TV9 Explained: সন্দেশখালিতে ঠিক কী হয়েছে, কেন হয়েছে? জেনে নিন, এক ক্লিকে
TV9 Explained-Sandeshkhali: কান পাতলেই শোনা যায়, সন্দেশখালিতে একটা পাতাও নড়ত না এই শাহজাহানের ইশারা ছাড়া। বাম আমলে তাঁর উত্থানের কাহিনিও অনেকেরই জানা। যাঁরা সে দিন ইডি-কে আঘাত করেছিলেন, তাঁরা নাকি শাহজাহানেরই অনুগামী। আর আজ সেই শাহজাহানে দিকেই আঙুল তুলছেন ওই গ্রামের মানুষজন।
কলকাতা: ইডি-সিবিআইয়ের তল্লাশি অভিযান। কোটি কোটি টাকা উদ্ধার। রাজ্যবাসী গত ২ বছরে এই ছবি একাধিকবার দেখেছেন। কিন্তু ২০২৪-এর শুরুতেই যে ঘটনা ঘটে, তার নজির এ রাজ্যে প্রায় নেই বললেই চলে। তথাকথিত প্রভাবশালী নেতার গ্রেফতারিও দেখেছে রাজ্যের মানুষ, কিন্তু লাঠির আঘাতে কেন্দ্রীয় সংস্থার অফিসারের মাথা ফেটে গলগল করে বেরচ্ছে রক্ত! বলিউডের ছবিতে এমন দৃশ্য দেখা গিয়েছে বটে, তবে উত্তর ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এক স্বল্প চেনা নেতার গ্রেফতারি ঘিরে এমন ‘রণক্ষেত্র’ প্রত্যাশিত ছিল না। গত ৫ জানুয়ারি সন্দেশখালির সেই ঘটনা নেহাতই রাজ্যের একটা ‘ইনসিডেন্ট’ হয়ে থেকে গেল না। দেড় মাস পরও বাংলায় শিরোনাম জুড়ে ‘সন্দেশখালি’। সিনেমার মতোই বদলাচ্ছে ‘প্লট’, ‘সাসপেন্স’ থেকে ‘অ্যাকশন’ সবই মজুত আছে। বোধ হয় শুধু ক্লাইম্যাক্সটাই বাকি!
৫ জানুয়ারি কী ঘটেছিল?
সাত সকালে সিজিও কমপ্লেক্স থেকে গাড়ি নিয়ে বেরোন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের আধিকারিকরা। তারপর বাসন্তী হাইওয়ে ধরে গাড়ি সোজা চলে যায় উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালি। পৌঁছে যায় তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানের বাড়িতে। রেশন দুর্নীতির তদন্তে সে দিন আরও বেশ কিছু জায়গায় তল্লাশি চালানো হচ্ছিল। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সব চোখ চলে যায় সন্দেশখালির দিকে।
ইডি আধিকারিকরা দাবি করেন, পেল্লায় বাড়ির গেটে তালা দেওয়া দেখলেও তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে ভিতরেই আছেন শেখ শাহজাহান। তাঁর ফোনও ‘ব্যস্ত’ ছিল। তালা ভেঙে যখন ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা চলছে, সেই সময় পিছন থেকে তেড়ে আসে একদল লোক। হাতে লাঠি নিয়ে সেদিন ছিলেন মহিলারাও। তারপর অফিসারদের ওপর চলে আঘাতের পর আঘাত। সিআরপিএফ জওয়ানরাও তখন নিরুপায় দর্শক। ভেঙে দেওয়া হয় তাদের গাড়ি। কোনও ক্রমে পালিয়ে বাঁচেন ইডি অফিসারেরা।
কোথায় গেলেন শাহজাহান?
মন্ত্রী নন, বিধায়ক নন, শেখ শাহজাহান হলেন জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ। তাঁর এত প্রতাপ তবে? এ তো আসলে নেহাতই একটা পদ। কান পাতলেই শোনা যায়, সন্দেশখালিতে একটা পাতাও নড়ত না এই শাহজাহানের ইশারা ছাড়া। বাম আমলে তাঁর উত্থানের কাহিনিও অনেকেরই জানা। যাঁরা সে দিন ইডি-কে আঘাত করেছিলেন, তাঁরা নাকি শাহজাহানেরই অনুগামী। তবে ঘটনার পরের দিন থেকে একটাই প্রশ্ন সামনে আসে, কোথায় শাহজাহান? একটা জলজ্যন্ত লোক উধাও হয়ে গেলেন গ্রাম থেকে! জানতেও পারল না পুলিশ? ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতেও নেই কোনও খোঁজ।
কেন রেশন দুর্নীতির তদন্তে শাহজাহানকে চায় ইডি?
