Neelkanth: দশমীতে আর ওড়ানো হয় না নীলকণ্ঠ পাখি, এই প্রথার কেন প্রচলিত ছিল, কেনই বা বন্ধ হল জানেন?
দশমীর দিন নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর প্রথাটি এক সময় বাঙালির সংস্কৃতিতে গভীর ভাবে জড়িয়ে ছিল। এর নেপথ্যে ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস, ঐতিহ্য এবং কিছু সামাজিক ধারণা। যত দিন এগিয়েছে, এই প্রথা বন্ধ হয়েছে। কারণ জানেন?

পুজোর শেষ দিন, অর্থাৎ দশমীর বিষাদের সুর যখন বাজতে শুরু করত, তখন এক বিশেষ ঐতিহ্য জড়িয়ে থাকত কলকাতার বনেদি বাড়িগুলোর রীতিনীতিতে। এই প্রথার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল একটি বিশেষ পাখি। যার পোশাকি নাম ‘ইন্ডিয়ান রোলার’, আর আদরের নাম নীলকণ্ঠ। দশমীর দিন নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর প্রথাটি এক সময় বাঙালির সংস্কৃতিতে গভীর ভাবে জড়িয়ে ছিল। এর নেপথ্যে ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস, ঐতিহ্য এবং কিছু সামাজিক ধারণা। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিষ্ঠুরতা ও পরিবেশগত কারণে এই প্রথাটি বন্ধ হয়ে গেছে।
নীলকণ্ঠ পাখি কেন ওড়ানো হত?
নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর প্রথার নেপথ্যে প্রধানত দুটি কারণ ছিল—
১. দেবীকে কৈলাসে ফেরার বার্তা বহন: ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, নীলকণ্ঠ পাখিকে শিবের প্রতিনিধি বা দূত হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশ্বাস করা হত যে, দশমীর দিনে যখন দেবী দুর্গা কৈলাসে স্বামী শিবের কাছে ফিরে যান, তখন এই নীলকণ্ঠ পাখিটিকে উড়িয়ে দিলে সেটি সরাসরি কৈলাসে উড়ে গিয়ে শিবকে দেবীর আগমন বার্তা পৌঁছে দেবে। এই বার্তাটিই ছিল দেবীকে বিদায় জানানোর একটি প্রতীকী আচার।
২. শুভ যাত্রা ও বিজয় ঘোষণা: রামায়ণ অনুসারে, রামচন্দ্র রাবণকে বধ করতে যাওয়ার আগে এই নীলকণ্ঠ পাখিকে দেখেছিলেন, যা বিজয় এবং শুভ যাত্রার প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়েছিল। তাই দশমীর দিনে এই পাখিটিকে উড়িয়ে শুভ কামনা করা হত।
কেন এই প্রথা বন্ধ হয়ে গেল?
নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর এই প্রথাটি নব্বইয়ের দশকের শেষের দিক থেকে কঠোরভাবে বন্ধ হতে শুরু করে এবং বর্তমানে এটি প্রায় বিলুপ্ত। এর প্রধান কারণগুলো হল:
১. পাখির প্রতি নিষ্ঠুরতা: এই প্রথার জন্য পুজোর কয়েক দিন আগে থেকে পাখি শিকারিরা পাখিগুলোকে ধরে খাঁচায় বন্দি করত। দশমীর দিনে বিক্রি করার আগে তাদের খাবার-জল কম দেওয়া হত। বন্দি থাকার কারণে অনেক পাখি দুর্বল হয়ে যেত এবং ওড়ার পর মারা যেত। এটি প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা হিসেবে বিবেচিত হয়।
২. পরিবেশগত ও আইনি নিষেধাজ্ঞা: নীলকণ্ঠ পাখি, যার বৈজ্ঞানিক নাম Coracias benghalensis, এটি বর্তমানে ভারতের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন, ১৯৭২ (Wildlife Protection Act, 1972) এর অধীনে সুরক্ষিত। এই পাখি ধরা, বন্দি করা বা কেনা-বেচা করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। বন্যপ্রাণী ও পরিবেশপ্রেমী সংস্থাগুলোর প্রতিবাদ এবং সরকারি পদক্ষেপের ফলেই এই প্রথা বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
৩. প্রজাতির সংখ্যা হ্রাস: অবাধ শিকারের ফলে একসময় এই পাখির সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে যেতে শুরু করে। পরিবেশবিদদের পক্ষ থেকে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরার পর এই প্রথা বন্ধে জোরাল আন্দোলন শুরু হয়।
এইভাবে, ধর্মীয় বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও, প্রাণী সুরক্ষা এবং পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর প্রথাটি আজ ইতিহাসের পাতায়।
