা ধারণা ছিল। ‘ভিকি ডোনার’ সিনেমা কে না দেখেছে! তাই ডাক্তারের কথা শুনে একেবারে যেন চাঁদ হাতে পেল। একদিকে মা হওয়ার বাসনা পূরণ, অন্যদিকে সিনেমার মতোই অবিকল তার জীবন হবে- অ্যাডভেঞ্চারিস্ট সোমা একেবারে লাফিয়ে বলে উঠল, “শীগগির ব্যবস্থা করুন। আমাদের কী করতে হবে বলুন।” যেন অন্ধকারের মধ্যে আলোর দিশা পেয়েছে সোমা। কিন্তু, প্রবীর নিশ্চুপ। স্পার্ম ডোনার? এটা কি মা আদৌ মেনে নেবে? এর মধ্যে তো তার কোনও জিন থাকবে না- এসবই আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল প্রবীর। ডাক্তার অবশ্য তাঁদের ভাবার সময় দিলেন।
‘স্পার্ম ডোনার’- মানে, অন্যের শুক্রাণুতে মা হবে সোমা। এটা যেন সে কিছুতেই মানতে পারছে না। কিন্তু, ‘স্পার্ম ডোনার’ আধুনিক কথা হলেও পারতপক্ষে এই বিষয়ের উল্লেখ তো আমাদের মহাকাব্য, রামায়ণ, মহাভারতেও রয়েছে। বাল্মীকি রামায়ণ অনুসারে, স্বয়ং ভগবান রামচন্দ্রের জন্মও তো এরকমই এক গল্প। বাবা হওয়ার চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হওয়ার পর রাজা দশরথ ঋশ্বশৃঙ্গ মুনির পৌরহিত্যে এক বিশাল যজ্ঞ করেন। যজ্ঞ শেষে অগ্নিদেব স্বয়ং যজ্ঞের আগুনের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসেন এবং তাঁর আশীর্বাদ স্বরূপ এক বাটি পায়েস উপহার দেন। দশরথের তিন রানি সেই পায়েস ভাগ করে খাওয়ার পর তাঁদের গর্ভে পুত্র সন্তান আসে।
আবার মহাভারতে কর্ণ-সহ পাঁচ পাণ্ডবের জন্মও তো কিছুটা এরকমই। কিন্দামার অভিশাপে পান্ডু স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হতে অপারগ হয়ে পড়েন। বাবা হতে না পারা, বংশবিস্তার না হওয়ার আক্ষেপে পান্ডু মর্মাহত হয়ে পড়লে তাঁর প্রথম স্ত্রী কুন্তী ঋষি দুর্বাসার দেওয়া সন্তান জন্মদানের মন্ত্র সম্পর্কে জানান। বিয়ের আগে এই মন্ত্র জপেই তিনি কর্ণের মা হয়েছিলেন। যদিও তখনও তিনি সেটা সমাজে জানাতে পারেননি। পরবর্তীতে স্বামীর অনুমতি নিয়ে কুন্তী একে-একে ধর্মরাজ, ইন্দ্র এবং পবনদেবের ঔরস-আশীর্বাদ নেন এবং যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুনের জন্ম হয়। একইভাবে পান্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রি দেব-চিকিৎসক অশ্বিনী কুমারের কাছে যমজ সন্তানের প্রার্থনা করেন এবং তাঁর ঔরস-আশীর্বাদে জন্ম হয় নকুল ও সহদেবের।
“মহাকাব্য রামায়ণ, মহাভারত যদি এভাবে সন্তান জন্মের কথা উল্লেখ থাকে, তাহলে আমাদের অসুবিধা কোথায়? আর বর্তমান যুগেও এই ধরনের ঘটনা তো এটাই প্রথম হতে যাচ্ছে না।” এবার স্বামীকে সরাসরি প্রশ্ন ছুড়ে দিল সোমা। স্ত্রীর এই প্রশ্ন খণ্ডনের ক্ষমতা ছিল না প্রবীরের। এছাড়া তার দায় সোমা কেন নেবে? সে কী দোষ করেছে? কেন সোমা মা হওয়ার আস্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকবে? কেন তাকে আটকুঁড়ে, বাঁজা অপবাদ নিতে হবে?– এই সব ভেবে অবশেষে সিদ্ধান্ত বদলের সিদ্ধান্ত নিল প্রবীর।