‘টাকার প্রয়োজন পড়লে ডাকু আর শাহজাহানের কাছে যাস’-একটি চিঠিতে লেখা ছিল এই লাইনটি। ইডি-র দাবি, সেই চিঠি মেয়েকে লিখেছিলেন জেল হেফাজতে থাকা রাজ্যের বনমন্ত্রী তথা প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ওরফে বালু। চিঠিতে থাকা ডাকু আসলে তৃণমূল নেতা শঙ্কর আঢ্য বলেই দাবি করে ইডি। ইতিমধ্যেই গ্রেফতার হয়েছেন সেই শঙ্কর। শাহজাহানকে ডেকে তাই তদন্তের বৃত্ত সম্পূর্ণ করতে চান তদন্তকারীরা। নোটিসের পর নোটিস দেওয়া হচ্ছে শাহজাহানকে। হাজিরা দিচ্ছেন না কোনওমতেই।
২৪ ঘণ্টা পর শোনা যায় কণ্ঠস্বর
শাহজাহান ‘উধাও’ হয়ে যাওয়ার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর প্রকাশ্যে আসে একটি কল রেকর্ড, যেটি শেখ শাহজাহানের বলে দাবি করা হয়। আড়াল থেকে তিনি বার্তা দেন, তৃণমূলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্যই কেউ এমন ষড়যন্ত্র করছে। এতে বিচলিত না হতে বলেন কর্মীদের।
তিন খানা মামলা হয় ঘটনার পর
সন্দেশখালির ঘটনায় মোট তিনটি মামলা রুজু হয়েছিল সন্দেশখালির ন্যাজাট থানায়। তার মধ্যে একটি এফআইআর দায়ের করেন ইডি আধিকারিকরা। স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে একটি মামলা রুজু করে পুলিশ। আর তৃতীয় এফআইআর-টি করেন শাহজাহানে বাড়ির কেয়ারটেকার। চুরির অভিযোগ ওঠে ইডি অফিসারদের বিরুদ্ধে।
হাইকোর্টে যায় ইডি
মার খেয়েছেন অফিসাররা। নালিশ যায় দিল্লিতেও। সন্দেশখালির জেরে বদলে যায় এ রাজ্যে সিআরপিএফ-এর সাজসজ্জা। অভিযানে যাওয়ার আগে বিশেষ হেলমেট, ঢাল নিয়ে এখন ময়দানে নামছে সিআরপিএফ। ঘটনার পর মামলা হয় হাইকোর্টে। ঘটনার পর ইডি-র বিরুদ্ধেই মামলা হল কেন? সেই প্রশ্ন ওঠে এজলাসে। পুলিশকে ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয় আদালতে। এরপর সিবিআই এবং রাজ্য পুলিশের এসপি পদমর্যাদার আধিকারিকদের নিয়ে সিট গঠন করে দেয় আদালত।
৩৪ দিন পর নাটকীয় মোড়
কেউ বলেন শাহজাহান আছেন সন্দেশখালিতেই, ঘুরে বেড়াচ্ছেন পুলিশের নাকের ডগায়। কেউ বলেন, এক বিচ্ছিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন শাহজাহান। এদিকে সন্দেশখালির আনাচ-কানাচ থেকে উঠে আসতে থাকে তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তির গল্প। শাসক দলে যে তাঁর বেশ কদর ছিল, তেমন কথাও শোনা যায়। কিন্তু ঠিক এক সপ্তাহ আগে নতুন মোড় নেয় সন্দেশখালির পরিস্থিতি। যে সব কথা এতদিন কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছিল, তা প্রকাশ্য়ে আসতে শুরু করে। কেড়ে নিয়েছে জমি, সর্বনাশ করেছে গোটা পরিবারের… এমন সব অভিযোগ যেন ছাই চাপা ছিল এতদিন। একজন, দুজন নয়, গ্রামের বাড়ি বাড়ি থেকে মহিলারা বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। তাঁদের হাতে লাঠি, গাছের ডাল।
কী অভিযোগ মহিলাদের?
