বিশ্লেষণ: মুকুল রায়কে দলত্যাগ বিরোধী আইনে ‘শাস্তি’ দিতে পারেন শুভেন্দু? কী বলছে সংবিধান…

আইন কার্যকর হলে কী হবে, কী ভাবেই বা সেই আইন কার্যকর সম্ভব? এই প্রশ্নগুলি ওঠার আগে এই আইনের সাত সতেরো বুঝে নেওয়া প্রয়োজন।

বিশ্লেষণ: মুকুল রায়কে দলত্যাগ বিরোধী আইনে 'শাস্তি' দিতে পারেন শুভেন্দু? কী বলছে সংবিধান...
অলংকরণ- অভীক দেবনাথ
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Jun 17, 2021 | 1:47 PM

“দলত্যাগ বিরোধী আইনটা আমার খুব ভালভাবে জানা আছে।” বিজেপিতে ৩ বছর ৯ মাস কাটিয়ে মুকুল রায় তৃণমূলে আসার পর ঠিক এই ভাষাতেই তাঁকে শাসিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। সেই প্রতিধ্বনি আজ শোনা গিয়েছে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের কণ্ঠে। তিনিও বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গে ওই আইন পুরোদমে কার্যকর করা হবে”। যদিও পশ্চিমবঙ্গে সেই আইন কার্যকর করার নজির সাম্প্রতিক অতীতে নেই। আইন কার্যকর হলে কী হবে, কী ভাবেই বা সেই আইন কার্যকর সম্ভব? এই প্রশ্নগুলি ওঠার আগে এই আইনের সাত সতেরো বুঝে নেওয়া প্রয়োজন।

কী ভাবে এই আইনের উৎপত্তি?

১৯৮৫ সালে সংবিধানে ৫২তম সংশোধনের মাধ্যমে এই আইন আনা হয়। আইনটি ভারতে কার্যকর হয় ১৯৮৫ সালের ১ মার্চ থেকে। ভারতীয় রাজনীতিতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে এই আইন আনা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর আমলে রাজনীতির ময়দানে অহরহ দলত্যাগ রুখতেই এই আইন আনা হয়। অধুনা রাজনীতিতে এই প্রবণতার আধিক্য লক্ষ্য করা গেলেও এই শুরুটা বহু আগেই হয়েছিল। ১৯৬৭ সালে একবার হরিয়ানার এক বিধায়ক মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ৩ বার দল পরিবর্তন করেছিলেন। তারপর থেকেই দল বদলে ফেলার মানসিকতা সম্পন্ন এই রাজনীতিকদের ‘আয়ারাম গয়ারাম’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। একই সঙ্গে এহেন দলীয় কার্যকলাপ বিরোধী আইন নিয়ে আসার প্রয়োজন অনুভূত হয়।

কখন কার্যকর হয় দলত্যাগ বিরোধী আইন?

দলত্যাগ বিরোধী আইন অনুযায়ী, একাধিক পরিস্থিতিতে আইনসভার (লোকসভা/রাজ্যসভা/বিধানসভা) কোনও সদস্যের বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগ করা যেতে পারে। যদি কোনও সদস্য নিজের ইচ্ছায় দলত্যাগ করেন, তখন এই আইনের সাহায্যে তাঁর সদস্যতা বাতিল করা সম্ভব। এ বাদে তিনি যদি দলের হুইপ অমান্য করে ভোটদান থেকে বিরত থাকেন, বা অন্য কোথাও ভোট দেন, তখনও এই আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সদস্যতা বাতিল করা যায়। তবে প্রত্যেক ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার স্পিকারের হাতে থাকে।

অলংকরণ: অভীক দেবনাথ

আরও পড়ুন: তমলুক থেকে বন্দুক, গুলি-সহ গ্রেফতার ‘শুভেন্দু-ঘনিষ্ঠ’ আরমান ভোলা

তবে এই আইনের ক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রমও ছিল। যদি কোনও দলের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যই অন্য একটি দলে যোগ দেন, সেই সময় তাঁদের সদস্যতা বাতিল করা যাবে না। অন্যদিকে প্রথম দলে বাকি যারা রয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা আগের মতোই সেই দলে থেকে কাজ করে যেতে পারবেন। নিয়ম ছিল এমনটাই।

কিন্তু ২০০৩ সালে তৎকালীন অটল বিহারী বাজপেয়ী সরকারের আমলে এই আইনে কিছু বদল আনা হয়। সংশোধনের মাধ্যমে বলা হয়, আইনসভার কোনও সদস্যের বিরুদ্ধে দলত্যাগের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁরও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। অর্থাৎ যে আইন দুই তৃতীয়াংশ দলত্যাগীদের সুরক্ষিত করছিল, সেটা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

কী ভাবে এই আইনের কোপ এড়ানো সম্ভব?