তবে স্পার্ম ডোনার চাইলেই তো পাওয়া যায় না। কারও শুক্রাণু গ্রহণ করার আগে দাতা ও গ্রহীতার বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। অবশেষে এক ডাক্তার বন্ধুর পরামর্শে এক আইভিএফ (In vitro fertilization, IVF) সেন্টারের শরণাপন্ন হল সোমা, প্রবীর। কিন্তু, বিষয়টি জানাজানি হবে না তো? এমন একটা চাপা আতঙ্ক ছিল। অবশেষে তাঁদের আশ্বস্ত করলেন ওই IVF সেন্টারের চিকিৎসক। তিনি জানান, কারও স্পার্ম নেওয়া হলেও একথা সম্পূর্ণ গোপন থাকবে, সন্তানের উপর তার কোনও অধিকার থাকবে না, প্রবীরই হবে আইনত ও সামাজিক বাবা, এমনকি সন্তানকে দেখে যাতে অপরের সন্তান বলে মনে না হয়, সেই বিষয়গুলি বিবেচনা করেই স্পার্ম গ্রহণ করা হয়। এরকমও হয় নাকি? অবাক সুরে প্রশ্ন ছোঁড়ে প্রবীর। জবাবে ওই চিকিৎসক জানান, স্পার্ম ডোনারের নানাবিধ শারীরিক পরীক্ষা, পারিবারিক ইতিহাস জানার পরই তাঁকে স্পার্ম ডোনার হিসাবে যোগ্য বলে বিবেচিত করা হয়।
স্পার্ম ডোনারের যোগ্যতা
মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের বিশিষ্ট চিকিৎসক অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, স্পার্ম নেওয়ার ক্ষেত্রে WHO (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)-র একটি মানদণ্ড রয়েছে। সেই মানদণ্ডের সঙ্গে প্রতিটি বৈশিষ্ট্য মিললে স্পার্ম গ্রহণ করা হয়। স্পার্ম নেওয়ার আগে দাতার নানা শারীরিক পরীক্ষা করা হয়। প্রথমত, স্পার্ম অর্থাৎ শুক্রাণু দান করার আদর্শ বয়স হল, ১৮ বছর থেকে ৩৫-৪০ বছর। শুক্রাণু নেওয়ার আগে দাতার হেপাটাইটিস, HIV, থ্যালাসেমিয়া-সহ নানা রোগের পরীক্ষা করা হয়। এগুলির কোনও একটি থাকলে শুক্রাণু নেওয়া যায় না। এছাড়া ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকলে শুক্রাণু না নেওয়া ভাল। অনেক সময় ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের শুক্রাণু নেওয়া হলেও আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এছাড়া রক্তের গ্রুপ, জিনঘটিত বা পারিবারিক কোনও বিশেষ অসুখের সমস্যা রয়েছে কি না, সব খতিয়ে দেখা হয়। শারীরিক ফিটনেসও দেখা হয়। ডা. বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের কথায়, “সাধারণত হেল্থি স্পার্ম নেওয়া হয়। তার উপরেও গুণগত মানের হেরফের থাকে।” আসলে যে শিশু জন্মাবে, সে যাতে শারীরিকভাবে সুস্থ হয়, তার জন্যই স্পার্ম ডোনার ও স্পার্মের এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।
কেবল শুক্রাণুদাতার থেকে শুক্রাণু গ্রহণ করার মানদণ্ড নয়, গ্রহীতার জন্য ওই শুক্রাণু আদৌ যথাযথ হবে কি না, সেটাও বিবেচনা করা হয়। ডা. বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, দম্পতির গায়ের রং কালো হলে সাধারণ কালো দাতার শুক্রাণু করা হয়। না হলে সামাজিক ক্ষেত্রে দম্পতিকে বা ওই শুক্রাণু থেকে নিষিক্ত হওয়া শিশুকে সামাজিক হেনস্তার মুখে পড়তে হয়। তাই সবদিক খতিয়ে দেখার পরই যে দম্পতির জন্য যে শুক্রাণু যথাযথ মনে হবে, সেটা ধার্য করা হয়। যদিও একটি শুক্রাণুতেই সন্তান নিষিক্ত হবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। তাই ব্যর্থ হলে পুনরায় চেষ্টা করা হয়।
স্পার্ম কোথায়, কীভাবে সংরক্ষিত থাকে?