সন্দেশখালি বলছে, কেড়ে নেওয়া হত জমি। দিতে না চাইলে জোর করা হত। রাত হলে বাড়ির মহিলাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হত পার্টি অফিসে। রাতভর রেখে ভোরে ছেড়ে দেওয়া হত। কথা না শুনলে বন্ধ করে দেওয়া হত সরকারি পরিষেবা। অকথ্য অত্যাচার চলত। পুলিশের কাছে গেলে পুলিশ অভিযোগ নিত না। বিডিও অফিসে গিয়েও কোনও লাভ হত না। এভাবেই দমবন্ধ করে বেঁচে ছিল সন্দেশখালি? তাঁদের নিশানায় শাহজাহানের সঙ্গে উঠে এসেছে আরও দুটি নাম- উত্তর সর্দার আর শিবু হাজরা।
জ্বলতে শুরু করে সন্দেশখালি
আক্ষরিক অর্থেই আগুনে পুড়তে শুরু করে সন্দেশখালি। ক্ষুব্ধ জনতা আগুন জ্বালিয়ে দেয় শিবু হাজরার পোলট্রি ফার্মে। বাগানবাড়িতে গিয়ে ভাঙচুর চালাতে শুরু করে। পুলিশও হিমশিম খেয়ে যায় তা সামলাতে। আক্রান্ত হতে হয় সংবাদমাধ্যমকে। TV9 বাংলার প্রতিনিধিকে আঘাত করা হয়। ভেঙে দেওয়া হয় ক্যামেরা। যাঁরা আঘাত করেন, তাঁরা শিবুর সাগরেদ বলেই অভিযোগ।
ধরা পড়ে উত্তম, বেপাত্তা শিবু
উত্তপ্ত পরিস্থিতির মাঝে জেলা পরিষদের সদস্য উত্তম সর্দারকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁকে সাসপেন্ড করে তৃণমূল। কিন্তু জেলিয়াখালি গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য শিবুর খোঁজ নেই। শাহজাহানের মতোই তিনিও উধাও! এদিকে, অশান্তিতে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হন বিজেপি নেতা বিকাশ সিংহ, গ্রেফতার হন সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক নিরাপদ সর্দার। প্রতিবাদে সন্দেশখালিতে বনধের ডাক দেয় সিপিএম।
রাজ্যপালের সন্দেশখালি সফর
অশান্তির আবহে ১৪৪ ধারা জারি করা হয় সন্দেশখালি জুড়ে। বিরোধীরা ঢুকতে চাইলে আটকে দেওয়া হয় তাঁদের। এরই মধ্যে সন্দেশখালি পরিদর্শনে যান রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। মহিলাদের মুখ থেকে তাঁদের সব অভিযোগও শোনেন।
অভিযুক্তরা সবাই গ্রেফতার হয়েছে, বললেন মুখ্যমন্ত্রী
শাহজাহান অস্বস্তির মাঝে তৃণমূলের নেতারা দু-চার কথা বললেও তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। তবে উত্তমদের ধরপাকড়ের পর মমতা বলেন, যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁদের সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
শোনা হল সন্দেশখালির কথা
সিআইডি-র ডিআইজি সোমা দাস মিত্র দায়িত্ব পেয়েছেন সন্দেশখালির মহিলাদের সঙ্গে কথা বলার। তৈরি হয়েছে বিশেষ টিম। কথা বলে চারটে লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন তিনি। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে কথা শোনেন তাঁরা। জাতীয় মহিলা কমিশন ও রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রতিনিধিরাও যান সন্দেশখালিতে। রাজ্য মহিলা কমিশনের দাবি, তাঁদের কাছে ধর্ষণের অভিযোগ জানাননি কেউ। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় মহিলা কমিশনের দাবি, যে মহিলারা অভিযোগ জানাচ্ছেন, তাঁদের আত্মীয়দের বিরুদ্ধেই অভিযোগ দায়ের হচ্ছে।
কী বলছে আদালত?
হাইকোর্ট বলছে, অভিযোগ খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। যাঁদের বিরুদ্ধে এই মহিলারা ধর্ষণের এবং জমি দখলের অভিযোগ করছেন? তাঁদের কী হল, সেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে রাজ্যকে। মানুষের মনে যে আস্থা ফিরছে না, সে কথাও উল্লেখ করেছে আদালত।
তপ্ত হচ্ছে রাজনীতি
সন্দেশখালি ইস্যুকে সামনে রেখে ময়দানে নেমে পড়েছে বিরোধীরা। সন্দেশখালিতে ঢুকতে না পেরে বসিরহাটে বিক্ষোভ দেখায় বিজেপি। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে রীতিমতো রণক্ষেত্রের পরিস্থিতি তৈরি হয়। রাতেও অবস্থানে অনড় ছিলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। মঙ্গলবার রাতে তাঁদের আটকও করা হয়। সরব হয়েছে সিপিএম। সন্দেশখালিতে বনধ ডাকার পাশাপাশি, দোষীদের গ্রেফতারির দাবি তুলছে তারা।
এবার আসরে তৃণমূল, সন্দেশখালিতেও ‘খেলা হবে’?
মঙ্গলবার হাইকোর্টের নির্দেশে সন্দেশখালি থেকে ১৪৪ ধারা তুলে নেওয়া হয়। এরপরই আসরে নামে তৃণমূল। রাতেই সেখানে পৌঁছে যান তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিক। সেখানে গিয়েই বলেন, ‘খেলা হবে’। এতকিছুর পরও মানুষ যে তৃণমূলের সঙ্গেই আছে, সে কথা বোঝাতে মরিয়া শাসক শিবির। ১৮ ফেব্রুয়ারি ৬ মন্ত্রী সভা করবেন সন্দেশখালিতে। সেই ঘোষণাও করে এসেছেন পার্থ ভৌমিক। তাঁর দাবি, ভেড়ির টাকা যাঁরা পাননি বলে অভিযোগ, তাঁদের দায়িত্ব নিয়ে টাকা দিয়ে দেবে তৃণমূল।
আর সন্দেশখালির মা-বোনেরা? পার্থ ভৌমিক বলছেন, ১৮ তারিখের সভায় সামনের সারিতে রাখা হবে মা-বোনদের। বুঝিয়ে দেওয়া হবে, মমতার রাজ্যে মা-বোনেদের কোনও অসম্মান হয় না। তবে এই আগুনের আঁচ যে এখনই নেভার নয়, সেটা বেশ আন্দাজ করা যাচ্ছে।