দল ছাড়লেও দলত্যাগ বিরোধী আইনের কোপে পড়ার থেকে থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব। আইন সভার কোনও সদস্যকে দলত্যাগ বিরোধী আইনের জাল এড়াতে হলে সবার প্রথম তাঁকে নিজের দলের সদস্যতা ছাড়তে হবে। একই সঙ্গে তিনি যদিও কোনও সরকারি পদে থাকেন সেখান থেকেও তাঁকে ইস্তফা দিতে হবে। তারপরই তিনি নিজের পছন্দসই অন্য কোনও দলে নাম লেখাতে পারেন। এই নিয়মগুলি পালন করলে আইনসভার সেই সদস্যের বিরুদ্ধে দলত্যাগ বিরোধী আইন কার্যকর করা যাবে না।

মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে কি এই আইন খাটে?

আরও পড়ুন: মুকুলকে ২৪ ঘণ্টা সময় দিলেন শুভেন্দু, বিধায়ক পদ না ছাড়লে কঠোর পদক্ষেপ

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, যেহেতু মুকুল রায় বিজেপির সদস্যতা পদ এবং বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা না দিয়েই তৃণমূলে নাম লিখিয়েছেন, সেই কারণে তাঁর বিরুদ্ধে এই আইন প্রণয়ন করার আবেদন বিধানসভার স্পিকারের কাছে জানাতে পারে বিজেপি। ঠিক যেভাবে শিশির অধিকারী বা সুনীল মণ্ডলের সাংসদ পদ বাতিলের আবেদন লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার কাছে জানিয়েছে তৃণমূল। তবে আবেদন জানানোর পর স্পিকার কী করবেন, তা একান্তই তাঁর সিদ্ধান্ত। কারণ এই আইন প্রয়োগের সিদ্ধান্ত একমাত্র নিতে পারেন স্পিকার। কত দিনের মধ্যে তিনি সেই সিদ্ধান্ত নেবেন, তার কোনও সময়সীমাও বেঁধে দেয়নি সংবিধান।

ভবিষ্যতে আইন প্রয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে ইতিহাস কী বলছে?

আইনজ্ঞরা বলছেন, বিজেপি যতই এই আইন কার্যকর করতে রাজ্যপালের দ্বারস্থ হোক না কেন, বাস্তবে রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানের এই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কোনও ভূমিকা নেই, এটাই রূঢ় বাস্তব। এ ক্ষেত্রে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, এ রাজ্যে অতীতে দলত্যাগ বিরোধী আইন কার্যকর করার নজির খুব একটা নেই। কারণ পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক প্রতীক বদল করতে কয়েক বছর আগেও বিশেষ দেখা যায়নি। কিন্তু ২০১১ সালের পর এই প্রথায় ছেদ পড়ে। ঝাঁকে ঝাঁকে তৃণমূলে নাম লেখাতে শুরু করেন কংগ্রেসের বিধায়ক।

একই প্রথা অব্যাহত থাকে ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের পরও। ফলস্বরূপ দলত্যাগ বিরোধী আইন কার্যকর করতে বহু আবেদন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে জানান তৎকালীন বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান। কিন্তু সেগুলি বস্তুত ফেলে রাখা হয়েছে, স্পিকার কোনও পদক্ষেপই করেননি বলে দাবি করে তখনকার বিরোধীরা। ফলে এ বারও বিরোধীরা যতই দাবি তুলুক না কেন, এই আইন কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা উজ্জ্বল বলে মনে করছেন না বাংলার রাজনীতিক কারবারিরা।

আরও পড়ুন: ‘উত্তরবঙ্গকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করবে? বাংলাকে পরাধীন হতে দেব না’, হুঙ্কার মমতার