স্পার্ম ব্যাঙ্কে স্পার্ম গচ্ছিত থাকে। দেশের বিভিন্ন বড়-বড় শহরে, কলকাতাতেও অনেকগুলি স্পার্ম ব্যাঙ্ক রয়েছে। সেখানেই যোগ্য স্পার্ম গচ্ছিত থাকে। ডা. অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, মাইনাস ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তরল অবস্থায় স্পার্ম রাখা থাকে, দীর্ঘদিন এগুলি গচ্ছিত রাখা যায়। এগুলি কায়ো থেরাপিতে রাখা হয়, অর্থাৎ ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। তারপর প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করা হয়।
৯০-এর দশকের গোড়া থেকেই এই প্রক্রিয়া বিদেশে চালু হয়। তারপর ধীরে-ধীরে ভারতেও প্রসার ঘটে। এদেশে প্রথম পশুর মাধ্যমে এই প্রক্রিয়ার পরীক্ষা করা হয়। সাফল্য আসায় পরবর্তীতে মানুষের উপর পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়। সেটা বিফলে যায়নি। নিঃসন্তান দম্পতির মুখে হাসি ফোটাতেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই প্রচেষ্টা। ‘স্পার্ম ডোনারের চাহিদা আগামী দিনে আরও বাড়বে’ বলে অনেক আগেই কার্যত ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন IVF বিশেষজ্ঞ ডা. গৌতম খাস্তগীর। তাঁর সেই অনুমান ভুল ছিল না। যত দিন যাচ্ছে মহিলার সঙ্গে পুরুষ বন্ধ্যাত্বের হারও বাড়ছে। অর্থাৎ শুক্রাণুর মান ভাল হচ্ছে না। যার ফলে সন্তান উৎপাদন হচ্ছে না। ফলে স্পার্ম ডোনারের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু, প্রবীর তো ধূমপান করে না। মদ্যপানও করে হয়তো বছরে হাতে গুনে ১-২ বার। কোনও শারীরিক সমস্যা বা অসুখও নেই। তাহলে কেন তিনি বাবা হতে পারবেন না? কেন তিনি বন্ধ্যাত্বের শিকার? প্রবীরের চোখে-মুখে যেন এই সমস্ত প্রশ্ন জেগে ওঠে।
পুরুষ বন্ধ্যাত্বের হার কেন বাড়ছে? শুক্রাণুর মান কেন খারাপ হচ্ছে?
কেবল আধুনিক জীবনযাপন অর্থাৎ মদ্যপান বা ধূমপান বন্ধ্যাত্বের কারণ নয়, আরও অনেক কারণ রয়েছে বলে জানান মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানান, সামগ্রিকভাবে পরিবেশের পরিবর্তন বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণ। প্রাকৃতিক কারণেই জিনের বদল হচ্ছে। বর্তমানে আমরা যে খাবার খাচ্ছি, যে বাতাসে অক্সিন নিচ্ছি, সেগুলিতে মিশে রয়েছে ভেজাল। তার সঙ্গে তাপমাত্রা বাড়ছে, জেনেটিক কসমেটিক ভেরিয়েশন বাড়ছে- এই সবকিছুর প্রভাব পড়ছে শুক্রাণুকে। এটা এমন একটা কোষ, যেটা একবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে ডিএনএ কোনভাবে মেরামত করা যায় না। ফলে শুক্রাণু কোন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার থেকে নিষিক্ত ডিম্বাণুও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার অনেক সময় ডিম্বাণু নিষিক্ত হয় না। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পুরুষদের মধ্যে টেস্টোস্টেরন হরমোনের হার কমছে। শুক্রাণুর মান ভাল তো হয়নি, বরং ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। ফলে পুরুষদের মধ্যে বন্ধ্যাত্বের হার বাড়ছে।
স্পার্ম ডোনার প্রতি শুক্রাণুর জন্য কী দাম পান?
বন্ধ্যাত্বের তকমা ঘোচাতেই আজকাল সন্তানহীন দম্পতি দ্বারস্থ হচ্ছেন বর্তমান চিকিৎসা পদ্ধতি IVF- এর। কলকাতা-সহ দেশের বড়-বড় শহরে একাধিক IVF সেন্টার রয়েছে। এই কেন্দ্রগুলি টেস্টটিউব বেবি, সারোগেসি মাদার থেকে স্পার্ম ডোনারের মাধ্যমে সন্তানহীন দম্পতিদের কোলে সন্তান তুলে দেয়। নিঃসন্তান দম্পতির বাবা, মা হওয়ার সাধ পূরণ করে। আর পুরো প্রক্রিয়াটাই হয় সরকারিভাবে। যদিও দম্পতি থেকে চিকিৎসক, কেউই স্পার্ম ডোনারের পরিচয় জানতে পারেন না। এমনকি স্পার্ম ডোনারও জানতে পারেন না, তাঁর শুক্রাণু কার গর্ভে নিষিক্ত হচ্ছে। পুরোটাই নথিভুক্ত হয় স্পার্ম ব্যাঙ্কের মাধ্যমে এবং সবকিছু গোপন থাকে। একমাত্র কোনও কারণে কারও বিষয়ে আদালত জানতে চাইলে তখনই বিষয়টি প্রকাশ্যে আসবে। শুক্রাণুদাতা অবশ্য তাঁর শুক্রাণু পরিবর্তে টাকা পান। সাধারণত, প্রতি শুক্রাণুর জন্য ১০-২০ হাজার টাকা দিতে হয় দম্পতিকে। তবে পুরো প্রক্রিয়াটির জন্য খরচ লক্ষাধিক টাকা। অনেকে আবার সামাজিক কাজ হিসাবে শুক্রাণু দান করে। স্পার্ম নেওয়ার সময় দাতার যেমন একাধিক শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, তেমনই গ্রহীতারও একাধিক শারীরিক পরীক্ষা করা হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কেবল নিঃসন্তান দম্পতি নয়, একক মহিলা এবং সমকামী দম্পতিরাও স্পার্ম ডোনারের মাধ্যমে সন্তানের আস্বাদ পায়। কলকাতায় IVF-এর মাধ্যমে সন্তান উৎপাদনের সাফল্যের হার প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ বলে জানা গিয়েছে।
কলকাতায় গত কয়েক বছরে ডোনেটেড স্পার্মের চাহিদা বেড়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ফার্টিলিটি সেন্টারে শুক্রাণুর নমুনা সরবরাহকারী সোহম বন্দ্যোপাধ্যায় (নাম পরিবর্তিত)। তিনি ভিন রাজ্যের বিভিন্ন স্পার্ম ব্যাঙ্ক থেকে শুক্রাণুর নমুনা কলকাতার বিভিন্ন IVF সেন্টারে সরবরাহ করেন। অর্থাৎ চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন রাজ্যের স্পার্ম ব্যাঙ্কগুলি থেকেও শুক্রাণু আমদানি-রফতানি হয়।
বিদেশের সঙ্গে ভারতের স্পার্ম নেওয়ার প্রক্রিয়ার প্রভেদ
সুজিত সরকার পরিচালিত ও আয়ুষ্মান খুরানা অভিনীত ‘ভিকি ডোনার’ সিনেমায় দেখানো হয়েছিলেন, সিনেমার নায়ক তথা স্পার্ম ডোনার ভিকি মোট ৫৩টি সন্তানের বাবা। অর্থাৎ তাঁর শুক্রাণু থেকে ৫৩টি শিশুর জন্ম হয়েছে। বাস্তবে, অন্তত এদেশে সাধারণত এরকমটা হয় না বলেই জানান ডা. বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও বিদেশে এরকম বহু নজির রয়েছে। একজনের শুক্রাণু থেকে একাধিক শিশু জন্ম নেওয়ার অনেক খবর রয়েছে। আবার কারও স্পার্ম গুণগত মানে সেরা হলে তিনি নিজেই বাড়িতে স্পার্ম ব্যাঙ্ক করে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন এবং ভিন দেশ থেকেও বহু নিঃসন্তান দম্পতি তার থেকে স্পার্ম নিয়ে সন্তানের স্বাদ নেন- এরকম নজিরও বিদেশে রয়েছে। ভারতে অবশ্য এই ধরনের ঘটনা বেআইনি। এখানে একজন কতবার স্পার্ম দিতে পারবে এবং তার স্পার্ম থেকে কতগুলি সন্তান নিষিক্ত করা হবে, তার নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। গোটা প্রক্রিয়াটি সরকারিভাবে পরিচালিত হয় এবং এর জন্য বিশেষ আইন রয়েছে।
গোটা বিষয়টি জানার পর অবশ্য অনেকটাই আশ্বস্ত হয় প্রবীর। মনের যাবতীয় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে বন্ধ্যাত্ব তকমা ঘুচিয়ে সন্তানের আস্বাদ পেতে ডোনেটেড স্পার্মের সাহায্য নেওয়ার অনুমতি দেয় প্রবীর। হাসি ফোটে সোমার মুখে। তার গর্ভে বেড়ে উঠবে সন্তান, মা হবে সোমা। আর কেউ তাকে আঁটকুড়ে, বাঁজা বলে গালি দেবে না। আর এখানেই তো আধুনিক চিকিৎসার সাফল্য।